মুক্তিযুদ্ধে বিদেশির অবদান
মুক্তিযুদ্ধে বিদেশির অবদান
মাতৃভূমি রক্ষার্থে লড়াই করা বিরাট গৌরবের ব্যাপার। মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলার আপামর জনতার অংশগ্রহনের মধ্য দিয়ে সেই গৌরব অর্জনের সুবর্ণ সুযোগ হয়েছিল হাজার হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধার। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিদেশী বন্ধুদের অবদান কম নয়। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন ও সহযোগিতা জুগিয়েছেন। এই গৌরব অর্জনের এক বড় অংশিদার হচ্ছে বিদেশিরা। বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে, স্বাধীনতা সংগ্রামে শুরু থেকেই বহির্বিশ্বের নাগরিকদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণ ছিল। নিরস্ত্র বাংলালেশিদের হত্যা, নির্যাতনে বিবেকবান মানুষ নিশ্চুপ থাকতে পারেনি। ছুটে এসেছে, প্রতিবাদ করেছে যে যেখানে ছিল। তাদের একান্ত সহযোগিতায় যুদ্ধ জয় ত্বরান্বিত হয়েছে। সহযোগিতা পেয়ে বাঙ্গালিরা মনোবল পেয়েছে, উদ্দীপ্ত হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বাঙ্গালিদের পাশাপাশি কিছু মানুষ ছিলেন যারা এই দেশের না হয়েও মানবতার টানে গৌরবময় বিজয়ে রেখেছেন অসামান্য অবদান। স্বাধীনতা অর্জনে বিদেশিদের এই অবদান কোনোদিন ভোলার নয়।
বাংলাদেশ যতদিন থাকবে ততদিনই সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে ভারতের অবদানের কথা। নিরস্ত্র বাংলাদেশিদের হত্যা, নির্যাতন এবং একপেশে যুদ্ধের খবর কেউ পৌঁছে দিয়েছিলেন কলম হাতে, কেউ ক্যামেরা হাতে। বিশ্ববাসীকে জানান দিয়েছিলেন নিজের কবিতায়, কেউবা গান গেয়ে, কেউ প্রবন্ধ নিবন্ধ লিখে। মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশিদের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়ানো একশত বন্ধুকে নিয়েই এই গ্রন্থ। যাদের কেউ কেউ ত্রানকর্মী, বিদেশী রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক, সংস্কৃতিকর্মী, দার্শনিক, শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, বিশিষ্ট নাগরিক, সেনানায়ক, সংবাদমাধ্যম কর্মী ও সাংবাদিক।
একটি দেশ, একটি
স্বাধীন ভূখন্ড সবারই কাম্য। কোনো কোনো জাতিকে সেই স্বাধীন ভূখন্ড অর্জন করতে অনেক
বেশি মূল্য দিতে হয়। যুদ্ধ কেড়ে নেয় লক্ষ বুকের তাজা রক্ত, বেঁচে
থাকার অবলম্বন, পিতা-মাতা, ভাই-বোন, ভিটেমাটি, নববধূর সোনালি স্বপ্ন, আশা, ভালোবাসা
অনেক অনেক কিছু। সব হারানোর বেদনা নিয়ে একটি জাতি ধ্বংসস্তুপ থেকে জেগে ওঠে। বেদনার
ধূসর জগতে তৈরি হওয়া ক্ষত ক্রমশঃ বাড়তে থাকে। কোনো কোনো অনাথ শিশু তিল তিল করে
বেড়ে ওঠে সেই ক্ষত বুকে নিয়েই। ক্ষত শুকিয়ে গেলেও তার দাগ থেকে যায় স্থায়ীভাবে।
একজন মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধে যায় দেশমাতৃকার টানে, শত্রুর হাত থেকে দেশকে রক্ষার জন্যে, দেশের মানুষের মুক্তির জন্যে। একজন সৈনিক যুদ্ধ করে নিজের দেশের প্রতি কর্তব্য পালনের কারণে। কিন্তু একজন বিদেশি? সে কেন অন্য দেশের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে? সে কেন অচেনা অজানা মানুষের হাহাকার শুনে নিজের জীবন বিপন্ন করবে? এখানে যার কোনো দায়বদ্ধতা নেই! তবুও কেন?
পৃথিবীর কিছু মানুষ থাকেন যাদেরকে কোনো ভৌগলিক সীমারেখায় আবদ্ধ করে রাখা যায় না। কেউ কেউ দেশ কালের গন্ডি ছাড়িয়ে যান অবলীলায়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে নিজেদেরকে সামিল করেন জন মানুষের কাতারে। রুখে দাঁড়ান সব অনিয়মের বিরুদ্ধে। কখনো গর্জে ওঠে তাদের হাতিয়ার, কখনো কলম, কখনো কণ্ঠ, আবার কখনো বা নিজেই ঝাঁপিয়ে পড়েন জীবন বিপন্ন করে। এ ধরনের মানুষের সংখ্যা যে খুব বেশি তা কিন্তু নয়, বরং সংখ্যায় এরা খুবই কম কিন্তু যারা সবকিছুর উর্ধ্বে উঠে মানুষের কল্যাণে এগিয়ে আসেন তারাই হয়ে ওঠেন স্মরনীয়, কর্ম দিয়ে নিজেদেরকে নিয়ে যান অন্য উচ্চতায়। আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের পাশে পেয়েছিলাম এ রকম কিছু স্মরণীয় সুহৃদকে যারা দেশ কালের সীমা অতিক্রম করে আমাদের সেই মহাক্রান্তিকালে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সাহায্যের হাত।
স্বাধীনতার দীর্ঘ চার দশকেরও
বেশি সময় পর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ‘বন্ধু-সমর্থকদের’হাতে সম্মাননা পদক তুলে
দেওয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বর্ণাঢ্য কয়েকটি আয়জনের মধ্য দিয়ে সম্মাননা পদক তুলে
দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় কর্তা ব্যক্তিদের হাত দিয়ে।
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলিতে যেসব বিদেশি ব্যক্তি ও সংস্থা বাংলাদেশকে নানাভাবে
সাহায্য-সহযোগিতা
করে বাঙ্গালির স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণা যুগিয়েছিলেন, সম্মাননা
প্রদানের মাধ্যমে পুরো জাতির পক্ষে সরকার তাদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। যেসব
ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানকে পুরষ্কার দেয়া হয়েছে তারা কে কীভাবে বাংলাদেশের
মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছে তা আলাদাভাবে বলা হয় উক্ত অনুষ্ঠানে।
সরকার যেসব বিদেশিকে
সম্মাননা গ্রহণের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, তাদের মধ্যে অনেকেই মারা গিয়েছেন। প্রয়াতদের
কারও কারও পরিবারের সদস্যরা সম্মাননা নিয়েছেন। ১৯৭১ সালে কোনো কোনো দেশের সরকারের
ভূমিকা বাংলাদেশের বিপক্ষে থাকলেও সে দেশের কিছু লোক এর ব্যতিক্রম থেকে বাংলাদেশের
স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেছেন। চার দশক পর বাংলাদেশের সরকার
উদ্যোগ নিয়েছে তাদেরকে সম্মানিত করতে। বাংলাদেশ সরকার যাদের সম্মাননা জানিয়েছে
তাদের কেউ কেউ বাংলাদেশের অনেকের কাছেই বেশ পরিচিত নাম। আবার এমন অনেককেই সম্মাননা
দেওয়া হয়েছে যাদের নাম বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে পরিচিত নয়। তবে মুক্তিযুদ্ধে তাদের
অবদান ছিল। সেসব অবদানের বিচার বিশ্লেষণ করেই সম্মাননার জন্য মনোনীত করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য
স্বীকৃতি দেবার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ৫৬১ জন ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের নাম
চূড়ান্ত করেছিল এবং আরও নাম জোগাড় করা হচ্ছিল। ভারতের প্র্য়াত প্রধানমন্ত্রী
ইন্দিরা গান্ধীকে মরণোত্তর স্বাধীনতা সম্মাননা জানানোর মধ্য দিয়ে এই আনুষ্ঠানিকতা
শুরু হয়েছিল।
ব্যক্তির পাশাপাশি কিছু
প্রতিষ্ঠানকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে বিবিসি, আকাশবাণী, কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয় সহায়ক সমিতি, বিশ্ব শান্তি পরিষদ ইত্যাদি।
ভারতের যেসব নাগরিক সম্মাননা
পাচ্ছেন তারা হলেন- শচীন লাল সিংহ,
রাজ্যেশর রাও, সিদ্ধার্থ
শংকর রায়, পি
এ সাংমা, বিচারপতি
সা’দাত
আবুল মাসুদ, মহারানী
বিভা কুমারী দেবী, প্রফেসর দিলীপ চক্রবর্তী, সমর
সেন, দেবদুলাল
বন্দ্যোপাধ্যায়, পন্ডিত রবিশংকর,
ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ, মাদার
তেরেসা, ও্য়াহিদা
রেহমান, সুনীল
দত্ত, কাইফি
আজমী, ভূপেন
হাজারিকা, এডভোকেট
সুব্রত রায় চৌধুরী, ফিল্ড মার্শাল এসএএম মানেক শ, লেফটেন্যান্ট
জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা, লেফটেন্যান্ট জেনারেল জ্যাকব, ল্যান্স
নায়েক আলবার্ট এক্কা, নারায়ণ দেশাই,
মানিক সরকার, আই
পি গুপ্ত, জি
বি হাসপাতাল ও সার্জন সুপারিনটেন্ডেন্ট ডা রথিন দত্ত, রওশন
আরা বেগম সাংমা, দশরথ দেব বর্মণ,
লতা মংগেশকর, ডিপি
ধর, জেনারেল
উবান, গোলক
মজুমদার, পিএন
হাকসার, ড
করণ সিং, সরদার
শরণ সিং, শরৎ
চন্দ্র সিংহ, ভারতীয় জনগণ ও মিত্র বাহিনী।
রাশিয়ার যেসব ব্যক্তি
সম্মাননা পেয়েছেন তারা হলেন-নিকলাই ভিক্টরভিচ পডগোরনি, আদ্রে
গ্রোমিকো, ইয়াকভ
আলেকজান্ডারভিচ মালিক, আলেক্সি নিকোলেভিচ কোসিগিন, প্রফেসর
ভ্লাদিমির স্টানিস, লিওনিদ ব্রিজনেভ,
নিকলাই ফ্রিউবিন, আনাতলি
ডবরিনিন, অ্যাডমিরাল
জুয়েনকো ও তার দল ও সিপিএসিউ’র ১৭ সদস্য বিশিষ্ট পলিটব্যুরো।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
অ্যানা ব্রাউন টেইলর, আর্চার কে ব্লাড,
সিনেটর এডওয়ার্ড মুর কেনেডি, রিচার্ড
টেইলর, লিয়ার
লেভিন, ফাদার
ইউলিয়াম গ্রীনো, এডওয়ার্ড সি মেসন, প্রফেসর
এডয়ার্ড সি ডিমক, ডেভিড ওয়াইজব্রড,
অ্যালেন গিনসবার্গ, শহীদ
ফাদার ইভান্স, প্রফেসর জে কেনেথ গলব্রেথ।
ব্রিটিশ নাগরিকদের মধ্যে
রয়েছেন- স্যার
এডওয়ার্ড রিচার্ড জর্জ হিথ, লর্ড হ্যারলড উইলসন, লর্ড
পিটার ডেভিড শোর, মাইকেল বার্নস,
সায়মন ড্রিং, জর্জ
হ্যারিসন, ব্রুস
ডগলাস মান, জুলিয়াস
ফ্রান্সিস, পল
কানেট, এলেন
কানেট, বিমান
মল্লিক, মার্ক
টালি।
ফরাসি নাগরিকদের মধ্যে আন্দ্রে মার্লো।
জার্মান নাগরিকদের মধ্যে রয়েছেন-উইলি ব্র্যান্ট, বারবারা দাশগুপ্ত, সুনীল দাশগুপ্ত, এরিক হোয়েনকার। অস্ট্রেলিয়ার উইলিয়াম এ এস ওডারল্যান্ড, অস্ট্রিয়ার ব্রুনো ক্রেইস্কি, কানাডিয়ান নাগরিক পিয়ের ট্রুডো, আইরিশ নাগরিক শন ম্যাকব্রাইড, ব্যারিস্টার নোরা শেরিফ, যুগোশ্লাভিয়ার মার্শাল জোসেফ ব্রজ টিটো, ইতালির ফাদার মারিও রিগন। জাপানির তাকাশি হায়াকাওয়া, প্রফেসর নারা, তাকামাসা সুজুকি, নাওয়াকি উসুই। নেপালের ড. রাম বরণ যাদব ও বিপি কৈরালা। পাকিস্তানের আহমদ সলিম, কাজী ফয়েজ মোহাম্মদ, নাসিমা আক্তার, খান আব্দুল গাফফার খান, খান আব্দুল ওয়ালি খান, কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ট্রো। আর্জেন্টিনার ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, জর্জ লুইস বর্গেস, ভেনিজুয়েলার কার্ডিয়ান হোসে উমবার্তো কুইনতেরো, সুইজারল্যান্ডের প্রফেসর জিয়ান জিগলার, ভুটানের লিউনপো উজিয়েন শেরিং, সুইডেনের ওলফ পামে, ডেনিশ নাগরিক ড.কার্সটিন ওয়াস্টার গার্স্ট, মালয়েশিয়ার ড.এ সুরিয়ান, শ্রীলঙ্কার স্যার সেনারত্ন গুণবর্ধন, ডাচ নাগরিক কিনটেন ওয়াটে বাগ, দক্ষিন কোরিয়ার হং সুক জা, পোল্যান্ডের অগাস্ট জালেস্কি, ভিয়েতনামের মাদাম বিন।
এরা এক এক জন এক এক দেশের
অধিবাসী আলাদা আলাদা স্থান থেকেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। তাদের সেই
সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফসল বিশ্ব জনমত গড়ে উঠেছিল বাঙ্গালিদের পক্ষে। বাংলাদেশ নামে
একটি স্বতন্ত্র দেশ বিশ্ব মানচিত্রে জন্ম নিয়েছিল।
No comments