রহস্যঘেরা কৈলাস পর্বতের অমীমাংসিত গল্প
আজ আমরা জানবো রহস্যঘেরা কৈলাস পর্বতের অমীমাংসিত গল্প।
স্থানীয় মানুষ ও তীর্থযাত্রীরা পর্বতটি নিয়ে
এমন কিছু বিস্ময়কর ঘটনার উল্লেখ করেন, যেগুলোর কোনো
ব্যাখ্যা মেলে না বলেই তা অলৌকিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। দিনের বিভিন্ন সময় রঙ পালটায়
কৈলাস। একই সঙ্গে বদলে যায় কৈলাসের ভূ-প্রকৃতি। কৈলাসের আঙিনায় পৌঁছে যাওয়া
মানুষের শরীরে দ্রুত ফুটে ওঠে বার্ধক্যের ছাপ। অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে নখ ও
চুল। রহস্য গভীর করে তোলে কৈলাস পর্বতের গায়ে বরফ ও পাথরের মেলবন্ধনে তৈরি হওয়া
পবিত্র 'স্বস্তিকা' এবং 'ওঁ' চিহ্ন।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পুরাণ অনুযায়ী, কৈলাস পর্বতের
চূড়ায় দেবাদিদেব মহাদেবের নিভৃত আবাস। যেখানে বসে সৃষ্টি, ধ্বংস, সংহার ও প্রলয় নিয়ন্ত্রণ করেন শিব। গুগল
আর্থের তোলা একটি ছবিতে আলো-ছায়ার খেলায় হাস্যরত শিবের মুখাবয়ব দেখে সনাতন
বিশ্বাস এটি সত্যতার এবং গভীরতম পবিত্রতার।
বৌদ্ধদের কাছে কৈলাস পর্বত হল সৃষ্টির প্রাণকেন্দ্র। বজ্রায়ণ শাখার বৌদ্ধরা
মনে করেন, কৈলাসের শৃঙ্গে ধ্যানমগ্ন হয়ে আছেন ধ্যানের
দেবতা হেরুক চক্রসম্ভার। তিব্বতের বন ধর্মের অনুসারীরা মনে করেন, কৈলাস শৃঙ্গ তাদের আকাশ দেবতা সিপাইমেনের আবাস। জৈন ধর্মের অনুসারীদের কাছেও
পবিত্র এই শৃঙ্গ। কারণ প্রথম তীর্থঙ্কর ঋষভদেব নির্বাণ লাভ করেছিলেন এই কৈলাস
পর্বতেই।
পৃথিবীর একদিকে উত্তর মেরু এবং অপর দিকে দক্ষিণ মেরু, যার মাঝখানে রয়েছে হিমালয়। হিমালয়ের কেন্দ্র
হলো কৈলাস পর্বত। বিজ্ঞানীদের মতে, এটাই পৃথিবীর
কেন্দ্র। এখানে এমন একটি কেন্দ্র রয়েছে যাকে অক্ষ মুন্ডি বলা হয়। অক্ষ মুন্ডির
অর্থ পৃথিবীর নাভি বা স্বর্গীয় মেরু এবং ভৌগলিক মেরু কেন্দ্র। এটি স্বর্গ এবং
পৃথিবীর মধ্যে সংযোগের একটি বিন্দু, যেখানে দশটি
দিক মিলিত হয়। ১০০টি ছোট পিরামিডের কেন্দ্র কৈলাস পর্বত। এই পর্বতের গঠন একটি
কম্পাসের চারটি বিন্দুর মতো এবং এটি একটি নির্জন স্থানে অবস্থিত, যেখানে কোনো বড় পর্বত নেই।
কৈলাস পর্বতে আরোহণ
নিষিদ্ধ। পর্বতে 'মানসরোবর হ্রদ' অবস্থিত।
পৌরাণিক বিশ্বাস অনুসারে, এর কাছেই কুবেরের শহর। এক সময় পবিত্র এই
মানসরোবরের অধিকার নিয়ে তুমুল বাকবিতণ্ডা শুরু হয়েছিল বৌদ্ধ ও বন ধর্মাবলম্বীদের
মধ্যে। মিলারেপা ও বনচুঙের মধ্যে শুরু হয়েছিল কালা জাদুর লড়াই। যিনি জিতবেন তিনিই
পাবেন মানস সরোবরের অধিকার। কিন্তু কেউ কাউকে হারাতে পারেননি। তখন ঠিক হয়েছিল, যিনি আগে কৈলাস শৃঙ্গে পা রাখবেন তার দখলে থাকবে মানস সরোবর। মিলারেপা ও বনচুঙ
পৌঁছে গিয়েছিলেন কৈলাস পর্বতের পাদদেশে। একসময় বনচুঙ পৌঁছে গিয়েছিলেন শৃঙ্গের
কাছাকাছি। তখনও ধ্যানমগ্ন হয়ে বসেছিলেন মিলারেপা। চোখ খুলে মিলারেপা দেখলেন কৈলাস
শৃঙ্গের চূড়া ঘিরে রাখা কালো মেঘে ফেটে সূর্যের এক অস্বাভাবিক উজ্জ্বল রশ্মি এসে
পড়েছে তার শরীরে। সেই সূর্যরশ্মি অনুসরণ করে বনচুঙের অনেক আগেই মিলারেপা পৌঁছে
গিয়েছিলেন কৈলাস শৃঙ্গে। নিয়েছিলেন মানস সরোবরের দখল। তবে শৃঙ্গ থেকে নেমে এসে মিলারেপা
বলেছিলেন, কেউ যেন কোনোদিন এই শৃঙ্গে আরোহণের চেষ্টা না
করে। কারণ কৈলাস শৃঙ্গে বিশ্রাম নিচ্ছেন স্বয়ং ভগবান। দেবতাদের আবাসস্থলে যেন
মানুষ গিয়ে কোনো বিরক্ত না করে।
আজ অবধি কোনো পর্যটক, বিজ্ঞানী কিংবা স্যাটেলাইট কৈলাসের চূড়ায় পৌঁছানোর রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি।
এমনকি চূড়ায় আরোহণের জন্য কোনো সূত্রও আবিষ্কার করতে পারেনি।
কৈলাসে দুটি প্রধান হ্রদ রয়েছে- একটি হলো মানসরোবর যা বিশ্বের সবচেয়ে বিশুদ্ধ
জলের হ্রদ এবং যার আকার সূর্যের মতো। বলা হয়ে থাকে
বিষ্ঞুদেব পৃথিবী সৃষ্টির আগেই এই হ্রদের পরিকল্পনা করেছিলেন। আরেকটি হলো রাক্ষসতাল হ্রদ, যা পৃথিবীর সর্বোচ্চ নোনা জলের হ্রদ এবং যার
আকৃতি চাঁদের মতো। এই উভয় হ্রদ সৌর ও চন্দ্র শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে যা ইতিবাচক
এবং নেতিবাচক শক্তির সাথে সম্পর্কিত। দক্ষিণ দিক থেকে দেখলে একটি স্বস্তিক প্রতীক
দেখা যায়। এই হ্রদগুলো প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়েছিল নাকি সেগুলি তৈরি করা হয়েছিল
তা এখনও রহস্যই রয়ে গেছে।
কৈলাস পর্বতের চার দিক থেকে ৪টি নদীর উৎপত্তি হয়েছে- ব্রহ্মপুত্র, সিন্ধু, সুতলজ এবং কর্নালি। গঙ্গা, সরস্বতীসহ চীনের অন্যান্য নদীও এই নদীগুলো থেকে বের হয়েছে। কৈলাসের চার দিকে
নদীগুলোর উৎপত্তিস্থলে বিভিন্ন প্রাণীর মুখাবয়ব
রয়েছে।
রাশিয়ান বিজ্ঞানীদের মতে, কৈলাসের অক্ষ মুন্ডিতে অতিপ্রাকৃত শক্তি প্রবাহিত
হয় এবং মানুষ সেই স্পিরিচ্যুয়াল শক্তির সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। কথিত আছে যে, শুধুমাত্র পুণ্যবান আত্মা এখানে থাকতে পারে।
রাশিয়ার বিজ্ঞানীরা যখন তিব্বতের মন্দিরের ধর্মগুরুর সাথে দেখা করেছিলেন, তখন তারা বলেছিলেন কৈলাস পর্বতের চারপাশে একটি অতিপ্রাকৃত শক্তি প্রবাহ রয়েছে, যেখানে সন্ন্যাসীরা এখনও আধ্যাত্মিক গুরুদের সাথে টেলিপ্যাথিক যোগাযোগ করে।
হিমালয়ের লোকেরা বলেন, ইয়েতি মানব হিমালয়ে বাস করে। কেউ একে
বাদামি ভালুক বলে, কেউ বন্য মানুষ আবার কেউ তুষারমানব বলে। একটি
জনপ্রিয় বিশ্বাস আছে যে, এটি মানুষকে শিকর করে খায়। কিছু বিজ্ঞানী
একে নিয়ান্ডারথাল মানুষ বলে মনে করেন। বিশ্বজুড়ে ৩০ জনেরও বেশি বিজ্ঞানী দাবি
করেছেন হিমালয়ের তুষারময় অঞ্চলে তুষারমানবের উপস্থিতি রয়েছে।
বিশ্বের বিরল হরিণ হল কস্তুরী হরিণ। এই হরিণ শুধুমাত্র উত্তর পাকিস্তান, উত্তর ভারত, চীন, তিব্বত, সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়ায় পাওয়া যায়। এই হরিণের কস্তুরী
অত্যন্ত সুগন্ধযুক্ত এবং ঔষধি গুণসম্পন্ন, যা এর দেহের
পিছনের গ্রন্থিতে একটি পদার্থের আকারে থাকে। কস্তুরী হরিণের কস্তুরী, বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল পশুপণ্য। এই তুষারমানব ও বিরল কস্তুরী হরিণের জন্ম
এক বিরাট রহস্য। যা পৃথিবীর আর কোথাও নেই।
এ পর্যন্ত যারা কৈলাস পর্বতে ওঠার চেষ্টা করেছেন তাদের সঙ্গেই ঘটেছে
অতিপ্রাকৃত ঘটনা। কিছুক্ষণ পরই শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাজ করা বন্ধ করে দেয়।
অকালবার্ধক্য চলে আসে পর্বতারোহীর শরীরে। এমনকি মাথার চুল ও হাতের নখ বাড়তে থাকে
দ্রুতগতিতে! সাধারণভাবে মানুষের নখ-চুল যে হারে বাড়ে, কৈলাস পাহাড়ে অন্তত ১২ ঘণ্টা কাটালে নাকি এ বৃদ্ধির হার দ্বিগুণ হয়ে যায়।
এর সত্যতা যাচাই করতে, কয়েক জন সাইবেরিয়ান পর্বতারোহী কৈলাস পর্বতে আরোহণ করেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাদের
বয়স নাকি কয়েক দশক বেড়ে গিয়েছিল। আজও এ ঘটনা রহস্যের মধ্যেই আছে।
করুণার হ্রদ নামে পরিচিত এই জলাশয়টি পার্বতী সরোবর নামেও সমাদৃত। পুরাণ
অনুসারে এই হ্রদে শিবের স্ত্রী দেবী পার্বতী নিজের শরীরের মাটি বা ফেনা থেকে পুত্র
গণেশকে সৃষ্টি করেছিলেন।
রাশিয়ার চক্ষু বিশেষজ্ঞ ড. আর্নেস্ট মুল্ডাশেভ, ১৯৯৯ সালে
ইতিহাসবিদ, পদার্থবিদ ও ভূতত্ববিদের এক বিশাল দল নিয়ে
গিয়েছিলেন কৈলাসে। দলটি মাসের পর মাস কাটিয়েছিল সেখানে। কথা বলেছিল অসংখ্য তীর্থযাত্রী, হিন্দু ও বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের সঙ্গে। কৈলাসে থাকাকালীন কিছু অস্বাভাবিক ঘটনার
সাক্ষী হয়েছিল দলটি। দেশে ফিরে ড. মুল্ডাশেভ জানিয়েছিলেন, রাতের অন্ধকারে কৈলাসের রূপ পাল্টে যাওয়ার কথা। হাড় হিম করা আওয়াজ ভেসে আসতে
থাকে কৈলাস পর্বতের দিক থেকে। সেই আওয়াজটি অবিকল যেন 'ওম' বলছে। যেন পুরো পর্বত একই সাথে একই কথা
বলছিল।
কৈলাসে গেলে এই ওম
ধ্বনিটি অবিরাম শুনতে পাওয়া যায়। অনেকেই মনে করেছেন, একটি বিমান
কাছাকাছি উড়ছে, কিন্তু মনোযোগ দিয়ে শুনে দেখেছেন এই ধ্বনিটি
'ডমরু' বা 'ওঁ' ধ্বনির মতো। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটি বরফ গলে
যাওয়ার শব্দ হতে পারে। এমনও হতে পারে যে, আলো এবং
শব্দের মধ্যে এমন মিথস্ক্রিয়া আছে, যার কারণে
এখান থেকে 'ওঁ' ধ্বনি শোনা
যায়।
যম দুয়ার হলো কৈলাস যাত্রার অন্যতম প্রধান গন্তব্য যা দারচেন থেকে ৩০ মিনিট
দূরত্বে তারবোচে অবস্থিত। বলা হয়ে থাকে যম দুয়ার স্বর্গ ও আত্মার সাথে যুক্ত।
এটিকে বলা হয় 'দ্য গেটওয়ে অফ গড অফ ডেথ' অর্থাৎ মৃত্যুর ঈশ্বরের প্রবেশদ্বার'।
কৈলাস পর্বতের আকাশে বহুবার ৭ ধরনের আলো জ্বলতে দেখা গেছে বলে দাবি করা হয়।
নাসার বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এখানে চৌম্বক শক্তির কারণেই এমনটা হতে পারে। এখানে চৌম্বকীয় শক্তি আকাশের সাথে মিলিত হয়ে
বহুবার এমন রং তৈরি করতে পারে। কিন্তু এর সত্যতা প্রমাণের কোনো ব্যাখ্যা তারা
দেননি।
সূর্যাস্তের সময় আলো ছায়ার খেলায় পর্বতগাত্র এক আকর্ষণীয় রূপ ধারণ করে। যা
সনাতন ধর্মের একটি শুভ চিহ্ন হিসেবে বিবেচিত। এক বলে স্বস্তিক চিহ্ন।
পুরাণ অনুযায়ী কৈলাস পর্বতের চারটি পাশ স্ফটিক, চুনি, সোনা এবং লাপিস লাজুলি দ্বারা গঠিত। দিনের বিভিন্ন সময়ে আলো পড়ে এই সব পাথর
বা ধাতুর বিভ্রম তৈরি করে কৈলাস । কৈলাসের চার দিকে চারটি প্রাণীর মুখাবয়ব রয়েছে-
উত্তরে একটি সিংহের মুখ, দক্ষিণে একটি ময়ূরের মুখ, পূর্ব এবং পশ্চিমে হাতির মুখ। একই পর্বতে এত বৈচিত্র্যতার রহস্য বড়ই অদ্ভূত।
পুণ্যবান কৈলাসের হাজারো রহস্য বলে শেষ করা অসম্ভব। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন রূপ
নতুন সব রহস্যের জন্ম নেয় কৈলাসের গা ঘেঁষে। আর এই সব রহস্যের ব্যাখ্যা এখনও
অমীমাংসিত, রাশিয়াসহ বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানীরা চেষ্টা
চালিয়ে যাচ্ছেন এই রহস্য উদঘাটনের।
No comments