Adsterra

লিওনিদ ব্রেজনেভ || মুক্তিযুদ্ধে বিদেশির অবদান

লিওনিদ ব্রেজনেভ || মুক্তিযুদ্ধে বিদেশির অবদান

সোভিয়েত ইউনিয়ন কমিউনিস্ট পার্টির মহাসচিব লিওনিদ ব্রেজনেভ ১৯০৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬৪ সাল থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত দেশ পরিচালনা করেন। জোসেফ স্টালিনের পর মহাসচিব হিসেবে সর্বাধিক আঠারো বছর ক্ষমতায় ছিলেন। তাঁর শাসনামলে সোভিয়েত ইউনিয়নের বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তার নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। বহিঃবিশ্বে সোভিয়েত সামরিক বাহিনী প্রেরণই এর মূল কারণ। কিন্তু দেশে অর্থনৈতিক দূরাবস্থা চিহ্নিত না করা, তীব্র অর্থনৈতিক সমস্যাকে গ্রাহ্য না করার প্রেক্ষাপটে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হওয়ার জন্য সমালোচিত হয়েছেন।

      ইউক্রেন এর কামেনস্কোতে এক রুশ শ্রমজীবী পরিবারে ব্রেজনেভ এর জন্ম। খনিশ্রমিক ইলিয়া ইয়াকোভলেভিচ ব্রেজনেভ এবং দেনিসোভানা দম্পতির সন্তান তিনি। জীবনে তিনি ইউক্রেনিয় বা রুশ- কোনো নির্দিষ্ট পরিচয় না দেয়ায় কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাববিহীন অবস্থায় বড় হন। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের পরের বছর কারিগরী শিক্ষা কার্যক্রমে ভূমি জরিপকারক এবং পরবর্তীতে ধাতব বিদ্যায় পড়াশোনা করেন। ১৯৩৫ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন শেষে ধাতব প্রকৌশলী হিসেবে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে লৌহ ও ইস্পাত কারখানায় যোগ দেন। ১৯২৩ সালে কমিউনিস্ট পার্টির যুব সংগঠন কসমোলে যোগ দেন। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন ১৯২৯ সালে। দলীয় কার্যক্রমে তিনি সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৪৬ সালে মেজর জেনারেল পদবি নিয়ে সামরিক বাহিনী থেকে অবসর নেন। ১৯৫২ সালে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন এবং ১৯৬৪ সালে ব্রেজনেভ প্রথম সচিব হিসেবে নিকিতা ক্রুশ্চেভের স্থলাভিষিক্ত হন। নেতা হিসেবে যে কোন সিদ্ধান্ত নেবার পূর্বে সহকর্মীদের সাথে আলোচনা করতেন।

১৯৩৫ থেকে ১৯৩৬ সালের মধ্যে সামরিক বাহিনীতে বাধ্যতামূলকভাবে নিযুক্ত হন এবং ট্যাঙ্ক স্কুলে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন তিনি। রাজনৈতিক কমিশনার হিসেবে ট্যাঙ্ক কারখানায় দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ১৯৩৬ সালের শেষ দিকে দিপ্রোদজারঝিনস্ক মেটালারজিক্যাল টেকনিকাম মহাবিদ্যালয়ের পরিচালক পদে আসীন হন।

       তাঁর সময়ে সোভিয়েত সামরিক খাতে ব্যয়ের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়, যা দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনের প্রায় ৫০%মুজাহেদিনদের কবল থেকে নিম্ন আয়ের দেশ আফগানিস্তানকে রক্ষার চেষ্টায় আফগানিস্তানে সোভিয়েত সৈন্য প্রেরণ, যা তাঁর সর্বশেষ প্রধান সিদ্ধান্ত ছিল। বিংশ শতাব্দীর ষাট এবং সত্তর দশকে সমগ্র বিশ্বে দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়ার প্রভাব ছিল খুব বেশি। স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত ফলাফলে সোভিয়েত রাশিয়া এবং সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

       ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে সোভিয়েত রাশিয়ার কম্যুনিস্ট পার্টির তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল ব্রেজনেভ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেপ্তারের ব্যাপারে জানতে চেয়ে এবং উদ্বেগ প্রকাশ করে চিঠি দেন। একাত্তরের জুন মাসে স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি উচ্চপদস্থ প্রতিনিধিদল সোভিয়েত রাশিয়া, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি ও পূর্ব জার্মানি সফর করেন। এ সফরের পর ৭১ এর জুলাই মাস থেকে পূর্ব ইউরোপের কূটনৈতিক সমর্থন অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যায়। সোভিয়েত রাশিয়ার প্রচেষ্টায় বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের মধ্যে একমাত্র চীন ছাড়া সবাই বাংলাদেশ ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ হয়। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে কয়েকবার যুক্তরাষ্ট্র ও গণচীনের যুদ্ধ বিরতি প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সোভিয়েত রাশিয়ার ভেটো মুক্তিযুদ্ধকে আরও বেগবান এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনে বিশেষ ভূমিকা রাখে।

         বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ক্রমাগত মার খেয়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী যখন নাস্তানাবুদ, ঠিক তখনই পাকিস্তানের বেগতিক অবস্থা দেখে হেনরি কিসিঞ্জার এর পরামর্শে প্রেসিডেন্ট নিক্সন সপ্তম নৌবহরকে ভারত মহাসাগরের দিকে অগ্রসর হতে নির্দেশ দেন। সোভিয়েত রাশিয়ায় নেতৃবৃন্দও নীরব থাকেনি। ভ্লাদিভস্ককে অবস্থানরত পারমানবিক মিসাইলবাহী সোভিয়েত নৌবহরকে প্রশান্ত মহাসাগর হয়ে অতি দ্রুত বঙ্গোপসাগরের মুখে অবস্থান গ্রহণ এবং সপ্তম নৌবহর শক্তি প্রয়োগের চেষ্টা করলে তা প্রতিহত করবার নির্দেশ দেন সোভিয়েত নেতা ব্রেজনেভ। সপ্তম নৌবহর যখন মালাক্কা প্রণালি অতিক্রম করছে ঠিক তখনই ভারত মহাসাগরব্যাপী সোভিয়েত নৌবহরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা প্রস্তুত। এমতাবস্থায় পাকিস্তানের মুরুব্বিরা আর উচ্চবাচ্য করে সন্মুখে অগ্রসর হবার চেষতা করেনি। ঠিক একইভাবে ভারতকে গণচীনের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে সোভিয়েত রাশিয়া চীন সীমান্তে বিশাল পদাতিক বাহিনীর সমাবেশ ঘটায়।

         রাশিয়ার এই নেতা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন বিদেশি বন্ধু ১৯৮২ সালের ১০ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।  

No comments

Powered by Blogger.