জে এফ আর জ্যাকব || মুক্তিযুদ্ধে বিদেশির অবদান
জে এফ আর জ্যাকব || মুক্তিযুদ্ধে বিদেশির অবদান
ভারতীয় সেনাবাহিনির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জ্যাকব-ফারজ-রাফায়েল ‘জেএফআর’ জ্যাকব ১৯২৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্ব-পুরুষেরা ১৮ শতকে বাগদাদ থেকে কলকাতায় এসেছিলেন। তারা মূলত ছিলেন ইহুদি ধর্মের অনুসারী। পিতা ইলিয়াস ইমানুয়েল একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ছিলেন। জ্যাকব ২য় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে হলোকস্টের (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদি ধর্মালম্বীদের উপর চালানো গণহত্যা) নির্মমতা থেকে অনুপ্রাণিত হন এবং ১৯৪২ সালে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। ২০১২ সালে এক বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘আমি গর্বিত আমি ইহুদি, তাঁর থেকেও বেশি গর্বিত আমি ভারতীয়’। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন। ৩৬ বছরের সেনাবাহিনী জীবনে তিনি ২য় বিশ্বযুদ্ধ এবং ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধেও অংশগ্রহ্ণ করেন।
১৯৭১ সালে লেফট্যানেন্ট জেনারেল থেকে তিনি মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফের দায়িত্বে থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজিত করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য তিনি প্রশংসাসূচক অনেক সম্মান লাভ করেছেন। একাত্তরের মার্চে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী যখন ‘অপারেশন সার্চলাইট’ পরিচালনা করে, তখন লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণভয়ে ভারতে আশ্রয়ের খোঁজে আসতে থাকে। চীফ অব স্টাফ হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত জ্যাকব তখন উক্ত সমস্যা নিরসনের উপায় খুজতে থাকেন। অন্যদিকে পাকিস্তানিদের অত্যাচার আরো বাড়তে থাকে। তিনি সেই সময় পদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন যে, সমস্যা নিরসনের একমাত্র উপায় পাকিস্তানিদের সাথে সশস্ত্র যুদ্ধ। বাংলাদেশ-ভারত যৌথবাহিনীর প্রধান শ্যাম মানকেশ পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডকে প্রথমেই চট্টগ্রাম এবং খুলনা শহর দখল করতে নির্দেশ দেন। জাতিসংঘ এবং চীনের প্রবল চাপের মুখে ভারতীয় সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে অংশগ্রহণে আপত্তি জানাচ্ছিলেন। কিন্তু জ্যাকব সব ধরনের চাপের উর্ধ্বে গিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে সচেষ্ট ছিলেন। প্রথমেই তিনি ঢাকাকে দখলমুক্ত করার পরিকল্পনা করেন। এর জন্য সুচারুভাবে ও বুদ্ধিমত্তার সাথে অগ্রসর হন।
তাঁর পরিকল্পনা অবশেষে সফল
হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানিদের ঢাকা থেকে হটাতে সফল হয়। দখলের পর তিনি
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সকল যোগাযোগ মাধ্যম ধ্বংস করেন। তিন সপ্তাহের মধ্যে তিনি
ঢাকা দখলের পরিকল্পনা করলেও তা এক রাতের ভিতরেই হয়ে যায়। তারপর ধীরে ধীরে আরো অনেক
স্থান দখল করতে সক্ষম হন।
দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের মাধ্যমে
কোনো ফলাফল লাভ সম্ভব না ভেবে তিনি জেনারেল নিয়াজিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীসহ ১৬
ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করতে বলেন। তিনি নিয়াজির কাছে আত্মসমর্পণের খসড়া পাঠিয়ে দেন।
উক্ত দিন সকালে জ্যাকব শ্যাম মানকেশ’র ফোন পান এবং তিনি তাকে বলেন ঢাকায় গিয়ে
পৌঁছান এবং আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠান সংগঠিত করতে
তিনি জেনারেল নাগরাকে দুটি চেয়ার, একটি টেবিল জোগাড় করতে এবং ঢাকা শহর বিমানবন্দর, ইন্টারকন্টিনেন্টাল
হোটেল ও একটি যৌথ গার্ড অব অনারের আয়োজন করতে বললেন। তারপর পাকিস্তান বাহিনী ৩০
মিনিট সময়ে এক বিনাচুক্তির আত্মসমর্পণ সম্পন্ন করে।
পরবর্তীতে নিয়াজি দাবি করে
যে, জ্যাকব
তাকে ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে আত্মসমর্পণে রাজি করেছিলেন। ৯৩ হাজার সৈন্য সাথে নিয়ে
নিয়াজি আত্মসমর্পণ করেন। উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো,
ঢাকায় তখন প্রায় ৩০ হাজার
পাকিস্তানি সৈন্য উপস্থিত ছিল, অন্যদিকে ভারতীয় সৈন্য ছিল মাত্র ৩ হাজার।
অর্থাৎ অনুপাতে ১০ঃ১। এক্ষেত্রে জ্যাকব অনেক
বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন। জেনারেল জ্যাকব ২০১২ সালে ২৭ মার্চ বাংলাদেশ সরকারের কাছ
থেকে মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা পদক গ্রহণ করেন। ৩৭ বছর সেবা দেয়ার পর ১৯৭৮ সালে
সামরিকবাহিনি থেকে তিনি অবসর নেন। অবসর নেওয়ার পর ১৯৯০ দশকের শেষদিকে ভারতীয় জনতা
পার্টিতে যোগ দেন। দলে তিনি অনেক বছর নিরাপত্তা পরামর্শকের দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি গোয়া রাজ্যের গভর্নর হন ও পরবর্তীকালে পাঞ্জাবের গভর্নর হন। দীর্ঘ রোগে ভুগে
তিনি ১৩ জানুয়ারি, ২০১৬ সালে হাসপাতালে মারা যান।
বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের মানুষকে ভালোবেসে ছিলেন। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা ও সাফল্য কামনা করেছেন সবসময়। তাঁর বহুল আলোচিত গ্রন্থ ‘সারেন্ডার এট ঢাকাঃ বার্থ অব এ নেশন’ এবং ‘অ্যান ওডিসি ইন ওয়ার এন্ড পিস।’ এই গ্রন্থগুলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আগুনধরা দিনগুলোর স্মৃতিচারণ। তিনি ছিলেন দূরদর্শী ও কুশলী সেনানায়ক। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সমর পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব অনেকাংশেই তাঁর ওপর পড়ে। মূলত তাঁর প্রনীত যুদ্ধ কৌশলেই পাকিস্তানি বাহিনীর হাত থেকে রাজধানী ঢাকার মুক্তি ঘটে স্বল্পতম সময়ে। ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনাসদস্য বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ বাহিনীর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। পরাস্ত পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে তিনি ধারাবাহিক আলোচনা চালান এবং শেষ পর্যন্ত জেনারেল নিয়াজিসহ সব শীর্ষ পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাকে এনে দাড় করান ঢাকার রমনার রেসকোর্সে আত্মসমর্পনের দলিলে সই করতে। উল্লেখ্য যে, আত্মসমর্পণীর দলিলটির খসড়াও তিনি রচনা করেন। মূলত পাকিস্তানি বাহিনী কখন, কোথায় ও কীভাবে আত্মসমর্পণ করবে, সবই ঠিক করা হয় জেনারেল জ্যাকবের তত্ত্বাবধানে। মোট কথা, ৯ মাসের রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধ শেষে যে পাকিস্তানি বাহিনী পরাজিত হয়েছিল এবং আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল, তাঁর প্রধা রূপকার ছিলেন জ্যাকব।
আরও পড়ুন:
বাংলদেশ, মুক্তিযুদ্ধ
No comments