মার্শাল জোসিপ ব্রজ টিটো || মুক্তিযুদ্ধে বিদেশির অবদান
মার্শাল জোসিপ ব্রজ টিটো || মুক্তিযুদ্ধে বিদেশির অবদান
সাবেক যুগোশ্লাভিয়ার অবিসংবাদিত নেতা মার্শাল জোসিপ ব্রজ টিটো এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। তিনি একাধারে যুগোশ্লাভিয়ার প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ১৯৪৫ সাল থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত দোর্দণ্ড প্রতাপে দেশ পরিচালনা করেন। কমিউনিস্ট নামীয় রাজনৈতিক দলের তিনি সদস্য ছিলেন। তাঁর অন্যতম কৃতিত্ব হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বলয়ে অবস্থান করে যুগোশ্লাভিয়া সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র গঠন করা। পরবর্তীতে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। যুগোশ্লাভিয়ার বিবাদমান বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীকে একত্রিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর এক দশকের মধ্যে তা গৃহযুদ্ধে রূপান্তরিত হয়ে দেশটি ভেঙ্গে যায়।
ক্রোয়েশিয়ার কুমরোভেচ এলাকায়
টিটো জন্মগ্রহণ করেন। মা ছিলেন শ্লোভাক ও বাবা ছিলেন ক্রোয়েশীয় গ্রামীণ কৃষক।
জীবনের শুরুতে তালাকর্মী হিসেবে টিটো প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে
অস্ট্রীয় সেনাবাহিনীতে প্রতিপক্ষের হাতে আটক হন ও যুদ্ধবন্দি হিসেবে রাশিয়ায়
প্রেরিত হন। সেখানেই তিনি সমাজতান্ত্রিক ধ্যানধারণার প্রতি আকৃষ্ট হন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে
অসামান্য ভূমিকা নেয়ায় যুদ্ধশেষে তিনি সম্মানিত হন। ১৯১৭ সালে অনুষ্ঠিত রুশ
বিপ্লবে বলশেভিকদের পক্ষাবলম্বন করেন টিটো।
যুদ্ধের পর তিনি ক্রোয়েশিয়ায়
ফিরে আসেন ও অবৌধভাবে কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠক হিসেবে কাজ করেন। এ সময়ে তিনি
ধাতবমিস্ত্রী হিসেবে কর্মরত অবস্থায় শ্রমিক সংক্রান্ত বিষয়ে দল থেকে বহিষ্কৃত হন।
অবৈধভাবে কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠক হিসেবে কর্মকালীন সময়ে তিনি ছদ্মনাম ‘ টিটো’ গ্রহণ
করেন। এর ফলে তিনি ১৯২৮ থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত কারাভোগ করেন। টিটো নাম ধারণ করে
মস্কো ফিরে গিয়ে ইন্টারন্যাশনাল (কোমিনটার্ন,
পরবর্তীতে কোমিনফর্ম) নামীয়
সাম্যবাদী দলের হয়ে কাজ করেন।
১৯৩৬ সালে কোমিনটার্ন টিটোকে
যুগোশ্লাভিয়ায় প্রেরণ করে সমাজতান্ত্রিক দল গঠন করার জন্যে। পরের বছর যুযোশ্লাভ
কমিউনিস্ট পার্টির মহাসচিব হিসেবে নিযুক্ত হন। যুগোশ্লাভিয়া ও সোভিয়েত ইউনিয়নে
নাজি জার্মানির আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে টিটো সর্ব-দলীয় যুগোশ্লাভ সামরিক
বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন। আগ্রাসী জার্মান, ক্রোয়েশীয় ফ্যাসিবাদী ও সার্বিয় জাতীয়বাদীদের
হাত থেকে দেশকে রক্ষা করেন। প্রাথমিকভাবে রক্ষণাত্মক ভঙ্গিমায় জার্মানির বিপক্ষে
যুদ্ধ করে তাঁর বাহিনী। ১৯৪২ সালে তিনি সমাজতান্ত্রিক শাসিত আঞ্চলিক সরকার গঠন
করেন।
প্রথমদিকে মার্শাল টিটো
স্ট্যালিনের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। কিন্তু সোভিয়েত নেতা স্ট্যালিন তাঁর কিছু কাজের
সমালোচনা করলে তিনি সেটা প্রত্যাখ্যান করেন। এর ফলে ১৯৪৮ সালে যুগোশ্লাভ দল
কোমিনফর্ম থেকে বহিষ্কৃত হয় ও সোভিয়েত প্রাধান্য অথবা যুগোশ্লাভিয়ার স্বাধীনিতা-এ
দুটি পছন্দের যে-কোন একটিকে বেছে নিতে বলা হয়। তিনি
স্বাধীনতাকেই বেছে নেন যা যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক সমাদৃত হয়। ঠান্ডা যুদ্ধের সময় টিটো
মার্কসবাদের মানবতা দিক বিবেচনায় এনে শ্রমিকদের স্ব-ব্যবস্থাপনা ও উদার অর্থনৈতিক
পুনর্গঠনের প্রস্তাব আনেন।
১৯৪৫-১৯৬৩
পর্যন্ত টিটো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬০-এর
দশকে এশীয় ও আফ্রিকার দেশগুলোর নেতৃবর্গসহ ভারত ও মিশরের রাজনীতিবিদদের সাথে নিয়ে
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের ধারণা তুলে সংগঠন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন মার্শাল জোসিপ
ব্রজ টিটো। এদেশগুলো যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে মুক্ত ছিল।
প্রত্যেক দেশই নিজস্ব ধ্যান-ধারণা ও সিদ্ধান্ত নিয়ে পারতো এবং যথাসাধ্য
ঠান্ডা যুদ্ধ থেকে নিজেদের মুক্ত রাখার চেষ্টা চালাচ্ছিল।
মার্শাল জোসেফ টিটোকে তাঁর
সমসাময়িক রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান সামরিক ও বেসামরিক আমলা, ছোট
বড়, নারী-পুরুষ
নির্বিশেষে “কমরেড” বলে ডাকতেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করতেন। চার্চিল, মার্গারেট
থ্যাচার থেকে শুরু করে ইদি আমিন, সাদ্দাম, গাদ্দাফি বা সুকর্ণ, আর্নেস্টা
চে, ফিদের
কাস্ট্রো, ইয়াসির
আরাফাত সবাই তাঁকে “কমরেড” বলেই ডাকতো। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ, শীতল
যুদ্ধের দু পারের রাষ্ট্র ও সমর নায়কের সবার কাছেই সিনিয়র ট্রিট হতেন কমরেড টিটো।
মুক্তিযুদ্ধের সময়
পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস হত্যা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে মার্শাল জোসিপ ব্রজ টিটো
বাংলাদেশের নিপীড়িত মানুষের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়ান। তিনি বাংলাদেশ
মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে জোরালো সমর্থন জানান। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতা হিসেবে
তিনি ছিলেন জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সমর্থক এবং তাঁর ভূমিকা বাংলাদেশের পক্ষে তৃতীয়
বিশ্বর সমর্থন জোরদার করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথেও তাঁর খুব ভালো
সখ্যতা ছিল। ১৯৮০ সালের ৪ মে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সেইসময় খসে পরা এই উজ্জ্বল
নক্ষত্রকে বিদায় দিতে যুগোশ্লাভিয়াতে সৃষ্ট হয়েছিল একটি নক্ষত্রপুঞ্জ। ৩ জন রাজা, ৩১
দেশের প্রেসিডেন্ট, ৬ জন রাজপুত্র,
২২ দেশের প্রধানমন্ত্রী ও ৪৭
জন পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ শীতল যুদ্ধের দু প্রান্তের ১২৮ টি দেশের প্রতিনিধি সেই দিন
হাজির হয়েছিলেন একটি নক্ষত্রকে শুভ বিদায় জানাতে। বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মরণোত্তর
মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা প্রদান করে।
No comments