Adsterra

অগাস্ট জালেস্কি || মুক্তিযুদ্ধে বিদেশির অবদান

অগাস্ট জালেস্কি || মুক্তিযুদ্ধে বিদেশির অবদান


আগষ্ট জালেস্কি - ছবি: উকিপিডিয়া

অগাস্ট জালেস্কি পোল্যান্ডের ষষ্ঠ প্রেসিডেন্ট। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ওয়ারশ শহরে ১৮৮৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর। প্রাগের একটি জিমনেশিয়াম থেকে ১৯০১ সালে ডিগ্রি পাশ করেন। তাঁর পরিবার লন্ডনে স্থানান্তরিত হলে তিনি লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিক্স থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে তিনি পোল্যান্ড ফিরে যেতে পারেন নি। ১৯১৭ সালে লন্ডনে তিনি পোলিশ ভাষার উপর শিক্ষকতা করেন। তিনি কূটনীতিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। সুইজারল্যান্ড, ইতালি, গ্রীস সহ বিভিন্ন দেশে দায়িত্ব পালন করেন। লিগ অব নেশন্স এ প্রতিনিধিও ছিলেন। তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৪৭ সালে তিনি পোলিশ গর্ভমেন্টের প্রেসিডেন্ট মনোনীত হন। তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘদিন। ১৯৭২ সালের ৭ এপ্রিল ৮৮ বছর বয়সে তিনি লন্ডনে মারা যান।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করেন। ইউরোপের প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে পোল্যান্ড জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য ছিল।

বাংলাদেশের গণহত্যা ও নির্যাতন সংবাদ পেয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব উথান্ট ১৯৭১ সালের ২ এপ্রিল পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নিকট পত্র লেখেন বাংলার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের জন্য ত্রাণ প্রেরণের প্রস্তাব দিয়ে। কিন্তু পাকিস্তান তা প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করে এবং ৪ ডিসেম্বর ভারত পাকিস্তান আক্রমণ করে। উভয় দেশ জতিসংঘের মহাসচিব নিক্ট আক্রান্ত হওয়ার অভিযোগ এনে পত্র দেন। মহাসচিব ৪ ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে জরুরি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। সোভিয়েত রাশিয়া ও পোল্যান্ড দাবি জানায় যে, বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলকে তাদের দেশের বক্তব্য প্রদানের জন্য আমন্ত্রণ জানাতে হবে। আমেরিকা ও চীন এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। তারা ভারতকে আক্রমণকারী হিসেবে অভিযুক্ত করে সৈন্য প্রত্যাহারের দাবি জানায়। প্রস্তাবটি ভোটে দেওয়া হয়। প্রস্তাবের পক্ষে ১১ ভোট এবং ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য ভোটদানে বিরত থাকে। রাশিয়া ও পোল্যান্ড বিপক্ষে ভোট দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো প্রয়োগ করায় যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব নাকচ হয়ে যায়। ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ রক্ষা পেল।

একই দিনে আমেরিকার প্রস্তাবের বিপরীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব পাকিস্তানে একটি রাজনৈতিক সমাধান ও পাকিস্তানের সহিংসতা বন্ধের জন্য খসড়া প্রস্তাব পেশ করে। ৫ ডিসেম্বর আলোচনান্তে ভোট গ্রহণ করা হয়। সোভিয়েত প্রস্তাবের পক্ষে দুভোট রাশিয়া এবং পোল্যান্ড। ৮ সদস্যের প্রস্তাবের পক্ষে ১১ ভোট পড়ে। ইউকে এবং ফ্রান্স ভোটদানে বিরত থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়বের দ্বিতীয়বার ভেটো দেয়ার ফলে আট জাতির যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব অকার্যকর হয়ে পড়ে। নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত না হওয়ার আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রেরণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর ভারত-বাংলাদেশের মিত্র বাহিনীর নিকট যশোর সেনানিবাসের পতন ঘটলে জাতিসংঘে পাকিস্তাব সমর্থক মহলে হতাশা সৃষ্টি হয়। ৯ ডিসেম্বর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী ব্রেজনেভের নিকট পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব করে পত্র দেন। এদিন ব্রেজনেভ পত্রের উত্তর দেন। কিসিঞ্জার তখনই বুঝতে পারলেন বাংলাদেশ স্বাধীন হবে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের তিন বার ভেটোর প্রেক্ষিতে ১৩ ডিসেম্বর ব্রিটেন ও ফ্রান্স নিরাপত্তা পরিষদে গ্রহণযোগ্য যুদ্ধ বিরতি এবং নির্বাচনে জনগণের যে ইচ্ছা প্রকাশ পেয়েছে তাঁর আলোকে রাজনৈতিক সমাধান-এর প্রস্তাবের বিরুদ্ধে চীন ভেটো প্রয়োগ করে। পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সম্পূর্ণ পরাজয়ের প্রেক্ষাপটে ১৪ ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় জুলফিকার আলী ভুট্টো জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। আলোচনাকালে সংবাদ এলো পাকবাহিনীর কমান্ডার জেনারেল নিয়াজী জেনেভা চুক্তির ভিত্তিতে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব করেছেন। পাকিস্তান সরকার নিয়াজীর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে নিরপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির জন্য আলোচনা চালিয়ে যায়।

১৫ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী ঢাকা শহর ঘিরে ফেলে। পাকবাহিনীকে আত্মসমর্পণের জন্য ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল শ্যাম মানেকশ নির্দেশ দিচ্ছেন। জুলফিকার আলী ভুট্টো নিরাপত্তা পরিষদে ১৫ ডিসেম্বর তাঁর সর্বশেষ ভাষণে বলেন, ‘ঢাকার পতন হলে তাতে কি আসে যায়? আমরা নতুন পাকিস্তান গড়ে তুলব। আমরা এক হাজার বছর ধরে যুদ্ধ করবো।তিনি চিৎকার করে হাতের কাগজ ছিঁড়ে ফেলে নিরাপত্তা পরিষদ ত্যাগ করেন।

সোভিয়েত রাশিয়া ও পোল্যান্ড ব্যতীত নিরাপত্তা পরিষদে অন্য সদস্যরা বাংলাদেশের বিষয়টি এড়িয়ে যায়। একমাত্র রাশিয়া ও পোল্যান্ড বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছানুসারে রাজনৈতিক মীমাংসার প্রস্তাব পেশ করে। পোল্যান্ডের ১৫ ডিসেম্বরের প্রস্তাবের প্রধান ধারাগুলো ছিলো- অবিলম্বে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করা, পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রত্যাহার করে স্থায়ী যুদ্ধবিরতি। ১৫ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধ বিরতি ও পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব পেশ করে। সভায় সোভিয়েত প্রতিনিধি ইয়াকফ মালিক কঠোর ভাষায় চীনের প্রতিনিধির উত্তর প্রদান করেন।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে পাকবাহিনী ঢাকায় মিত্রবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে। ৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ ৫০হাজার মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়। ইউরোপের মধ্যে প্রথম দেশ হিসেবে পোল্যান্ড বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দেয়পোল্যান্ডের এই অটল নেতৃত্বের কাণ্ডারি ছিলেন তাদের প্রেসিডেন্ট অগাস্ট জালেস্কি।

আরও পড়ুন:

বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ : dhaka voice: বাংলাদেশ


No comments

Powered by Blogger.