ইস্তানবুল, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর শহরগুলোর একটি
ইতিহাস ও ঐতিহ্য সমৃদ্ধ সৌন্দর্যময় রূপকথার শহর ইস্তানবুল। ইউরোপের প্রবেশদ্বার, আন্তঃমহাদেশীয় শহর, ইউরোপের বৃহত্তম শহর, রোমান, বাইজেন্টাইন এবং অটোম্যান সাম্রাজ্যের রাজধানী ইত্যাদি নামেও এই ইস্তানবুল শহর পরিচিত।
ইস্তানবুল হলো ইস্তানবুল প্রদেশের রাজধানী। এটি তুরস্কের বৃহত্তম শহর।
এশিয়া ও ইউরোপের মিলনক্ষেত্র নামে পরিচিত এ শহরটি অবস্থিত দুই মহাদেশে। ইস্তানবুল শহরের আয়তন ৫,৩৪৩ বর্গ কিলোমিটার।
ইস্তানবুল পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন শহর গুলোর মধ্যে অন্যতম। ১৯৩০ সালের পূর্বে এই শহরটি কন্সট্যান্টিপোল নামে পরিচিত ছিল । এরও আগে এই শহরটি বাইজেন্টিয়াম নামে পরিচিত ছিল। এটি ছিল তৎকালীন পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সভ্যতা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী। ১৫৫৩ সালে সুলতান মুহাম্মদ ফাতিহ সে সময়কার সবচেয়ে শক্তিশালী সভ্যতা বাইজেন্টাইনকে পরাস্ত করার পর ইস্তানবুলকে অটোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী ঘোষণা করেন।
ধারণা করা হয়, বাইজান্টিয়াম নামটি এসেছে মেগারা শহর থেকে গ্রীকদের নেতা বাইজাসের নাম থেকে। কিংবদন্তি অনুসারে, গ্রীক নেতা বাইজাস খ্রিস্টিয় থ্র্যাসিয়ান জাতির কাছ থেকে উপদ্বীপটি দখল করে নিয়েছিলেন। এরপর খ্রিস্টপূর্ব ৬৫৭ সালে এই শহরটি তিনি গড়ে তোলেন রাজধানী হিসেবে। ১৯৬ খ্রিস্টাব্দে গৃহযুদ্ধের সময় বিরোধিতা করার জন্য রোমানরা এই শহরটি ধ্বংস করে দেয়। এরপর রোমান সম্রাট সেপটিমিয়াস সেভেরাস তার পুত্র অগস্টা আন্তোনিয়ার সম্মানে এই শহরটির নামকরণ করেন। এরপর ৩৩০ খ্রিস্টাব্দে কন্সট্যান্টাইন দ্য গ্রেট এই শহরকে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেন এবং একে নতুন রোম বলে অভিহিত করেন। সম্রাট কনস্টানটাইন নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত মুদ্রাতে এই শহরটির নাম বাইজেন্টিয়াম নামেই উল্লেখ হতে থাকে। প্রায় সহস্রাধিক বছর পরে সম্রাট কনস্টানটাইনের নাম অনুসারে শহরটির নাম কন্সট্যান্টিপোলে রূপান্তরিত করা হয়।
১৯২৩ সাল পর্যন্ত কন্সট্যান্টিপোল ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী। ১৯২৩ সালে অটোমান সাম্রাজ্য ভেঙে তুরস্ক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর কন্সট্যান্টিপোল থেকে এর রাজধানী আঙ্কারায় স্থানান্তরিত করা হয়। এখন পর্যন্ত এটি তুরস্কের বৃহত্তম শহর এবং প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র। এই শহরটি ইউরোপ এবং এশিয়া অংশজুড়ে অবস্থিত হওয়ায় আন্তর্জাতিকভাবেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
ইস্তানবুল পর্যটকদের জন্য এক স্বপ্নের গন্তব্য। এই শহরের প্রতিটি স্থাপত্য থেকে শুরু করে খাবারের মাঝেও লুকিয়ে আছে অনেক জানা-অজানা ইতিহাস ও সংস্কৃতি। শরীর ও মনকে সতেজ করার জন্য ইস্তানবুল একটি আদর্শ শহর। প্রাণবন্ত এই শহরে রয়েছে বিনোদনের সবরকম ব্যবস্থা।তাই বরাবর পর্যটকদের মন কেড়েছে এই ইস্তাম্বুল শহর।
ইস্তানবুলের অন্যতম প্রধান আকর্ষন বসফোরাস প্রণালী। কেননা, বসফোরাস প্রণালিতে কলকল বয়ে চলা পানির ধারাটি সংযুক্ত করেছে এশিয়া ও ইউরোপকে। এশিয়া ও ইউরোপকে একত্রে বলা হয় ইউরেশিয়া, যার বিভাজন রেখা হলো এই বসফোরাস প্রণালি। এ কারণে ইস্তাম্বুলকে বলা হয়, দুটি মহাদেশের একটি শহর। ইস্তানবুল নগরীকে অবলোকনের সবচেয়ে ভালো উপায় হলো বসফরাস প্রনালী থেকে দেখা। আর বসফোরাস প্রণালীর ধারে রয়েছে বেশ কিছু ইয়ালি। এগুলো ছোট ছোট প্রাচীন নিদর্শনসমৃদ্ধ বাড়ি। এগুলো পানির সঙ্গে সংযুক্ত এবং প্রাচীন ঐতিহ্য সমৃদ্ধ।
ইস্তানবুুল রয়েছে অটোম্যান এবং রোমানদের তৈরি বিভিন্ন মসজিদ, গির্জা এবং ঐতিহাসিক স্থাপনা। তুরস্কের সবচেয়ে বড় এবং সুন্দরতম মসজিদ হলো সুলেমানিয়া মসজিদ। দূর থেকে দেখলে মনে হবে সাতটি পাহাড়ের উপর একটি সুন্দর মুকুট। বিশাল জায়গা নিয়ে বানানো কমপ্লেক্সের মতো এই মসজিদের প্রাচীন অনেক ভবন পুনরুদ্ধার করা হয়েছে এবং বর্তমানে পুনঃব্যবহারের উপযোগী করা হয়েছে।
ইস্তানবুলে রয়েছে প্রভাবশালী সাহাবা আবু আইয়ুব আনসারী ও আরও অনেক সাহাবার পবিত্র সমাধি এবং ইস্টার্ন অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের মূল উপাসনালয় হাজিয়া সোফিয়া। সৌন্দর্যে অনন্য হাজিয়া সোফিয়া শুধু উপাসনালয়ই নয়, বরং তা বাইজ্যানটাইন সাম্রাজ্যের স্থাপত্য নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ইস্তানবুলের বুকে। আজকেও স্থাপত্যশৈলীর ইতিহাসে প্রথমসারির স্থান দখল করে থাকে ইস্তানবুলের পুরাকীর্তি হাজিয়া সোফিয়া। শুধু তুরস্কের নয়, এশিয়া মহাদেশের অন্যতম আকর্ষণীয় শহর হচ্ছে ইস্তানবুল। অত্যন্ত সুচারু ও পরিকল্পিত শহর ইস্তাম্বুল। নিত্য দিনের সূর্যের আলোয় ঝিকমিক করে শহরটি। দেখে যেন মনে হয় স্বপ্নের জগত্। শহরটির দু-ধারে সাজানো-গোছানো পরিকল্পিত বাড়িঘর, দালান-কোঠা, মাঝে মাঝে বৃক্ষরাজির অপরূপ শোভা, মাঝখানে বসফোরাস প্রণালি। এ যেন শিল্পীর তুলিতে অঙ্কিত কোনো চিত্রশিল্প। ইস্তাম্বুলের ভেতর দিয়ে যে বসফোরাস প্রণালি বয়ে গেছে এর আয়তন ৩২ কিলোমিটার। উত্তরে কৃষ্ণসাগর এবং দক্ষিণে মর্মর সাগর। প্রণালির গভীরতা গড়ে ৫০ মিটারের মতো। প্রশস্ততা কোথাও কম, আবার কোথাও বেশি। ইউরোপ ও ভলকান রাষ্ট্রগুলোর জাহাজ চলে এই প্রণালি দিয়ে। ইস্তানবুলের গ্র্যান্ডবাজার এশিয়ার একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী বিশাল বাজার। এখানে প্রাচীন ঐতিহ্য ও আধুনিক রুচির এক অপরূপ সমন্বয় ঘটেছে। আরবী জীবনধারার সাথে এশীয় জীবন-প্রবাহের এক প্রাণবন্ত মিশ্রণ। মুসলিম সংস্কৃতির সাথে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সেতুবন্ধন এখানে স্পষ্ট অনুভব করা যায়। ছোট ছোট দোকানগুলো পণ্য দ্রব্যে ভরপুর। সোনা-দানা, মণি-মুক্তা থেকে শুরু করে জামা-কাপড়-কার্পেট, চামড়াজাতীয় জিনিস, হাতের চুড়ি, খোপার কাঁটা সবকিছুই রয়েছে এখানে। এছাড়াও ঐতিহাসিক হিপোড্রোম বা সুলতান আহমদ স্কয়ার ইস্তানবুলের এক সুপ্রাচীন ঐতিহ্য।
No comments