Adsterra

অ্যান্থনি মাসকারেনহাস || মুক্তিযুদ্ধে বিদেশির অবদান

অ্যান্থনি মাসকারেনহাস || মুক্তিযুদ্ধে বিদেশির অবদান

অ্যান্থনি মাসকারেনহাস || মুক্তিযুদ্ধে বিদেশির অবদান


অ্যান্থনি মাসকারেনহাস জন্মসূত্রে ভারতীয় গোয়ানিজ খ্রিস্টান এবং বসবাস সূত্রে পাকিস্তানিতিনি ১৯২৮ সালের ১০ জুলাই ভারতের গোয়া-য় জন্মগ্রহণ করেনএরপর তিনি বাবা-মা সহ পাকিস্তানে চলে আসেন এবং এখানেই তাঁরা বসবাস শুরু করেন১৯৪৭ সালে মাসকারেনহাস করাচিতে সাংবাদিকতা পেশা শুরু করেনতিনি রয়টার্স, পাকিস্তান সংবাদ সংস্থা, এপিপি, নিউইয়র্ক টাইমস এ সংবাদদাতা ছিলেনকরাচি থেকে প্রকাশিত দ্যা মর্নিং নিউজ এর প্রধান সংবাদদাতা, পরবর্তীতে তিনি একই সংবাদপত্রে সহ-সম্পাদক পদে ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেনমুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে পত্রিকার এসাইনমেন্টে তিনি বাংলাদেশে অবস্থান করেছিলেন

   একাত্তরের এপ্রিলে বাংলাদেশে এসে গণহত্যার তথ্যাদি সংগ্রহ করেনএরপর বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে লন্ডনের সানডে টাইমস পত্রিকায় গণহত্যার তথ্যাদি প্রকাশ করেনএজন্য তিনি স্বয়ং ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেনপত্রিকাটির ১৯৭১ সালের জুন ১৩ সংখ্যায় এ সকল তথ্যাদি Genocide শিরোনামে প্রকাশিত হয়এতে বিশ্ব বিবেক অনেকাংশেই জাগ্রত হয় এবং বিশ্ববাসী বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্বন্ধে জানতে পারেতিনি উপমহাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাবলি অন্তরঙ্গ আলোকে প্রত্যক্ষ করে সাংবাদিকসুলভ ভঙ্গিতে তা বর্ণনা করেছেনতাঁর লেখা বিখ্যাত বই হলো- ‘দ্যা রেইপ অব বাংলাদেশএবংবাংলাদেশের রক্তের ঋণ

   ‘দ্যা রেইপ অব বাংলাদেশগ্রন্থটি ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত হয়বইটির সেই প্রাথমিক সংস্করণে শেষের দিকে তিনি মুক্তিযুদ্ধের ফলাফল প্রসঙ্গে আশা প্রকাশ করে বলেছিলেন- আমরা সবে মাত্র একটি নতুন অন্ধকারের রাজ্যে প্রবেশ করেছিঅন্ধকারময় সুড়ঙ্গ পথের শেষ প্রান্তে যেখানে আলোর রাজ্য শুরু, সেখানে পৌছাতে আমাদের দীর্ঘ সময় লাগবেঅবশ্য খুব বেশি সময় আমাদের লাগেনিআমরা আর কয়েকমাস পরেই পেয়ে যাই আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা 

  একাত্তরের ২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকে পরবর্তী দিনগুলোতে পাক হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের নিরীহ ও নিরস্ত্র বাঙ্গালিদের উপর আধুনিক অস্ত্র সজ্জিত হয়ে যে বর্বর ও বীভৎস হত্যাকাণ্ড চালিয়ে ছিল এর প্রত্যক্ষ ও চাক্ষুস একটি পূর্ণ বিবরণী বিশ্বের প্রথম শ্রেণির একটি সংবাদপত্রে তিনি সর্বপ্রথম প্রকাশ করেছিএনএই বিশেষ রিপোর্টটি পড়ে সারা বিশ্বে হৈ চৈ পড়ে যায়এতে সারা বিশ্ব (আমেরিকা ও চীন সরকার বাদে) বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতি ও সমর্থন জানাতে দ্বিধা করেনিভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সানডে টাইমস এর সম্পাদক হ্যারেন্ড ইভান্সকে বলেন, আর্টিকেলটি পড়ে আমি এতটাই বিচলিত হয়েছি যে আমি নিজ উদ্যোগে মস্কো ও ইউরোপসহ সারাবিশ্বের জনগণের মধ্যে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার জন্য বিশ্বভ্রমণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিপাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা করে, ছাত্র শিক্ষকদের লাইনে দাড় করিয়ে গুলি করে মারেএরপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সিদ্ধান্ত নেয় যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কয়েকজন সাংবাদিককে এনে ঘুরিয়ে দেখানো হবে যে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে তাঁরা সফল হয়েছেঢাকায় অবস্থান করা বিদেশি সাংবাদিকদের অবশ্য এর আগেই বহিষ্কার করা হয়েছেএরপর আটজন সাংবাদিককে দশ দিনের একটি সফরে পূর্ব পাকিস্তানে আনা হয়, যাদের মধ্যে ছিলেন মাসকারেনহাসওতাঁরা পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে সাত জন সাংবাদিক পাকিস্তানি সরকারের চাহিদা অনুযায়ী রিপোর্ট করেনব্যতিক্রম ছিলেন শুধু এন্থনি মাসকারেনহাস, তিনি বুঝতে পারেন পাকিস্তানে থেকে কিছু লেখা সম্ভব না তাই অসুস্থ বোনকে দেখার নাম করে চলে গেলেন লন্ডনসরাসরি প্রত্যক্ষ করা পাকবাহিনীর বর্বরতা, হত্যাকাণ্ড তথা বাঙ্গালি নিধনের নির্মম চিত্রতাঁর বিবেক সায় দেয়নি এই সত্য লুকিয়ে মিথ্যে সংবাদ প্রচারেসরাসরি লন্ডন টাইমসের সম্পাদকের দপ্তরে গিয়ে দেখা করেনতৎকালীন টাইমস সম্পাদক হ্যারল্ড ইভান্স প্রতিবেদনটি প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেনপ্রতিবেদন শুরু হয়- ‘আবদুল বারীর ভাগ্য ফুরিয়ে আসছিলপূর্ববঙ্গের আরও হাজারো মানুষের মতো তিনিও বড় একটি ভুল করেছেন- তিনি পালাচ্ছেন, কিন্তু পালাচ্ছেন পাকিস্তানি পেট্রোলের সামনে দিয়েতাঁর বয়স ২৪, সৈন্যরা তাঁকে ঘিরে ফেলেছেতিনি কাঁপছেন, কারণ তিনি এখনই গুলির শিকার হতে যাচ্ছেনএভাবেই শুরু করা হয়েছিল গত অর্ধ-শতকের দক্ষিণ এশিয়ার সাংবাদিকতার সবচেয়ে শক্তিশালী নিবন্ধগুলোর একটি

    ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সানডে টাইমসের সম্পাদককে বলেছিলেন, লেখাটি তাঁকে এত গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল যে এটি তাঁকে ইউরোপীয় রাজধানীগুলো আর মস্কোয় ব্যক্তিগতভাবে কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে উৎসাহ দেয়, যাতে ভারত এক্ষেত্রে সশস্ত্র হস্তক্ষেপ করতে পারে

    তাঁর প্রকাশিত এই তথ্য বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেতাঁর হৃদয়ছোঁয়া রিপোর্টটি সারাবিশ্বের মানুষের অন্তরকে ব্যথিত করেনড়েচড়ে বসে বিশ্ববোদ্ধারা, এরপর পুরো বিশ্ব বাংলাদেশকে সমর্থন জানাতে দ্বিধা করেনিসেই রিপোর্ট ধীরে ধীরে উঠে এলো পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানি বেসামরিক জনগণকে নির্বিচারে হত্যা, পঞ্চাশ লাখের মত মানুষের শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নেয়া, কলেরা, দুর্ভিক্ষে অগণিত মানুষের মৃত্যু, হাজার হাজার নারী ধর্ষণের কাহিনী, শিশুহত্যা- সব প্রকাশ হতে থাকলোএই কর্মকান্ডের জন্য তাঁর পরিবারকে লুকিয়ে থাকতেও হয়েছে, তবুও মায়ের নির্দেশমত তিনি কখনো সত্য প্রকাশে পিছিয়ে যাননিবাংলাদেশের এই পরম বন্ধু ১৯৮৬ সালের ৬ ডিসেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন

   মুক্তিযুদ্ধে বিশ্ববিবেককে জাগ্রত করতে তাঁর কলম চলেছে দুর্নিবারবাংলাদেশ সরকার তাইতো তাঁকে মরণোত্তর মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা প্রদান করে

No comments

Powered by Blogger.