মুসলমানদের পবিত্রস্থান জেরুজালেমের হাত বদলের ইতিহাস
পৃথিবীর মধ্যে
নির্মম হত্যাযজ্ঞ রক্তপাতের জন্য পরিচিত এক রাষ্ট্রের নাম ইসরাইল। মধ্যপ্রাচ্যের
মুসলিম দেশগুলোকে নিয়ন্ত্রণ এবং বৃহৎ এক রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে
ইহুদিদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছিল। কৌশলে জন্ম দেওয়া হয়েছিল ইসরাইল রাষ্ট্রের।মুসলিম অধ্যুষিত
ভূখণ্ডের একবারে কেন্দ্রে ইহুদিদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠান করার পিছনে যে
সুদূর প্রসারী অশুভ লক্ষ্য কাজ করেছিল তা এখন আর ঘোলাটে নয়। সাড়ে ছয় হাজার
বছরের পুরনো নগরী জেরুজালেম। যার অর্থ শান্তির শহর। দুর্ভাগ্যবশত নগরটি সবসময়ও
দুটি পরাশক্তির সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত ছিল। ব্রোঞ্জ যুগে এই জনপদকে কেন্দ্র করে
যুদ্ধ হয়েছে মিশরীয় ওহিট্রেট সাম্রাজ্যের মধ্যে। লৌহ যুগের পার্শিয়ান ও রোমান
সাম্রাজ্যের মধ্যে, মধ্যযুগে অটোম্যান ও বায়জিনটেন সাম্রাজ্যের মধ্যে কয়েক দফা হাত বদল
হয়েছে এ শহরের মালিকানা। পৃথিবীর অন্যতম পবিত্র নগরী হিসেবে পরিচিত হলেও
নিয়ন্ত্রণের অধিকার নিয়ে আছে নানা বিতর্ক, দখল,আছে ধংসের রক্তক্ষয়ী ইতিহাস। মধ্য প্রাচ্যের ভূ-মধ্য সাগর ও মৃত সাগরের
মধ্যবর্তী যোধায়ান পর্বতের মাধ্যমীতে অবস্থান পবিত্র নগরী জেরুজালেমের। একই সাথে
ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী এই নগরী প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন জাতি ও শাসকদের দৃষ্টি
আকর্ষণ করেছে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্পর্শকাতর
শহর এটি। ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় নাম লেখানো ওটস সিটি খ্যাত শহরটিতে মুসলিম,
ইহুদি, খ্রিস্টান ও আর্মেনিয়দের বাস। ঐতিহাসিক
প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে ৪৫০০ থেকে ৩৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মাঝামাঝি সময়ে অর্থাৎ
প্রাচীন ব্রোঞ্জ যুগে প্রথম বসতি স্থাপন শুরু করে জেরুজালালে। ১০০০
খ্রিস্টপূর্বাব্দে কিং ডেভিড বা হযরত দাউদ আলাইহি ওয়াসাল্লাম পবিত্র এই ভূমিতে
ইজরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। যা ছিল প্রথম ইসলামিক রাষ্ট্র এবং জেরুজালেমকে সেই
ইসলামিক রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। তার ইন্তেকালের পর পুত্র হযরত
সোলায়মান আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইজরাইলের সিংহাসনে বসেন। তিনি প্রথম সেখানে পবিত্র
প্রার্থনালয় স্থাপন করেন। হযরত দাউদ ও সুলাইমানের শাসনকাল বনী ইসরাঈলদের জন্য ছিল
একটি সোনালিযুগ। হযরত সুলাইমান আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের পর ইজরাইল দুইটি
রাষ্ট্রে বিভক্ত হয় এবং ধীরে ধীরে এর প্রভাব ও ক্ষমতা কমতে থাকে।
ইহুদের পবিত্র
ধর্মগ্রন্থ তাওরাতে উল্লেখিত বিধান পরিবর্তন ও পবিত্র ভূমির উত্তরাধিকার পাওয়ার
শর্ত ভঙ্গে ফলে খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৭ সালে নেভুচদ নিজাবীর নেতৃত্বে ব্যবিলনীয়রা
জেরুজালেম দখল করেন। পুরিয়ে দেয় গোটা শহর। শত শত ইহুদি অধিবাসীদের হত্যা করে।
ধ্বংস করেন সোলামান (আঃ) এর নির্মাণ করা মসজিদ আর ক্রীতদাস বানিয়ে ব্যাবিলিয়নে
নিয়ে যায় ইহুদিদের। প্রায় ১০০ বছর পর পার্সিয়ান রাজা সাইরান ব্যাবেলিয়ন
সাম্রাজ্যকে পরাজিত করে পুরো অঞ্চল দখল করে নেয়। তিনি বনি ইসরাইলদের মুক্ত করে
পবিত্র ভূমিতে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেন। ৩৩২ খ্রিস্টাপূর্ব আলেকজান্ডার দি গ্রেট
জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ নেয়। পরে আবারো রোমানদের আক্রমণে জেরুজালেম থেকে বিতাড়িত
ইহুরা। বিপর্যগ্রস্ত হয়ে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং নির্বাসিত জীবন
যাপন শুরু করে। পরবর্তীতে কয়েক শত বছর ধরে একেক সময় একেক জাতি গোষ্ঠীর শহরকে
নিয়ন্ত্রণ করে এদের মধ্যে আরব, ফ্যাটিনেট, তুর্কি ও মুসলিমরা ছিল
উল্লেখযোগ্য। সপ্তম শতাব্দীতে মুসলমানরা জেরুজালেম জয়ের পর থেকে মুসলমানদের অধীনে
থাকে। ১৫১৬ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত অটোম্যান সাম্রাজ্যের দ্বারা শাসিত হয়
জেরুজালেম ও মধ্যপ্রাচ্য
প্রথম
বিশ্বযুদ্ধের পর ফিলিস্তিন ও জেরুজালেম দখলে নেয় গ্রেট ব্রিটেন। ১৯১৭ ফিলিস্তিনে
ইহুদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনের ঘোষনা দেন ব্রিটেন। এরপর বিপুল সংখ্যক ইহুদি
সেখানে বসবাস স্থাপন করে। ১৯১৮ সালে সেখানে ইহুদের সংখ্যা ছিল ২০ হাজার।
ব্রিটিশদের সহযোগিতায় ১৯২৩ সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৫ হাজারে। পাশ্চাত্যে অর্থসহতায়
ভুক্ত বাহিনী গঠন করে তারা। যদি দখল করতে থাকে ইহুদীরা আর হারাতে থাকে ফিলিস্তিনিরা
এ শহর এর আশপাশের এলাকাগুলো ১৯৪৮ সালে ইসরাইলের স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত ব্রিটিশদের
ইশারায় চলতে থাকে। ততদিনে ইহুদিদের সংখ্যা ছাড়ায় সাড়ে ছয় লাখ। ইসরাইল রাষ্ট্র
প্রতিষ্ঠার প্রথম ২০ বছরের মধ্যে জেরুজালেম ভাগাভাগি হয়ে যায়। এর পশ্চিম অংশ
শাসন করে ইসরাইল, আর পূর্বাঞ্চল চলে যায় জর্ডানের নিয়ন্ত্রণে। ১৯৬৭ সালে ৬ দিনে যুদ্ধের পর
আরবদের হটিয়ে জেরুজালেম দখল করে নেয় ইসরাইল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগেই এই
নগরীতে মোট ৫৩ বার আক্রমণ করা হয়েছে, এর মালিকানা হাত বদল
হয়েছে ৪৪ বার। আর শক্র পক্ষের গোলাঘাতে পবিত্র এ শহরের অধিকাংশ স্থাপনা বিধ্বস্ত
হয়েছে ২৩ বার। গত ২০০০ বছরে অন্তত দুইবার শহরটিকে একেবারে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া
ও মত ঘটনা ঘটেছে
মধ্যপ্রাচ্যের
জেরুজালেমের চেয়ে পুরনো জনপদের অস্তিত্ব থাকলেও এমন অব্যাহত রক্তপাতের
বিভীষিকাময় অতীত বর্তমানে আর কোনো শহরে নেই।
No comments