Adsterra

আফ্রিকার প্রাচীন জনপদ সুদান কেন যুদ্ধের কবলে?

আফ্রিকার প্রাচীন জনপদ সুদান কেন যুদ্ধের কবলে?

রক্তাক্ত নীলনদের দেশ সুদান।  দশকের পর দশক  ধরে ক্ষমতার হাত বদল, অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যূত্থান, গৃহযুদ্ধে বিপন্ন  এক দেশ।  সহিংসতা ও দাঙ্গা, খুন, সংঘাত সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ ও মাহামারিতে প্রাণ গেছে ৩০ লাখের বেশি মানুষের।  বিদেশী শক্তিগুলোর হস্তক্ষেপজাতিগত বিভেদ ও ভূ-রাজনৈতিক জটিলতা এসব সংঘাতের পিছনের অন্যতম কারণ। কয়েক বছর ধরে আপাত শান্ত থাকার পর আবার জ্বলে উঠেছে সহিংসতার আগুন।  এই লড়াই একদিনে শুরু হয়নি, এর পেছনে আছে দীর্ঘ ইতিহাস।

হাজার বছর ধরে সুদানের উত্তর ভাগে আরব মুসলিমদের বসতি। আর দক্ষিণে কৃষ্ণাঙ্গদের বাস। ষোল শতকে অটোমান সাম্রাজ্য দখল নেয় সুদানের।  মিশরের হাত ঘুরে বিশ শতকের গোড়ায় সুদানের নিয়ন্ত্রণ প্রায় ব্রিটিশরা।  ক্ষমতায় যারাই আসুক বরাবরই উন্নয়নের স্পর্শ পেয়েছে উত্তর সুদান। অবহেলিত থেকে গেছে দক্ষিণ ভাগ। উন্নয়ন  আর ক্ষমতার বৈষম্যের বৈষম্যই এক সময় মহিরুহ   হয়ে উঠে।

১৯৫০ এর দশকে প্রকট হয় সুদানের উত্তর ও দক্ষিণের বিরোধ। ১৯৫৬ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর যে সরকার তৈরি হয় সেখানেও ছিল উত্তরের আরবদের আধিপত্য।  সেই সরকার গোটা দেশে ইসলামিক আইন কায়েমের উদ্যোগ নিলে ফুসে উঠে দক্ষিণ সুদান। বিদ্রোহ রূপ নেয় নৃশংস  গৃহযুদ্ধে।  নৈরাজ্যের সুযোগ নিয়ে  ১৯৫৮ সালে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা নেন জেনারেল ইব্রাহিম আবোদ। সেই থেকে গৃহযুদ্ধ আর সেনা অভ্যুত্থানে নিত্য বন্দি সুদান।

৬ বছরের সেনা শাসন অবসানের পর বেসামরিক সরকার গঠিত হলেও তা খুব সুসংগত হয়নি।  ফলাফল ১৯৬৯ সালে ঘটে আরেক সামরিক অভ্যুত্থান।  ক্ষমতা নেন জেনারেল নিমেরি। আর চালু করেন এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা। ১৯৭২ সালে আদ্দিস আবাবা  চুক্তিতে স্বায়ত্তশাসন পায় দক্ষিণ সুদান। বৈষম্য বিমোচন এর উদ্যোগ নেওয়া হয়।  অবসান হয় সুদানের গৃহযুদ্ধের।

পরের এক দশক বড় কোন বিপর্যয় ছাড়াউ পার করে সুদান।  আশির দশকে এসে আবারো দেশ জুড়ে ইসলামী শাসন কায়েমের প্রয়াস ন্যায় সরকার।  ১৯৮৩ সালে শুরু হয় দ্বিতীয় সুদান-ই গৃহযুদ্ধ। দুই বছর পর আবার সেনা অভ্যুত্থান।  নিমেরির বিদায়ে দেশটির শাসনে আসে সেনাবাহিনী।  ১৯৮৬ সালে সাবিক আল মাহদি  প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেও তিনি বেশিদিন থাকতে পারেননি। ১৯৮৯ সালে ফের সেনা অভ্যুত্থান ক্ষমতায় আসে জেনারেল ওমর আল বসির। এত উলট-পালটের মধ্যে গৃহযুদ্ধ কিন্তু থেমে থাকে নি। প্রাণ ঝরেছে ২০ লাখেরও বেশি মানুষের।  ২০০৫ সালে শান্তি চুক্তির ফলে শেষ হয় গৃহযুদ্ধ।  সরকারের দুই পক্ষের সমান অংশধারিত্বেরপাশাপাশি সিদ্ধান্ত হয় স্বাধীনতা প্রশ্নে ভোট হবে দক্ষিণ সুদানে।

২০১১ সালের সেই ভোটাভুটির মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করে দক্ষিণ সুদান। অনেক রক্ত ঝরিয়ে উত্তর-দক্ষিণ বিরোধ মিটলে ততক্ষণে নতুন সংকট শুরু হয়ে গেছে পশ্চিম সুদানে।  যারা আরেক নাম দারফুর।   সেখানে সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করে। নৃশংস পাল্টা  অভিযানের মধ্য দিয়ে নিজের অনড় অবস্থা জানান দেয় স্বৈরাচারী বশির।  সংঘর্ষটি দ্রুত  পরিণত হয় বড় গৃহযুদ্ধে

এই সময় উত্থান ঘটে মিলিশিয়া বাহিনী র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস বা (RSF)   গৃহযুদ্ধ কবলিত প্রতিবেশী দেশ সাদের  উপর  সুদান এর প্রভাব বিস্তারের জন্য ১৯৮০ দশকের গোড়ায় সংঘটিত করা হয় জানজাওইদ মিলিশিয়ার।  অপরাধের অভিযুক্ত গ্রুপের সদস্যদের নতুন শতকে নতুন ভাবে সংগঠিত করে নাম দেওয়া হয় আরএসএফ। দারফুর বিরোধী মিলিশিয়া গুষ্টিকে লেলিয়ে দেয় ওমর আল বসির। তার এই পৃষ্ঠপোষকতায় দ্রুত উত্থান ঘটে আরএসএফ ও তার প্রধান জেনারেল মোহামেদ হামদান দাগালো-র। সরকারের অনুকম্পা   প্রাপ্ত দাগালো-র পরিবার স্বর্ণ খনি নির্মাণ খাদ ও খামার ব্যবসায়  দ্রুত তাদের প্রভাব বিস্তার করে। যে সম্পদের ব্যবহার করে বড় শক্তিতে পরিণত হয় RSF  একসময় এই দাগালো-ই হয় উঠেন ঘরের শত্রু বিভীষণ।  প্রেসিডেন্ট ওমর আল বসির এর বিরুদ্ধে র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস।

 

২০১৯ সালে সরকার বিরোধী বিক্ষোভে অবসান ঘটে বসিরের ৩ বছরের  স্বৈরশাসন। সামরিক বাহিনী নেতৃত্বাধীন সরকারের উপপ্রধান হন দাগালো। নির্বাচনের মাধ্যমে সামরিক বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর এর প্রতিশ্রুতি  সামরিক- বেসামরিক যৌথ নেতৃত্বে একটি সরকার গঠিত হয়। কিন্তু অন্তর কোন্দল দেখা দিলে ২০২১ সালে অক্টোবর আরও এক অভ্যূত্থান এর  মাধ্যমে সেই সরকার কে ও সরিয়ে দেয়া হয়। এরপর থেকে সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেলদের একটি কাউন্সিলের পরিচালনায় চলছে সুদান। কিন্তু বিভিন্ন ইস্যুতে কাউন্সিলের শিষ্য দুই  সামরিক নেতা জেনারেল আব্দুল ফাততা আল বোরহান  এবং আরএসএফ প্রধান জেনারেল  মোহামেদ হামদান এর মধ্যে তৈরি হয় দ্বন্দ্ব । আগামীতে সুদান কিভাবে পরিচালিত হবে আর ১ লাখ সদস্যের র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স সেনাবাহিনী কিভাবে অন্তর্ভুক্ত হবে, বাহিনীটি কার নির্দেশনা চলবে, এসব প্রশ্নের মতবিরোধ থেকে শুরু  হয় চলমান সহিংসতার। 

সুদানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হওয়ায় অধাধিকার বলে জেনারেল বোরহান দেশটির প্রেসিডেন্ট।  বোরহানের জন্ম সুদানের উত্তর অঞ্চলে। সামান্য সৈনিক হিসেবে কাজ শুরু করে ধীরে ধীরে উপরে উঠেন তিনি। আর দাগালো এসেছেন দারফুর  অঞ্চল থেকে। জন্মসূত্রে দারফুরের  মেহনীয়  জনজাতির সদস্য এইজেনারেল দক্ষিণ সাহারার যাযাবর আরব উপজাতির একজন। মরুর প্রত্যন্ত অঞ্চলে কেটেছে তার শৈশব। স্কুল থেকে ঝরে পড়া মোহামেদ হামদান দাগালো-র উত্থান ঘটে ২০০৭ সালে।

চলমান সংঘাতে উঠে এসেছে ওমর আল বসির এর পুরনো মিত্র রাশিয়ার কুখ্যাত ওয়াগনার গ্রুপের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ।  আরএসএফ-কে অস্ত্র-স্বত্র  দিয়ে সাহায্য করার পাশাপাশি সুদানের স্বর্ণ আর তেলের খনি গুলোতে কাজ করছে  ওয়াগনার  গ্রুপ। ইউরেনিয়াম অনুসন্ধান এবং দারফুর অঞ্চলে ভাড়াটে যোদ্ধা পাঠানোর মত কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত আছে ওয়াগনার। এমনটাই ধাত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর।

হর্ন অফ আফ্রিকার একেবারে দক্ষিণে লোহিত সাগরের নৈকট্য সুদানের আঞ্চলিক গুরুত্বকে সীমাহীন বাড়িয়ে দিয়েছে। দেশটির রাজনৈতিক উত্থান পতন এবং সংঘাতের প্রভাব পড়ে ইথিওপিয়া, সাদ, দক্ষিন সুদানের মত বেশি দেশগুলোর উপর। ভেতরে বাহিরে নানা সমস্যায় জর্জরিত সুদান। কারোরই জানা নেই বছরের পর ধরে চলমান এই সহিংসতা শেষ কোথায়।

No comments

Powered by Blogger.