আফগানিস্তান জয় করা সম্ভব নয় কেন?
আকারে ফ্রান্সের চেয়ে একটু বড় এই আফগানিস্তানের জনসংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার অঙ্গরাজ্যের চেয়েও কম। তারপরেও দেশটি ব্রিটেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো সামরিক পরাশক্তি গুলোর বিরুদ্ধে কিভাবে সফল হলো তা অনেকের কাছেই এক রহস্য। কিন্তু কিভাবে আফগানিস্তান বারবার এসব সামরিক পরাশক্তি গুলোকে রুখে দিয়েছে? আর কেন আফগানিস্তানকে জয় করা সম্ভব নয়? তাই জানার চেষ্টা করব আজকের প্রতিবেদনে।
আফগানিস্তানের এমন দুর্ভেদ্য হয়ে ওঠার প্রথম কারণটাই
প্রগতি। প্রথমে বলে রাখা ভালো, বর্তমান আফগানিস্তানের সীমানা কিন্তু কোনো
ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের কারণে গড়ে ওঠেনি। গত শতকে ইউরোপের বিভিন্ন উপনিবেশিকরা তাদের
ইচ্ছামতো আফগানিস্তানের সীমানা নির্ধারণ করেছে। আফগান জনগোষ্ঠী ও ১৪ টি আলাদা জাতি
গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত। এর মধ্যে উজবেক, তাজিক ও অন্যান্য
সম্প্রদায়ের সদস্যরা আফগানিস্তানের সীমান্ত এলাকায় বসবাস করে। ইউরোপীয়
উপনিবেশিকদের আকাশী মানা এই মানুষগুলোকে একে বারে
প্রভাবিত করে না। যেমন ধরুন পশ্চিম সম্প্রদায়ের দুই-তৃতীয়াংশ পাশের দেশ
পাকিস্তানে। প্রতিবেশি পশ্চিমদের ভিন্ন দেশের নাগরিক বানাবার সিদ্ধান্তটি নিয়েছিল
ব্রিটিশরা। ১৮৯৩ সালে তারা কৃত্রিম এই সীমানা আরোপ করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো আফগান সরকারই এই সীমানার অনুমোদন দেয় নি।
বিষয়টি ইউরোপের পোল্যান্ডকে জার্মানি ও রাশিয়ার মধ্যে দুই ভাগ করে
দেয়ার মত হয়েছে। জার্মানি ও রাশিয়া তাদের অংশ দেয়াল
দিয়ে আটকে দিলেও পোল্যান্ডের মানুষজন ঠিকই তাদের আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের
সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখবে। তাই তারা কখনোই সীমানা মেনে নিবে না। তাছাড়া
আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের এই পশ্চিম অধ্যুষিত অঞ্চলটি যেমন প্রান্তিক, তেমনি পাহাড়-পর্বতে ভরা। দুটো দেশের মধ্যে পারাপারের জন্য এখানে মোট
২৩৫টি পয়েন্ট রয়েছে। তাই পাকিস্তানের পক্ষে সীমান্ত এলাকার নিয়মিত দখল দেওয়া
সম্ভব হচ্ছে না। সব মিলিয়ে পরিস্থিতিটা বিদ্রোহীদের জন্য এক অভয় আরণ্য সৃষ্টি
করেছিল। আফগানিস্তানে হামলা চালানোর পর তারা সীমানা পাড়ি দিয়ে অনায়াসে
পাকিস্থানে বন্ধুত্বপূর্ণ এলাকায় আশ্রয় নিতে পারে। এসব কারণে পাকিস্তান
আফগানিস্তান সীমানাকে অনেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক সীমানা হিসেবে বর্ণনা করে।
পরিস্থিতি মোকাবেলায় ২০২১ সালের জুন
মাসে এই সীমানাজুড়ে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ শেষ করে
পাকিস্তান। এই সময়ে সীমান্ত পারাপারের পয়েন্ট ও ২৫০ থেকে কমিয়ে ১৬ টিতে
নামিয়ে নেয়া হয়। এছাড়া আফগানিস্তানে আরেকটা ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য
দুর্ভেদ্য করে তুলেছে। মানচিত্র দেখলে বুঝতে পারবেন আফগানিস্তান পুরোপুরি স্থল
ভূমিতে আটকানো একটি দেশ। অর্থাৎ এখানে সেনা অভিযান চালাতে আপনার আফগানিস্তানের
সীমান্ত সংলগ্ন ছয়টি দেশের মধ্যে অন্তত একটি বারে
দিতে হবে। এই ছয়টি দেশ হলো ইরান, তুর্কেমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, চীন
ও পাকিস্তান। এ মানচিত্র থেকে আফগানিস্তানের আরেকটি বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হয়ে উঠে।
পৃথিবীর উচ্চতম হিন্দুকুশ পর্বতমালা আফগানিস্তানের বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। প্রত্নতাত্ত্বিকরা দেশটি শতকরা
৭৫ ভাগ এলাকাকে পার্বত্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এর মধ্যে শর্করা ৫০ ভাগ এলাকার
গড় উচ্চতা ২ হাজার মিটার বা ২ কিলোমিটারের বেশি।
পর্বত সংকল এই স্থলভাগের কারণে বিভিন্ন বিদেশী শত্রুর আফগানিস্তানে প্রবেশ যেমন
কঠিন তেমন অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ এবং পূর্ণ পরিবহনের কাজ। উঁচু পর্বতমালায় ঘেরা এক
একটি জনপথ হাজার হাজার বছর ধরে বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, সমাজ ও শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। এসব কারণে আফগানিস্তানে কেন্দ্রীয়
শাসন প্রায় কখনই তেমন সফল বা শক্তিশালী হয় না। আফগানিস্তানের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখবেন, তথাকথিত জাতীয় ঐক্যমত
সরকার এ দেশে শুধু বিদেশি সামরিক শক্তির সরাসরি হস্তক্ষেপই প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব
হয়েছে। ব্রিটিশদের ক্ষেত্রে যেমন সোভিয়েত বা
সম্প্রীতি মার্কিনীয়দের প্রতি এমনটাই ঘটেছে। এক হিসেবে
তাই বিংশ শতাব্দীর আফগানিস্তানের চেহারা অনেকটাই দশম শতকে ইউরোপের হলি রোমান সম্রাজ্যের মত ছিল বলা যায়। ঐ সময় ইউরোপের বিস্তীর্ণ
এলাকা জুড়ে হোলির রোমান সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। এই সাম্রাজ্যের শাসক কাগজে-কলমে
বিভিন্ন অঞ্চলের রাজা ও জমিদারদের উপর ছুরি ঘুরাতেন। কিন্তু বাস্তবে নিয়ন্ত্রণ ছিল
নামের মাত্র। যুদ্ধের সময় অধিনস্ত রাজাদের কাছ থেকে সেনা সহায়তা পেতেন সম্রাট।
আর শান্তির সময় বড়জোর কিছু খাজনা আসতো
সম্রাটের কোষাগারে। আফগানিস্তারে
কেন্দ্রীয় সরকার কাগজে কলমে শুধু পুরো দেশের
নিয়ন্ত্রণ করে। কার্যতর রাজধানী কাবুল এবং তার উপকণ্ঠ এলাকায় কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকলেও
দুর্গম পর্বতে ঘেরা উপত্যকা গুলো স্থানীয় গোত্র প্রধান সমাজপতিদের ইচ্ছাতে
পরিচালিত হয়।
আফগানিস্তানের উত্তর ও পশ্চিম দিকে তাজিক ও উজবেক অধ্যুষিত
অঞ্চলের
তুলনায় দক্ষিণ ও পূর্ব সীমাং সংলগ্ন প্রতিবেশী
পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম পশতুন অধ্যুষিত এলাকায় এই
ধারার প্রভাব বেশি স্পষ্ট। প্রতিবেশি পাকিস্তানের
উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত এলাকাটিও পশতুন অধ্যুষিত। যে কোন যুদ্ধে পশতুন গেরিলারা
প্রয়োজন অনুযায়ী পিছু হটে পাকিস্তানে চলে যেতে পারে। সেখানে নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করে গেরিলা বাহিনী আবার আফগানিস্তানে
যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। সরাসরি পাকিস্তানের হস্তক্ষেপ ও
সহায়তা ছাড়া এই পরিস্থিতি মোকাবেলা সম্ভব নয়। ভূ- রাজনৈতিক কারণে পাকিস্তান কখনো
কখনো এই সহায়তা দিলেও অধিকাংশ সময় অসম্মতি জানিয়েছে ইসলামাবাদ।
যেসব কারণে আফগানিস্তানে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে দেশের প্রান্তিক এলাকায় প্রভাব বিস্তার সম্ভব হয় না, সে কারণ গুলো বিদেশি সামরিক শক্তিদের ব্যর্থতাতেও রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এই কারণগুলোর মধ্যে পার্বত্য স্থলভাগের পাশাপাশি যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব ও অন্যতম। আফগানিস্তানের অধিকাংশ অঞ্চলে যাতায়াতের পথ গুলো যেমন সরু তেমনি দুর্গম। এই পথ গুলো অতিক্রমের সময় আক্রমণকারী বাহিনীর উপর এম্বুস করা যায় খুব সহজেই। তাই এসব এলাকায় প্রতিরক্ষা বাহিনী অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক অবস্থায় থাকে। সোভিয়েত সেনা অভিযানের সময় আফগান মুজাহিদিন বাহিনী সদস্যরা এই সরু পথে চলাচলকারী সোভিয়েত বহরের উপর চোরাগোপ্তা হামলা চালাতো। প্রতিপক্ষ পাল্টা গুলি ছোরা শুরু করলে মুজাহিদিনরা পর্বতের গায়ে দুর্গম সব গুহায় আশ্রয় নিতো। এভাবে সোভিয়েত পুরো ৯ বছর পাকিস্তান সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থিত অঞ্চলটি বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল মুজাহিদদিন বাহিনী। একবিংশ শতাব্দীতে মার্কিন সেনা অভিযানের সময় হিন্দু কুস পর্বত মালার মাঝে অবস্থিত খাইবার পাস গিরি পথটি তালেবান যোদ্ধাদের নিয়মিত হামলার লক্ষ্যে পরিণত হয়। হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী এই গিরিপথ ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বাহিনীর শতকরা আশি ভাগ রসত সরবরাহ করা হতো। ২০০৯ সালে তালেবান বাহিনীর এম এম্বুসে এই পথের একটি সেতু ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে পুরা খাইবারপাস বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে গত শতকে পুরো
আফগানিস্তান ঘিরে একটি সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নেয় দেশটির সরকার। কিন্তু পরবর্তী
সোভিয়েত আগ্রাসন
এবং অব্যাহত গৃহযুদ্ধে সড়কটির অবস্থা মুমূর্ষু বললেক কম বলা হবে।
২০০১ সালে মার্কিন আগ্রাসন শুরুর সময় পুরো আফগানিস্তানে
ঢালাই করা পাকা রাস্তার পরিমাণ ছিল মাত্র ৫০ কিলোমিটার। সুবিধার জন্য আকারে
আফগানিস্তানের সমান দেশ ফ্রান্সে পাকা রাস্তার পরিমাণ ১১ লাখ কিলোমিটার এর বেশি।
সেনা অভিযানের শুরুর পর যাতায়াত ব্যবস্থা সুগম করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র পাকা
রাস্তা নির্মাণের চেষ্টা করে। কিন্তু রুক্ষ আবহাওয়া, প্রতিকূলে
স্থলভাগ এবং স্থানীয়দের চোরা চোপ হামলার কারণে সেই
নির্মাণ কাজের খরচ আকাশে গিয়ে উঠে। শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও আফগানিস্তানের কিছু
এলাকায় প্রতি কিলোমিটার পাকা রাস্তা নির্মাণে যুক্তরাষ্ট্রের খরচ হয়েছে ৫০ লাখ
ডলার। যে দেশের সাধারণ মানুষের গড় বার্ষিক রোজকার
মাত্র ৫০০ ডলার, সেখানে এই অর্থ খরচ করে রাস্তা নির্মাণের
প্রশ্নই আসে না। নির্ভরশীল যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে আফগানিস্তানের দুর্গম
পার্বত্য এলাকাগুলোয় বিদ্রোহ যোদ্ধারা খুব সহজেই শক্ত ঘাঁটি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। যার বিপরীতে
বিদেশে আক্রমণকারী বাহিনীর পক্ষে সেনা ও রসত সরবরাহ ভীষণ বিপজ্জনক হয়ে উঠে।
এই কারণগুলোর সম্মিলিত প্রভাবে আফগানিস্তানে সেনা অভিযান
চালাতে গিয়ে বার বার শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে ব্রিটেন, সোভিয়েত
ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশ্বের বৃহত্তম সামরিক পরা শক্তিগুলো।
বিশেষ করে আক্রমণকারী বাহিনী আফগানিস্তান দখল করে নিলেও সেখানে বিদ্রোহী যোদ্ধাদের
আধিপত্য কখনোই পুরোপুরি নির্ভর করা সম্ভব হয়নি। তাই
আফগানিস্তান দখলে সফল হলেও আক্ষরিক অর্থে কখনো দেশটিকে জয় করতে পারেনি তারা।
বরং স্থানীয় গেরিলা বাহিনীর এই চোরাগোপ্তা হামলার মুখে নিয়মিত নাকানি- চোবানি খেয়েছে অপেক্ষাকৃত বেশি প্রশিক্ষিত
এবং ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হামলাকারীরা। অব্যাহত সেই
প্রতিরোধের মুখে প্রতিবারই শেষ পর্যন্ত মাথা নিচু করে আফগানিস্তান ছাড়তে বাধ্য
হয়েছে বিদেশি হানাদাররা।
No comments