Adsterra

সাইমন ড্রিং || মুক্তিযুদ্ধে বিদেশির অবদান

সাইমন ড্রিং || মুক্তিযুদ্ধে বিদেশির অবদান

সাইমন ড্রিং || মুক্তিযুদ্ধে বিদেশির অবদান


কলম আর ক্যামেরা হাতে নিজের জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে নিরীহ বাংলাদেশীদের পাশে এসে দাড়িয়েছিলেন সাংবাদিক সায়মন ড্রিংএকাত্তর সালে সাইমন ড্রিং এর বয়স ছিল মাত্র ২৭ বছরতিনি তখন নামকরা পত্রিকা দেইলি টেলিগ্রাফের সাংবাদিকঅন্যদিকে তখন আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পাকিস্তানি সামরিক সরকার ২৫ মার্চ বিশ্বের বড় বড় সংবাদ মাধ্যমগুলোর ৪০ সাংবাদিককে বাংলাদেশে আসার অনুমতি দিয়েছেসেই সুযোগে টেলিগ্রাফের সাংবাদিক হিসেবে আসেন সাইমন ড্রিং

    ২৫ শে মার্চের সেই কালো রাতে পাক হানাদার বাহিনী হত্যাযজ্ঞ শুরু করার প্রাক্কালে ঢাকায় অবস্থানকারী সব বিদেশি সাংবাদিকদের তৎকালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বন্দি করে রাখেপরদিন সবাইকে বিমান বন্দরে নিয়ে তুলে দেওয়া হয় বিমানেউদ্দেশ্য ঢাকাকে বিদেশি সাংবাদিক শূন্য করা, যাতে এদেশে সংঘটিত গণহত্যার খবর বহির্বিশ্বে না পৌঁছায়এক সময় সাংবাদিকদের জন্য অবস্থা প্রতিকূলে চলে গেলে তিনি দেশত্যাগ না করে লুকিয়ে থাকেন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালেমানবতার বিরুদ্ধে জঘন্যতম অপরাধ সংঘটিত হতে দেখে নির্লিপ্ত থাকতে পারেননি সাইমন ড্রিং

    সামরিক জান্তার নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে তিনি ২৭ তারিখে পাকিস্তানি বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে আসেন শহরেহোটেল কর্মচারিদের সহযোগিতায় ছোট্ট একটি মোটরযানে করে ঘুরে বেড়ান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল, রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাক এবং ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকাসমগ্র ঢাকা বুকে তখন হত্যা, ধ্বংস আর লুটপাটের চিহ্নপর্যাপ্ত ছবি আর প্রত্যক্ষ ছবিগুলো নিয়ে তিনি পালিতে চলে গেলেন ব্যাংককেআর সেখান থেকে প্রকাশ করলেনট্যাঙ্কস ক্রাশ রিভ্লট ইন পাকিস্তানবিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরলেন হানাদার বাহিনীর জঘন্য ও নৃশংসতার বিবরণবিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন নির্মম বাস্তবতার দিকেতাঁর পাঠানো খবরেই নড়েচড়ে বসলো পুরো বিশ্বকলম আর ক্যামেরা হাতে নিজের জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে নিরীহ বাংলাদেশীদের পাশে এসে দাড়িয়েছিলেন সাংবাদিক সাইমন ড্রিং 

   সাইমন ড্রিং এর জন্ম ১১ জানুয়ারি,১৯৪৫ সালে ইংল্যান্ডের নরফোকের ফাকেনহাম নামক একটি ছোট্ট শহরেতিনি কিংস লিন টেকনিক্যাল কলেজে অধ্যয়ন করেন১৬ বছর বয়সে তিনি গৃহত্যাগ করেন১৯৬২ সালে বিশ্ব ভ্রমণের অংশ হিসেবে ভারত ভ্রমণ করেন১৭ বছর বয়সে প্রথম চাকুরিতে যোগদান করেন১৯৬৩ সালে থাইল্যান্ডের ব্যংকক ওয়ার্ল্ড সংবাদপত্রেপ্রুফ রিডার’ (সম্পাদনা সহকারী) হিসেবে কাজ করেন১৯৬৪ সালে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত নিউইয়র্ক টাইমসের স্ট্রিংগার হিসেবে কাজ করেন লাওস থেকেসে বছরে ভিয়েতনাম ভ্রমণ করেনসেখানে বার্তা সংস্থা রয়টার্স যুদ্ধ বিষয়ক সংবাদ প্রতিনিধি হিসেবে যুক্ত ছিলেনএর মাধ্যমেই তিনি রয়টার্সের সর্বকনিষ্ঠ বৈদেশিক সংবাদদাতা হিসেবে ইতিহাসের পাতায় ঠাই করে নেন

  তিনি একজন  আন্তর্জাতিক পুরষ্কার বিজয়ী বিদেশি সংবাদদাতা, টেলিভিশন উপস্থাপক এবং প্রতিবেদন নির্মাতাতিনি বিশ্বখ্যাত সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের বৈদেশিক প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বের অনেক স্থান ভ্রমণ করে তাজা ও গুরুত্বপূর্ণ খবর পরিবেশনের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হনএছাড়াও তিনি লন্ডন ভিত্তিক দ্যা ডেইলি টেলিগ্রাফ, বিবিসি টেলিভিশন এবং রেডিও সংবাদ ও চলতি ঘটনা তুলে ধরার লক্ষ্যে অনবরত কাজ করেছেন

    ১৯৭০ এবং ১৯৮০ এর পুরো দশক জুড়ে তিনি ডেইলি টেলিগ্রাফ সংবাদপত্র এবং বিবিসি টেলিভিশন নিউজের বৈদেশিক সংবাদদাতা হিসেবে পুরো পৃথিবীতে কর্মরত ছিলেনঐ সময়ে তিনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো থেকে প্রতিবেদন পাঠাতেনভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ, আফ্রিকা,মধ্যপ্রাচ্য, ল্যাটিন আমেরিকা এবং ইউরোপের অস্থিতিশীল ঘটনাপ্রবাহ নিয়মিত তুলে ধরতেন সংবাদ মাধ্যমগুলোয়পেশাগত জীবনে ২২ টি যুদ্ধ ও অভ্যুত্থান কাভার করেছেনবিবিসি টেলিভিশন ও রেডিওর সংবাদ এবং সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিয়ে কাজ করেছেন প্রায় ২০ বছরএছাড়া চলচ্চিত্র, আন্তর্জাতিক ঘটনা এবং সঙ্গীত বিষয়ে তাঁর রয়েছে ব্যাপক ও বিচিত্র অভিজ্ঞতা

    সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি দুবার আহতও হয়েছিলেন ভিয়েতনাম ও সাইপ্রাসেপৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্র ও সাময়িকীতেও লিখেছেন তিনিবাংলাদেশের গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী প্রথম বিদেশি সাংবাদিক যিনি নিজের জীবন বিপন্ন করে সরেজমিন প্রতিবেদন তৈরি করে বিশ্বকে জানিয়ে দেন পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম নির্যাতন ও গণহত্যার কথা

    তাঁরট্যাঙ্কস ক্রাশ রিভ্লট ইন পাকিস্তানপ্রতিবেদনটি ছিল পাকিস্তানিদের গণহত্যা শুরু বিষয়ে ইংরেজি ভাষায় প্রথম প্রতিবেদনতিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন তাঁর বিখ্যাত ভাষণ দেন তখন আমি রমনা রেসকোর্স ময়দানে ছিলাম এবং আমি তাঁর একটি কথা বুঝতে পারি- এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ‘যখন আমি এই কথা শুনেছিলাম তখনই আমি বুঝেছিলাম তিনি কি বলছেন

     বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জনমত সৃষ্টিতে তাঁর প্রতিবেদনগুলো বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে সাড়া জাগিয়েছিলপ্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে, ‘আল্লাহর নামে আর অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষার অজুহাতে ঢাকা আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত ও সন্ত্রস্ত এক নগর১৯৭১ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাঁকে জোরপূর্বক দেশ থেকে বের করে দেয়ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়ে পুনরায় নভেম্বরে,১৯৭১ সালে কলকাতায় আসেনসেখান থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় খবরাখবর নিরপেক্ষভাবে ঐ দৈনিকে প্রেরণ করতেন১৬ ই ডিসেম্বর বিজয়ের দিনে যৌথবাহিনীর সাথে তিনিও ঢাকায় এসেছিলেন

 


No comments

Powered by Blogger.