অতলে হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের এক মহানায়ক, মালিটোলার নাদের গুন্ডা
অতলে হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের এক মহানায়ক
মালিটোলার “নাদের গুন্ডা”!
লেখক: বিখ্যাত গায়ক, সুরকার লাকী আখন্দ
নাদের গুন্ডা - ছবি সংগৃহীত - ফ্লিকারস.কম (ক্রেডিট: রুদ্র)
মালিটোলার নাদেরের কথা জানেন আপনারা? আমি নিশ্চিত ২শ’ থেকে ৩শ’ জনের বেশি জানেন না এই অসম সাহসী মানুষটির বীরগাঁথা। না, নাদেরের কোনো রাষ্ট্রীয় পদক নেই, নাদের ছিল নাদের গুন্ডা। মালিটোলার বিখ্যাত নাদের গুন্ডা।
স্বাধীনতা পূর্ব
বাংলাদেশের গুন্ডা-মাস্তানদের আভিজাত্য ছিল বৈকি। ছিল পরমত
সহিষ্ণুতা। ছিল মুরুব্বিদের প্রতি অন্তর থেকে সম্মান। বর্তমানের ছ্যাঁচড়া, লুম্পেনদের সাথে নাদের গুন্ডাকে মেলাবেন না কেউ। নাদের হল ঢাকা কেন্দ্রিক
গেরিলা যোদ্বাদের মাঝে সবচেয়ে কম পরিচিত নাম। আমাদের বানানো ইতিহাসে নাদের
গুণ্ডার ঠাই হয়নি। নাদেরের তাতে বয়েই গেছে। নাদের গুন্ডা দেখিয়েছিল এই দেশের
জননীরা কাপুরুষ জন্ম দেয় না, জন্ম দেয়
নাদেরের মতো দুঃসাহসী বীর।
মুক্তিযুদ্ধে
পাকিস্তানিদের আতঙ্ক নাদেরের অসীম বীরত্বগাথা আজ খুব কম লোকেরই জানা। বংশালের
বয়োবৃদ্ধ প্রাচীন লোকেরও ভাসা ভাসা মনে করতে পারেন সেই সময়ের কাহিনী। সুসজ্জিত
পাকিস্তানি আর্মি ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে শহীদ নাদেরর অসম লড়াইয়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী
ছিলেন দুলু গুন্ডা (চিত্র নায়ক ফারুক)। ২৫ মার্চের রাতে
পাকিস্তান জানোয়ার বাহিনী যখন ঘুমন্ত নিরস্ত্র বাঙ্গালীর ওপর হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে
তখন ঢাকার মানুষের পালাবার রাস্তাও ছিল না।
কিন্তু
ব্যতিক্রম ছিল নাদের। চারিদিকে গুলি,
কামান আর
মর্টারের গোলাগুলিতে নাদের বুঝতে পারে কি ঘটছে,
সাথে সাথে সে
নিজের মতো করে তৈরি হয়ে যায়। পাকিস্তান আর্মির কনভয় বংশালে ঢোকার সাথে সাথে নাদের
একটি দেশ বন্দুক নিয়ে ছাদ টপকে টপকে ঈসা ব্রাদার্সের ছাদে গিয়ে পজিশন নেয়।
বন্দুকের রেঞ্জের মধ্যে আসার সাথে সাথেই নাদেরের গুলিতে লুটিয়ে পড়ে কয়েকজন
পাকিস্তান আর্মি। অবিশ্বাস্য এই আক্রমণে পাক আর্মি তৎক্ষণাৎ ফিরে যায়। নাদেরর
আক্রমণে হায়েনার মতো ক্ষিপ্ত পাকি আর্মিরা শক্তি সঞ্চয় করে ঝাপিয়ে পড়ে বংশাল, নয়াবাজার, আবুল হাসানাত রোড, কাজী আলাউদ্দিন রোডের বিভিন্ন বাড়িতে।
প্রথম দিকে
তাদের টার্গেট শুধু হিন্দু বাড়ির প্রতি হলেও প্রতিরোধের সম্মুখীন হওয়ায় তারা নির্বিচারে
বাড়ি-ঘরে আগুন দিতে থাকে। সে যাত্রা নাদের
পালিয়ে গেলেও পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজনের সহায়তায় তার
গেরিলা অপারেশন অব্যাহত রাখে। নাদেরর অস্ত্রের যোগানদাতা ছিলা সংগ্রাম নামে এক
পাঞ্জাবী। অর্থের বিনিময়ে এসব অস্ত্র সংগ্রহ করে দিত।
ইতোমধ্যে
শান্তিকমিটির দালালরা সংঘটিত হওয়ায় এলাকায় ঘোরাফেরা সমস্যা হয়ে দাড়ায়। মে মাসের
শেষের দিকে আরমানীটোলায় পাকিস্তানি দালালদের প্রধান খাজা খায়েরউদ্দিনের সভায়
আক্রমনেরর প্রস্তুতি নেয় নাদেরর দল। এই সভায় আক্রমনের জন্য দরকার অনেক অস্ত্র।
সংগ্রাম অস্ত্র সাপ্লাইয়ের প্রতিশ্রুতি দেয় এবং সেই মতে নাদের তার বাহিনী নিয়ে
আর্মেনীয় চার্চে অবস্থান নেয়। যথাসময়ে সংগ্রাম হাজির হয় অস্ত্রের চালান নিয়ে।
কিন্তু নাদেরের ওয়াচ গার্ডরা দেখতে পেল অস্ত্র নিয়ে আসছে সংগ্রামের লোকজন নয়, পাক আর্মিরা। সাথে সাথে নাদের সংগ্রামকে গুলি করে মেরে ফেলে।
ততক্ষণে
পাকিস্তান আর্মিরা চারিদিক দিয়ে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে। নাদের তার বাহিনী নিয়ে
পালানোর চেষ্টা করে। নাদের-হারুণ দুই সহোদর এবং বন্ধু সোহরাব পাক
আর্মির ওপর গুলি চালিয়ে বাকিদের কভার দেয়। একপর্যায়ে হারুণ ও সোহরাবকে গুলি খেয়ে
লুটিয়ে পড়তে দেখে নাদের সড়ে পড়ার চেষ্টা করে। কিন্তু দেয়াল টপকানো অবস্থাতেই পায়ে
গুলিবিদ্ধ হয় সে। আহত নাদের আশ্রয় নেন বেচারাম দেউড়ির বস্তিতে।
চারিদিকে চিরুনী
অভিযান করতে করতে পাক আর্মিরা বস্তিতে হাজির হয়। বস্তির লোকজন জানের ভয়ে আহত
নাদেরকে ধরিয়ে দেয়। নাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। পাক আর্মির বর্বর
নির্যাতনের মুখেও নাদের নিজের ও সহযোগীদের পরিচয়ের বিষয়ে মুখ খোলেনি। তারপরই
বংশালের আরেক রংবাজ শান্তি বাহিনীতে যোগ দেয়া খুনি গেদা গুন্ডাকে নেয়া হয়
ক্যান্টনমেন্টে। সেখানে গেদা সনাক্ত করে নাদেরকে। সেনারা উল্লসিত হয়, পৈশাচিকভাবে গেদার সামনেই হত্যা করে নাদেরকে যার বিবরণ পুরা বংশাল জুড়ে প্রচার
করে গেদা। এভাবেই সমাপ্তি ঘটে পুরানো ঢাকার পাকিস্তান আর্মি ও রাজাকারদের আতঙ্ক
নাদেরের।
মুক্তিযুদ্ধের
প্রথম গেরিলা শহীদ নাদের কিন্তু তার ভাগ্যে বীরত্বের জন্য কোনো খেতাব জোটেনি।
মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায়ও তার নাম নেই। কোনো বিজয় উৎসবে ধ্বনিত হয় না নাদেরর নাম।
কিন্তু নাদেররা নামের মোহে সর্বস্ব বিলিয়ে দেয়নি। ৭১ এর মার্চের আগেও যে নাদের
পাপী, গুন্ডা,
বদমাশ ছিল অথচ
তার স্মৃতিতে এখনো পুরান ঢাকার অনেক মানুষের চোখ আদ্র হয়, ঋণী মনে করে, এটাই নাদেরের বড় পাওয়া।
আপনার আজকের
প্রার্থণায় নাদেরের নামটি রাখুন, নাদেরের নামের
আগে শহীদ ব্যবহার করুন। বিশ্বাস করুন নাদের কিছু পাবার আশায় যুদ্ধে যায়নি, নাদের আপনার জন্য, আমার জন্য,
আমাদের জন্য, এই দেশের আপামর নারী-পুরুষের জন্য, এই দেশের ঐ প্রানপ্রিয় পতাকার জন্য গিয়েছিল।
আরও পড়ুন: dhaka voice: মুক্তিযুদ্ধ
No comments