বীর প্রতীক ওডারল্যান্ড || মুক্তিযুদ্ধে বিদেশির অবদান
ডাচ-অস্ট্রেলিয়ান সামরিক কমান্ডো অফিসার উইলিয়াম আব্রাহাম সাইমন ওডারল্যান্ড বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ও সাহসী অবদান রাখেন। একমাত্র বিদেশি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ অবদানের জন্য তাকে বীরপ্রতীক (বাংলাদেশের চতুর্থ সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব) প্রদান করা হয়। তাঁর জন্ম ৬ ডিসেম্বর ১৯১৭ সালে নেদারল্যান্ডের রাজধানী আমস্টারডামে তাঁর মৃত্যু ১৮ মে ২০০১। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা
তাঁর ছিল না। জীবিকা অর্জনের জন্য ১৭ বছর যয়সে জুতা পালিশের কাজ করেন। পরবর্তীতে
বাটা স্যু কোম্পানিতে যোগ দেন। দুই বছর পর চাকরি ছেড়ে ডাচ ন্যাশনাল সার্ভিসে যোগ
দেন। তিনি রয়্যাল সিগন্যাল কোরের সার্জেন্ট ছিলেন। ওলন্দাজ বাহিনীর গেরিলা কমাডার
হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে(১৯৩৯-১৯৪৫) অংশ নেন। জার্মানীর সৈন্যদের কাছে গ্রেফতার হন
কিন্তু পরে পালিয়ে গিয়ে জার্মান ফেরত সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দেন।
ঢাকায় বাটা স্যু কোম্পানির
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে ওডারল্যান্ড ১৯৭০ সালের শেষ দিকে প্রথম ঢাকায়
আসেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই কোম্পানি-ম্যানেজার ওডারল্যান্ড
নিজেকে আবিষ্কার করেন নতুন এক যুদ্ধের মুখোমুখি প্রাক্তন-সৈনিক
ওডারল্যান্ডকে। টঙ্গীর বাটা জুতো কারখানায় কর্মরত অবস্থান ১৯৭১ সালের ৫ মার্চ
মেঘনা টেক্সটাইল মিলের সামনে শ্রমিক-জনতার মিছিলে ইপিআর-এর
সদস্যগুলোর গুলিবর্ষণের ঘটনা কাছে থেকে দেখেছেন। মার্চের গণ আন্দোলন,২৫
মার্চ এর অপারেশ সার্চলাইট এবং এর পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর
নির্বিচার হত্যাকান্ড ও নৃশংস বর্বরতা দেখে মর্মাহত হন এবং যুদ্ধে বাংলাদেশকে
সাহায্য করা সিদ্ধান্ত নেন।
অপারেশন সার্চলাইটের সময়
তিনি লুকিয়ে সে রাতের ভয়াবহতার কিছু ছবি তুলে পাঠান আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। আর
এভাবেই তিনি বাংলাদেশিদের প্রাণের বন্ধু হয়ে ওঠেন। শুধু এ দেশের স্বাধীনতার জন্য
আর নিরীহ মানুষকে হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে নিজের মানবিক তাড়নাতেই সর্বোচ্চ ত্যাগ
স্বীকার করে লড়তে থাকেন পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে। আগস্ট মাসের দিকে তিনি
টঙ্গীতে বাটা কোম্পানির ভিতরে গেরিলা প্রশিক্ষ্ণের ব্যবস্থা করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের
খাদ্য-ঔষুধ
ও আশ্রয় দিয়েও সাহায্য করেছেন। টঙ্গী ও তাঁর পাশ্ববর্তী এলাকায় কয়েকটি সফল গেরিলা
হামলার আয়োজক ছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি মুক্তিযুদ্ধে এ বীরোচিত ভূমিকার জন্য
বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত হন। তিনি ডাচ আন্ডারগ্রাউন্ড রেজিসট্যান্স মুভমেন্টের হয়ে
গুপ্তচর হিসেবে কাজ করেন।
বাটা স্যু কোম্পানির
ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে চাকরির সুবাদে বাংলাদেশের যে কোন স্থানে তাঁর ছিল অবাধ
যাতায়াত। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২২ বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট
কর্ণেল সুলতানের সাথে প্রথমে এবং এরপর একে একে সেনাবাহিনীর আরো কয়েকজনের সাঠে শোখয়
জোমীয়ে ফেলেন তিনি। এ সুযোগে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সব ধরনের নিরাপত্তা পাস পেয়ে
যান। অবাধ মেলামেশার সুযোগে সব ধরনের তথ্য, সেনাবাহিনীর তৎপরতা ও পরিকল্পনা গোপনে পাঠাতে
থাকেন মুক্তিযুদ্ধের ২ নম্বর সেক্টর হেডকোয়ার্টারে। বাংলাদেশের পক্ষে
গুপ্তচরবৃত্তি করেন। তিনি পাকিস্তানিদের গোপন সংবাদ সংগ্রহ করা শুরু করলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গেরিলা
কমান্ডার অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে তিনি ২ নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা শাখার
সক্রিয় সদস্যরূপে কয়েকটি গোপন ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়মিত গেরিলা রণকৌশলের
প্রশিক্ষণ দিতেন। কমান্ডো হিসেবে তিনি ছিলেন অস্ত্র,
গোলাবারুদ এবং বিস্ফোরক
বিশেষজ্ঞ। এক পর্যায়ে তিনি নিজেই জীবন বিপন্ন করে যুদ্ধে নেমে পড়েন। তিনি বাঙ্গালি
যোদ্ধাদের নিয়ে টঙ্গী-ভৈরব রেললাইনের ব্রীজ, কালভার্ট
ধ্বংস করে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করতে থাকেন। তাঁর পরিকল্পনায় ও পরিচালনায়
ঢাকা ও এর পাশ্ববর্তী এলাকাগুলোতে বহু অপারেশন সংঘটিত হয়। ওডারল্যান্ড
মুক্তিযুদ্ধে গণযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, পরামর্শ, নগদ অর্থ, চিকিৎসা সামগ্রী,
গরম কাপড় এবং অস্ত্র দিয়ে
সাহায্য করেছেন।
ওডারল্যান্ড সবচেয়ে বড় যে
কাজটি করেছেন আমাদের দেশের জন্য, তা হল গুপ্তচর বা গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করে
পাকিস্তানি বাহিনীর নানান তথ্য মুক্তিবাহিনীকে জোগাড় করে দেওয়া। এই কাজে তাঁর
দক্ষতা, চাতুর্য
ও সাহসিকতা সত্যিই প্রশংসনীয়। পাকিস্তান বাহিনীর ২২ তম বালুচ রেজিমেন্টের
ক্যাপ্টেন সুলতান নেওয়াজের সঙ্গে তিনি কৌশলে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং
এভাবে ঢাকা সেনানিবাসে প্রবেশাধিকার লাভ করেন। পরে তিনি গভর্নর জেনারেল টিক্কা খান
ও রাও ফরমান আলীর সঙ্গেও সু সম্পর্ক ও যোগাযোগ গড়ে তোলেন। তিনি বিদেশি হওয়াতে তাঁর
পক্ষে সেটা সম্ভব হয়েছিল। তিনি জেনারেল নিয়াজীর ‘বিশেষ বন্ধু’ হিসেবে
পাক-বাহিনীর
সদর দফতরে অবাধ যাতায়াতের অনুমতি পান। সেক্টর দুই এর মেজর এটিএম হায়দারের সঙ্গে
তাঁর নিয়মিত যোগাযোগ হত এবং তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর নানা গোপন তথ্য মেজর হায়দারকে
সরবরাহ করতে থাকেন।
যুদ্ধকালে তিনি প্রধান
সেনাপতি এম এ জি ওসমানীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। সে সময় তিনি ঢাকাস্থ অস্ট্রেলিয়ান
ডেপুটি হাইকমিশনের গোপন সহযোগিতা পেতেন। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার পর তিনি
ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং পূর্বতন কর্মস্থলে যোগদান করেন। তিনি ১৯৭৮ সাল
পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থান করে নিজ দেশ অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যান। ১৯৯৮ সালের ৭ মার্চ
প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা ও সনদপত্র বিতরণ
অনুষ্ঠানে ওডারল্যান্ডকে আমন্ত্রন জানানো হয়, কিন্তু অসুস্থ থাকায় আসতে পারেন নি। তিনি বীর
প্রতীক পদকের সম্মানী ১০,০০০ টাকা মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে দান করে
দেন। বাংলাদেশকে তিনি অনেক ভালবাসতেন। ঢাকাস্থ গুলশানের একটি রাস্তার নামকরণ করা
হয় তাঁর নামে।
No comments