শ্যাম মানেকশ || মুক্তিযুদ্ধে বিদেশির অবদান
শ্যাম মানেকশ || মুক্তিযুদ্ধে বিদেশির অবদান
পারস্য বংশোদ্ভুত ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তা ফিল্ড মার্শাল শ্যাম হোরামশিজি প্রেমজি ‘শ্যাম বাহাদুর জামসেদজি মানকেশ।’ ১৯১৪ সালের ৩ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পারস্যের জরথুস্ত্রীয় ধর্মের অনুসারী ছিলেন। শরণার্থী হিসেবে তিনি ভারতে এসেছিলেন। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত ভারতীয় সেনাবাহিনীর চিফ অফ স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি বাংলাদেশ-ভারত যৌথবাহিনীর প্রধান ছিলেন। সেই যুদ্ধে যৌথবাহিনী জয়ী হয়, পাকিস্তান ৯৩ হাজার সৈন্যসহ আত্মসমর্পণ করে। এর মাধ্যমেই পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন দেশের উত্থান ঘটে।
ভারতের মাত্র দুইজন সামরিক
কর্মকর্তা যারা সর্বোচ্চ সামরিক পদবি ফিল্ড মার্শাল অর্জন করেছেন তাদের একজন ছিলেন
শ্যাম মানেকশ। অন্যজন হলেন কোদানদেরা মদপ্পা কারিয়াপ্পা। দীর্ঘ প্রায় ৪ দশকের
সামরিক জীবনে অনেক অর্জন রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধসহ মোট চারটি
যুদ্ধে তিনি অংশ নিয়েছেন। তিনি পদ্মবিভূষণ, পদ্মভূষণ ও মিলিটারি ক্রস পদকে ভূষিত হন।
১৯৩২ সালের ১০ ডিসেম্বর
ভারতের দেরাদুনে প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমির পাইওনিয়ার ক্যাডেটদের একজন
শ্যাম মানেকশ। পরবর্তীতে তিনি ভারতীয় বাহিনীর সেনাপ্রধান হন। তিনি ইন্দো-পাকিস্তান
ওয়ার অফ ১৯৪৭, সিনো-ইন্ডিয়ান ওয়ার,
ইন্দো-পাকিস্তান
ওয়ার অফ ১৯৬৫ প্রভৃতি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়
পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কমান্ডার ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ
খান নিয়াজি। তিনি ৮ মার্চ ১৯৪২ সালে ভারতের বেংগালুরু এ অবস্থিত অফিসার ট্রেনিং
স্কুল থেকে কমিশন লাভ করেন। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। নিয়াজি ২য় বিশ্বযুদ্ধে
বার্মা ক্যাম্পেইনে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি ব্যাটল অফ ইমফল এবং ইন্দো-পাকিস্তানি
ওয়ার অফ ১৯৬৫ এ অংশগ্রহণ করেছিলেন।
মানেকশ এবং নিয়াজি, তারা
উভয়েই ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অফিসার ছিলেন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর তারা পরস্পরের
শত্রুতে পরিণত হন। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে পরস্পরের শত্রু, আর
১৯৭১ সালে সৃষ্টি করেছেন ইতিহাস। একজন্ সেনাপ্রধান অন্যজন আঞ্চলিক কমান্ডার।
১৯৭১ সালের মার্চ-এপ্রিল
মাসেই ভারত্র পাকিস্তানের মাঝে যুদ্ধের আবহ সৃষ্টি হয়েছিল। ভারত বুঝেছিল ১৯৬৫
সালের পর আর একটি যুদ্ধ অনিবার্য। কিন্তু ১৯৭১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ভারত সে
যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি ছিলনা। এপ্রিল মাসে ভারত নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নেয় যে
মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা করা উচিৎ। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ২৮ এপ্রিল কেবিনেট
মিটিং করেন সব মন্ত্রীদের নিয়ে। এখানেই মানেকশ,
ইন্দিরা গান্ধীকে বলেছিলেন
ভারত মাত্র ১৪ টি ট্যাঙ্ক দিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আক্রমণ রচনা করতে পারেনা।
তাছাড়া তখন বর্ষাকাল শুরু হচ্ছে। মানে বাংলাদেশকে তখন বলা হয় “ডিফেন্ডার্স
প্যারাডাইস”। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে
বাকবিতণ্ডার এক পর্যায়ে মানকেশ, নিজের ইউনিফর্মের বেল্ট খুলে চাকরি ছেড়ে দিতে
চেয়েছিলেন। তাই ভারতকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত কনভেনশনাল আক্রমণের অপেক্ষা করতে
হয়েছিল।
ভারত বাহিনীর রণকৌশলগত কিছু
ভুল ছিল শত্রুকে দুর্বল ভাবা এবং শত্রুর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া। এতে করে
প্রাথমিকভাবে তারা ততটা ভূমি যেমন দখল করতে পারেনি,
তাদের ক্যাজুয়ালিটির মাত্রাও
ছিল বেশি। হিলির যুদ্ধে যার প্রকৃষ্ট উদাহারন। হিলির যুদ্ধকে বলা হয় টানা যুদ্ধ, যা
২৩ নভেম্বর শুরু হলেও শেষ হয়েছে ১৮ ডিসেম্বর। ভারতীয়রা ফ্রন্টাল এসোল্ট করেছিল।
পরবর্তীতে ভারতীয়রা তাদের রণকৌশল পরিবর্তন করেছিল।
তাদের রণকৌশলগত ভুল করার
পিছনে প্রধান কারণ ছিল মুক্তি বাহিনীর পরামর্শ আমলে না নিয়ে সাবসিডিয়ারি এক্সিস
ফলো না করে মেইন এক্সিস ফলো করা। ভারতীয় সৈন্যদের প্রধান শক্তি ছিল মুক্তি বাহিনী
ও পপুলার সাপোর্ট, যা পাকিস্তানিদের ছিলো না। যদিও ভারতীয় সৈন্য
প্রথমে ততটা এক্সপ্লয়েট করে নাই। তারা ফ্রেন্টাল এসোল্ট না করে বাইপাস, এনসারকেলমেন্ট
এবং ভার্টিকাল ল্যান্ডিং ইত্যাদি ট্যাক্টিস ফলো করে শত্রুর লাইন অফ কমিউনিকেশন্ন
বন্ধ করে দিতে পারতো। পরবর্তীতে এ কৌশল অবতারণা করেন ল্যাফটেন্যান্ট জেনারেল জে. এফ. আর .জ্যাকব
যিনি মেজর জেনারেল হিসেবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব
স্টাফের দায়িত্ব পালন করেন। জ্যাকব এটার নাম দেন-”
offensive strategy and defensive tactics.” । এর ফলে যুদ্ধ শেষে ভারতীয় বাহিনী মাত্র ২০০০ সৈন্যের জীবনের
বিনিময়ে যুদ্ধে জয় লাভ করে।
পাকিস্তানের প্রধান দুর্বলতা
ছিল, মনোবল।
কারণ ১২০০ কিলোমিটার দূরে এসে তারা মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিল, তাদের
পপুলার সাপোর্ট ছিল না, সৈন্য সংখ্যা ছিল অপ্রতুল এবং এ যুদ্ধের পিছনে
কোনো যৌক্তিক কারণ ছিল না। পাকিস্তানিদের প্রধান কৌশলগত ভুল ছিল পুরো পূর্ব
পাকিস্তান জুড়ে সৈন্য ডেপ্লয় করা। তারা ভেবেছিল ভারতীয়রা শুধু বর্ডার এলাকায় যুদ্ধ
পরিচালনা করবে। তাই তারা তাদের সকল সৈন্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে ডেপ্লয় করেছিল। তাছাড়া
মুক্তি বাহিনীকে শায়েস্তা করার কাজেই ব্যস্ত ছিল। আর এই শায়েস্তার নামে চরম
অত্যাচার শুরু করেছিল। ফলে পপুলার সাপোর্ট ছিল শূন্যের কোঠায়। ভারত পাকিস্তানের
মাঝে সংঘটিত এ যুদ্ধ মাত্র ১৩ দিন ছিল। যাকে বিশ্বের সবচেয়ে কম সময়ের যুদ্ধও বলা
হয়।
জেনারেল মানেকশ এক বক্তৃতায়
নিজেকে জেনারেল নিয়াজির সঙ্গে তুলনা করে বলেছিলেন,
“ there is a thin line between becoming a Field Marshal and being dismissed”। কেননা নিয়াজিকে পাকিস্তানিরা বলতো “টাইগার
নিয়াজি” । ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর, পাকিস্তানি অফিসাররা তাকে “Goat of Bengal” উপাধি দিয়েছিল।
No comments