বরিশালের বাহারি ইফতার মলিদা থেকে মাটন খেপসা
বরিশাল অঞ্চলে ইফতারে একসময় পপুলার ছিল মলিদা। চালের গুঁড়া, ভেজানো মুড়ি, চিনি অথবা গুড়ের সাথে কোরানো নারকেল, আদাবাটা পানিতে গুলিয়ে প্রস্তুত করা হতো এই পানীয়টি। এখনো কয়েকটি কতিপয় ফেমেলিতে মলিদা তৈরি করা হয়।
ষাটের দশকের শেষ দিকে বরিশাল শহরের ইফতারি আর এখনকার ইফতারির মধ্যে তফাৎ অনেক। সে সময় চালভাজার গুঁড়া আর গুড় পানির সঙ্গে মিলিয়ে ইফতারের প্রচলন ছিল। থাকত মলিদা, মুড়ি, চিড়া। আর গ্রামে পান্তাভাত, লবণ আর পানি পক্ষান্তরে ভেজানো চিড়া আর গুড়মিশ্রিত পানি। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারে সৃষ্টি হতো ভেজানো পিঠা।
ষাটের দশকের শেষ দিকে ৪র্থ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন বরিশালের সামাজিক আন্দোলনের নেতা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক শাহ সাজেদা। টাইমের সঙ্গে সাথে মানুষের রুচি, খাদ্যাভ্যাস—সবকিছুই বদলেছে। সেই সব দিন আর আজকের দিনগুলোর ডিফারেন্স অনেক।
বলতে বলতে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন তিনি, ‘এখন যেরকম ভাবে শহরের মোড়ে মোড়ে হরেক রকমের ইফতারির পসরা নিয়ে মৌসুমি দোকান গড়ে ওঠে, আশির দশকে এটা কল্পনাতীত ছিল। অধুনা ইফতারির থালায় যোগ হয়ে গিয়েছে মুখরোচক কত খাবার। প্রতিবছরই দেখছি যোগ হচ্ছে নতুন নিউ পদ।’
নগরের আমীর কুটিরের অধিবাসী তটিনী রিসার্চার রফিকুল আলম। সত্তরের দশকের শুরুর দিকে তিনি ১৬ সালের কিশোর। সে টাইমের সব কথা তাঁর মনে আছে। বললেন, সত্তরের দশকে সেই দিনগুলোতে ইফতারে ছোলা, পেঁয়াজুর প্রচলন ছিলই না। মুড়ি, চিড়া, গুড় ভিজিয়ে—এসব দিয়েই চলত ইফতার। থাকত চিনি-লেবুর শরবত। তাঁর মতে, সে সময়ের ইফতার ছিল মাগরিবের আজানের সাথে সাথে পাতলা কতিপয় খেয়ে নেওয়া। এরপর নামাজ শেষে রাতের ভারী আহার খাওয়া।
আশির দশকের সম্পন্ন দিকে ইফতারিতে যোগ হয় ছোলা ও পেঁয়াজু। সেটাও ছিল শহরকেন্দ্রিক। তখন শহরের রাস্তার সাইডে ছোট ছোট টেবিল বসিয়ে মৌসুমি কিছু ব্যবসায়ী এটা বিক্রি করতেন। নব্বইয়ের দশক থেকে সন্তপর্ণে ধীরে ইফতারি বেচাকেনায় জৌলুশ বৃদ্ধিতে থাকে। ২০০০ সালের শুরুতে এটি ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি ঘটে এবং ধীরে ধীরে ইফতারিতে যোগ হতে থাকে নানা ব্যঞ্জন, বিশেষ করে পুরান ঢাকার পদগুলো। উদাহরণসরূপ বেগুনি, আলুর চপ, ডিমের চপ, চিকেন ও বিফ আখনি, খিচুড়ি, হালিম, শাহি জিলাপি, ছোট জিলাপি, বুরিন্দা, চিকেন টিকিয়া, কাবাব, রেশমি কাবাব, বিফ চাপ, বটি কাবাব, বিরিয়ানি, তেহারি, দই-চিড়া, পাটিসাপটা পিঠা, লাচ্ছি, ফিরনি, ফালুদা, কালাভুনা এইরকম কত কি।
নগরের সদর রোড, বাংলাবাজার, লঞ্চঘাট, বাজার রোড, বগুড়া রোড, বটতলা, চৌমাথাসহ কিছু এলাকার হোটেল-রেস্তোরাঁ হতে চালু করে সড়কের পাশের টেম্পোরারি দোকান ঘুরে লক্ষ্য যায়, এসব দোকানে নানা পদ নিয়ে ইফতারির পসরা সাজিয়েছেন দোকানিরা—অনেকটা উৎসবমুখর পরিবেশ। বাহারি সাজসজ্জায় সজ্জিত ইফতারি বিক্রির টেম্পোরারি দোকানগুলো। বিকেল হলেই ভিড় লেগে থাকে দোকানগুলোয়। সন্ধ্যার মধ্যেই বিক্রি হয়ে যায় সব।
চৌমাথা অঞ্চলে ইফতারি কিনতে আসা প্রকৌশলী আমীর হোসাইন বলেন, বাড়িতে ছোলা, পেঁয়াজু, শরবত, জুস, চপ সৃষ্টি হয়। অথচ এরপরও বাইরের রেস্তোরাঁর বিশেষ কয়েকটি পদের প্রতি ঝোঁক থাকে সবার। এ জন্য ডেইলি বাইরে হতে কয়েকটি কিনতে হয়। এই সময়ে ইফতারির সব পদেরই ভ্যালু বেশি, মন্তব্য তাঁর।
শহর ঘুরে দেখা গেল, নগরের নাজেমস, আরাবেল্লা, রোজ গার্ডেন, গার্ডেন ইন রেস্তোরাঁ, লেক ভিউ, হান্ডি কড়াই, হট প্লেট, তাওয়া, জাফরান, হুমাহুম, রিভার ক্যাফে, রয়েল, আকাশসহ বেশ কতিপয় পুরোনো ও খানদানি রেস্তোরাঁর দখলে রয়েছে ইফতার বাজার। এসব রেস্তোরাঁয় খুচরা ইফতারি বিক্রির পাশাপাশি বেসিক, প্লাটিনাম, প্রিমিয়ামসহ নানা নামে প্যাকেজ ইফতারি বিক্রি হচ্ছে।
এবার বরিশালের ইফতারি মার্কেটে ব্যতিক্রম ও আলোচিত পদ হলো ‘মাটন খেপসা’। ইতিমধ্যে ভোজনরসিকদের মধ্যে খাবারটি সনামধন্য হয়ে উঠছে। আরব দেশের জনপ্রিয় এই খাবারটি তৈরি করে আলোচনায় এসেছে চৌমাথা এলাকার আরাবেল্লা রেস্টুরেন্ট। খেপসা মূলত ইয়েমেনি খাবার। বাসমতী চাল ও বিশেষভাবে প্রস্তুত মাংসের মিশ্রণ দিয়ে এই আহার প্রস্তুত করা হয়।
চিকেন, বিফ, মাটন, এমনকি মাছ দিয়েও খেপসা সৃষ্টি করা যায়। বিশেষ এই খাদ্য প্রতিটি বিক্রি হলো সমগ্র খাসির আকারভেদে ৯ হাজার টাকা থেকে শুরু। এ ছাড়া এখানে খাসির লেগ রোস্ট, মান্দিসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের সনামধন্য আহার পাওয়া যাচ্ছে। রাষ্ট্রের মানুষকে অ্যারাবিয়ান ও ভারতীয় খাদ্যের স্বাদ দিতে এবার বরিশালের ইফতারি মার্কেটে এই ব্যতিক্রমী আয়োজন করা হয়েছে বলে জানালেন আরাবেল্লার ব্যবস্থাপক সৈয়দ জাবেদুর রহমান।
No comments