সিডনি শেনবার্গ || মুক্তিযুদ্ধে বিদেশির অবদান
সিডনি শেনবার্গ || মুক্তিযুদ্ধে বিদেশির অবদান
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে একান্তভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন
সিডনি শেনবার্গ। বয়স তখন তার মাত্র সাইত্রিশ বছর। সাড়ে
সাতকোটি বাঙ্গালিকে দাবিয়ে রাখতে পাকিস্তানি দখলদার হানাদার বাহিনীর নৃশংসতা, বর্বরতা, নির্মমতা
সর্বোপরি গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন তিনি। আর
সেই দৃশ্যগুলো বিশ্বমানবের কাছে তুলে ধরেছিলেন তার লেখনীর মাধ্যমে। আর
সেইসব ভাষ্য বিশ্ববাসীকে শুধু নাড়া দেয়নি,
মুক্তিকামী বাঙ্গালির প্রতি সহমর্মিতা জাগিয়ে তুলেছিল। হানাদারদের
রক্তচক্ষু ও বুলেট বেয়নেটকে উপেক্ষা করে সাহস ও নির্ভীকতার সঙ্গে তিনি তুলে
ধরেছিলেন বাস্তব চিত্র। বাঙ্গালির সশস্ত্র লড়াইয়ে তিনি ছিলেন সহযোগী, সহমর্মী। বাংলার
মাটি, বাংলার
জল যখন রক্ত গঙ্গায় ভাসছিল,
তিনি সেই রক্তাক্ত দৃশ্যাবলী বিশ্ব বিবেকের দরবারে তুলে ধরেছিলেন সত্যনিষ্ঠ
ভাষায়। বিশ্ববিবেক সক্রিয় হয়েছিল গণহত্যার বিরুদ্ধে, বাঙ্গালির
স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে তার প্রতিবেদন ইতিহাসের দলিল। বাংলাদেশের
মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে তিনি অনন্য,
চিরস্মরণীয়। ১৯৭১ সালের মার্চে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে এসেছিলেন ঢাকায়
সংবাদ সংগ্রহে। মার্কিন যুবকটি তখন নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার দিল্লু
ব্যুরোতে কর্মরত বৈদেশিক সংবাদদাতার দায়িত্বে। পচিশে
মার্চের কালরাত স্বচক্ষে দেখেছিলেন।
সিডনি
শেনবার্গ ১৯৩৪ সালের ১৭ই জানুয়ারি আমেরিকার ক্লিনটন মাসাচুয়েটসে জন্মগ্রহণ করেন। যুদ্ধকালীন
সময়ে মুক্তিযুদ্ধের উপর অসংখ্য খণ্ড খণ্ড প্রতিবেদন পাঠান যার অধিকাংশ ছিল
শরণার্থী বিষয়ক। তাঁর প্রতিবেদন থেকে পুরো বিশ্ব জানতে পারে পাক বাহিনীর
নির্মম হত্যাযজ্ঞ এবং ভারতে অবস্থিত শরণার্থীদের অবস্থা।
পাকিস্তানি
দখলদার বাহিনীর ‘অপারেশন
সার্চ লাইট’ নামক
গণহত্যার সেই অভিযান সিডনি শেনবার্গের ভেতরে আলোড়ন তুলেছিল। হত্যাযজ্ঞের
সূচনা যখন, তখন
তিনি আরও পঁয়ত্রিশ জন বিদেশী সাংবাদিকদের সাথে ঢাকায় অবস্থান করেছিলেন। সে
রাতে হোটেলের ছাদ ও জানালা থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন নৃশংসতার দৃশ্যপট। হোটেল
ইন্টারকন্টিনেন্টালে আটকে রেখে পরদিন বিমানে সব বিদেশি সাংবাদিককে পাঠিয়ে দেয়া হয়
দেশের বাহিরে। শেনবার্গও তাদের একজন ছিলেন। সেই
কালরাতের ভয়াবহতা ও নৃশংসতা তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। দিল্লি
পৌঁছেই তিনি প্রতিবেদন পাঠান নিয়ইয়র্ক টাইমসে। রাতভর
ঘন্টায় ঘন্টায় কি ঘটেছে,
সেই ধারাবর্ণনা তিনি তুলে ধরেছেন। দিল্লি থেকে
একাদিক্রমে রিপোর্ট পাঠিয়েছেন নানা সূত্র থেকে তথ্য নিয়ে। ‘যে ধর্মের
আঠা দিয়ে পাকিস্তানের দুই অংশ একত্রে ছিল;
তা যে আর অটুট থাকছেনা’,
তা উল্লেখ করে চার এপ্রিল পাঠানো প্রতিবেদনে লিখেছিলেন, হয়ত এজন্য
দীর্ঘ সময় লাগতে পারে কিন্তু বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের সাম্প্রতিক উত্থান ও পাকিস্তান
বাহিনীর আক্রমণের বর্বরতার যারা সাক্ষী,
তারা কেউ এই বিষয়ে আর সন্দেহ পোষণ করেন না।
ঢাকা
থেকে বহিষ্কৃত হলেও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে যাননি। বারবার
ফিরে আসেন সীমান্ত এলাকায়। কখনও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ঢুকে পড়েন মুক্তাঞ্চলে, প্রত্যক্ষ
করেন যুদ্ধ অপারেশন, ঘুরে
দেখেন শরণার্থী শিবিরগুলো। জুন মাসে আবার ঢাকায় আসেন। কিন্তু
তাঁর পাঠানো প্রতিবেদনে ক্ষুব্ধ হয়ে হানাদাররা তাকে আবার বের করে দেন। ১৬
ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর সঙ্গে তিনি যশোর সীমান্ত হয়ে ঢাকায় প্রবেশ
করেন। বাঙ্গালির বিজয়ের সাক্ষী ছিলেন তিনি। যুদ্ধের
পর সারাদেশ ঘুরে তিনি তথ্য সংগ্রহ করে লিখেছিলেন শহিদের সংখ্যা ত্রিশ লাখের বেশিই
হবে। তাঁর পঁয়ত্রিশটি রিপোর্ট নিয়ে ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হয় গ্রন্থ ‘ডেটলাইন
বাংলাদেশঃ নাইনটিন সেভেনটি ওয়ান।’
১৯৬০
সাল থেকে তরুণ রিপোর্টার হিসেবে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় শেনবার্গ কর্মজীবন শুরু
করেন।
দক্ষিণ এশিয়ায় তাঁর কাজ নিয়ে টাইমস কেবল একটি বাক্য খরচ করেছেঃ ‘ তিনি ১৯৭১
সালে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের ১৩ দিনের যুদ্ধ কভার করেছেন।’ ভিয়েতনাম ও
কম্বোডিয়া যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে ১৯৭৫ সালে তিনি প্রচুর প্রতিবেদন লিখেছেন, সেজন্য
পুলিতজার পুরষ্কারও পেয়েছেন। ২০১৩ সালে শেনবার্গ নমপেনে গিয়েছিলেন যুদ্ধাপরাধ
ট্রাইব্যুনালে খেমারুজের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে। মানবতাবাদী
শেনবার্গ বিরাশি বছর বয়সে ২০১৬ সালে মারা যান।
বাংলাদেশের
স্বাধীনতা সংগ্রামে
ভারত সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে সহায়তা করেছিল। তিনি
পত্রিকার সত্য বিষয়গুলো একের পর এক তুলে ধরেন। এতে
পাকিস্তানি ও ভারতীয় উভয় কর্তৃপক্ষই ক্ষুদ্ধ হয়। পাকিস্তান
তাদের সহিংসতা দমন আড়াল করতে চাইছিল,
আর ভারতীয়রা বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তাদের সমর্থন পুরো বিশ্বকে
জানাতে চাইছিল না। শেনবার্গ কাউকেই ছাড়ছিলেন না।
পাকিস্তান
ও বাংলাদেশ উভয় দেশেই মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ,
ফলে ধর্ম দাঁড়িয়ে যায় জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু
ভারতের ঘনিষ্ঠ অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে বসবাসরত সংখ্যালঘু হিন্দুরা
তীব্র আক্রমণের নিশানায় পরিণত হন। শেনবার্গ স্মৃতিচারণে বলেছিলেন পাকিস্তানিরা হিন্দুদের ঘর
আলাদা করেছিল। হিন্দুদের দোকানের উপর হলুদ রঙ দিয়ে ‘এইচ’ অক্ষরটি এঁকে
দিয়েছিল। পাকিস্তানি সেনারা এসে চিৎকার করে জানতে চাইত, ‘এখানে কোনো
হিন্দু আছে?’ এবং
হিন্দুদের পেলে সেনারা তাদের হত্যা করত।
বাংলাদেশের
জন্য শেনবার্গের অবদান চোখে দেখা কঠিন। তাঁর
প্রতিবেদনিগুলো নিপীড়িত বাংলাদেশীদের কণ্ঠকে বিশ্বের মানুষের কাছে পৌছে দিয়েছে। বাংলাদেশের
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে শেনবার্গের ৩৬টি প্রতিবেদন রয়েছে। তাঁর
অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধের বিদেশি বন্ধু হিসেবে সম্মাননা দেয়ার
জন্য ঢাকায় আমন্ত্রণ জানান। অসুস্থতার কারণে তিনি আসতে পারেন নি। পাকিস্তানি
সেনাদের সহায়তাকারি বাংলাদেশিদের বিচারকাজেও শেনবার্গের প্রতিবেদনগুলো ব্যবহৃত
হয়েছে। বাংলাদেশ কখনো তাকে ভুলবেনা। তিনি
বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের অংশ এবং যত দিন ইতিহাস থাকবে, ততদিন তিনি
জীবিত থাকবেন।
No comments