ফিদেল কাস্ত্রো || মুক্তিযুদ্ধে বিদেশির অবদান
কিউবায়
স্প্যানিশ বংশোদ্ভূত স্বচ্ছল একটি পরিবারে জন্ম ফিদেল কাস্ত্রোর। কিউবান রাজনৈতিক
মেতা ও সমাজতন্ত্রী বিপ্লবী ফিদেল আলেসান্দ্রো কাস্ত্রো যিনি ফিদেল কাস্ত্রো নামে
পরিচিত। তিনি ১৯২৬ সালের ১৩ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। পূর্বাঞ্চলীয় ওরিয়েন্ত প্রদেশে
বিরান শহরের কাছে ধনী চিনিকল মালিক অ্যাঞ্জেল কাস্ত্রো রুস ও লিনা রুস গনজালেসের
ঘরে জন্ম ফিদেলের।
কাস্ত্রো ফেব্রুয়ারি ১৯৫৯
থেকে ডিসেম্বর ১৯৭৬ পর্যন্ত কিউবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এরপর ফেব্রুয়ারি ২০০৮-এ
স্বেচ্ছায় সরে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কিউবার মন্ত্রী পরিষদের প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
১৯৬১ সালে কিউবা কমিউনিস্ট দলের প্রতিষ্ঠালগন থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত প্রধান
হিসেবে ছিলেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে ২০০৮ সালে তিনি তাঁর দায়িত্ব ভাই রাউল
কাস্ত্রোর কাছে অর্পন করেছিলেন।
কাস্ত্রোর রাজনৈতিক জীবন
শুরু হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়ার সময়। ক্রমেই কিউবান রাজনীতির ধ্রুব
তারা হয়ে উঠেন। তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় প্রেসিডেন্ট ফালজেন্সিও বাতিস্তা এবং
কিউবার উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রভাবের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী সমালোচনা
নিবন্ধ লিখে। কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ তখন তিনি সমর্থ হন। ১৯৫৩ সালে মানকাদা
ব্যারাকে একটি ব্যর্থ আক্রমণের পর কারারুদ্ধ হন ও পরে ছাড়া পান। এরপর তিনি
বাতিস্তার সরকার উৎখাতের জন্য সংগঠিত হতে মেক্সিকো যান। ১৯৫৬ সালে ফিরে এসে সরকার
উৎখাতে নামেন।
কাস্ত্রো ও তাঁর দলের কয়েক
সদস্য মার্কিন মদদপুষ্ট স্বৈরশাসনের অবসান ঘটাতে অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেন।
এজন্য ‘দ্য
মুভমেন্ট’ নামে
একটি গ্রুপ গঠন করেন। ১৯৫৩-র ২৬ জুলাই দ্য মুভমেন্টের ১৫০ সদস্য কিউবার
সান্তিয়াগোতে থাকা মানকাদা মিলিটারি ব্যারাকে আক্রমণ করে। অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে
কাস্ত্রো বন্দি হন। প্রহসনের বিচারে তাঁকে ১৫ বছরের কারাদন্ড দেওয়া হয়। বিচারকালে
নিজের ভাষণই তাঁকে তুমুল জনপ্রিয় করে তোলে। তিনি বলেছিলেন- ‘আমাকে
অপরাধী বানাতে পার, কিন্তু ইতিহাস আমাকে মুক্তি দেবে।’ কারাগারে
থেকেই দলের নাম ‘টুয়েন্টি সিক্সথ অব জুলাই মুভমেন্ট’ পরিবর্তন
করেন। দুই বছর পর এক চুক্তির বলে মুক্তি পেয়ে সহযোগীদের নিয়ে মেক্সিকোয় পাড়ি জমান
কাস্ত্রো।
মেক্সিকোতেই কাস্ত্রো, রাউল
ও চে গুয়েভারা পরিকল্পনা করেন পুনরায় বাতিস্তা সরকার উৎখাতের। ১৯৫৬-র ২
ডিসেম্বর ৮১ জন সহযোগী অস্ত্রশস্ত্রসহ ছোট্ট নৌকা ‘গ্রানামা’য়
চেপে কিউবার উত্তরাঞ্চলে ঢোকার পরিকল্পনা করেন। খবর পেয়ে বাতিস্তা সেখানে বাহিনী
পাঠালে গুলিতে বেশ কিছু সঙ্গী নিহত হন। চে আর রাউলসহ পার্বত্য জঙ্গলে ঘাঁটি গাড়েন।
জনগণের সমর্থনে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে ১৯৫৮-র শেষ দিকে একের পর এক শহর দখল করতে থাকে। ১৯৫৯-র
জানুয়ারিতে কিউবা দখলে নেয় ‘টুয়েন্টি সিক্সথ অব জুলাই মুভমেন্ট’; বাতিস্তা
পালিয়ে আশ্রয় নেন্ন ডমিনিকান রিপাবলিকে।
বিপ্লবের মাধ্যমে বাতিস্তার
স্বৈরশাসনকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতায় আসেন। কাস্ত্রো কিউবার প্রধানমন্ত্রী হন।
১৯৬৫ সালে কিউবা কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান হন এবং কিউবাকে একদলীয় সমাজতান্ত্রিক
দেশ হিসেবে রূপ দেন। ১৯৭৬ সালে তিনি রাষ্ট্র ও মন্ত্রী পরিষদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে
দায়িত্ব নেন। কিউবার সর্বোচ্চ সামরিক পদেও আসীন হন।
সাড়া বিশ্বের মুক্তিকামী
মানুষের কাছে বিপ্লবের প্রতীক কমরেড ফিদেল কাস্ত্রো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
একেবারেই কাছে থেকেও তিনি কিউবার বিপ্লবকে সফল করেছেন। “সাম্রাজ্যবাদের
চাপিয়ে দেওয়া অন্যায় অবরোধ, সকল ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে তিনি কিউবার
বিপ্লবকে শুধু রক্ষাই করেননি, কিউবাকে বিস্ময়করভাবে অগ্রসর করেছেন।” সমাজতন্ত্রের
ঝাণ্ডা নিয়ে বিশ্বের নিপীড়িত ও আক্রান্ত মানুষের পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর
লড়াই কিউবায় সীমাবদ্ধ থাকেনি, ছড়িয়ে পড়েছে সাড়া বিশ্বে।
একাত্তরে বাংলাদেশের
মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ফিদেল ও তাঁর দলের অকুণ্ঠ সমর্থনের কথা বাংলাদেশের জনগণ
চিরদিন কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে। বিশ্বের নিপীড়িত, নির্যাতিত, মুক্তিকামী
মানুষের মুক্তির লড়াইয়ে তিনি বেঁচে থাকবেন। বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে তিনি অনন্ত
প্রেরণার উৎস। তিনি বলতেন ভালোবাসা মানেই বাংলাদেশ,
বাংলাদেশ মানেই শেখ মুজিবুর
রহমান, একজন
হিমালয় মানব। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের
সঙ্গে তাঁর ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। বঙ্গবন্ধু সাড়া বিশ্বের কাছে নিঃশর্ত
সাহায্য চেয়েই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে কোনো আপস তিনি
করবেন না। স্বাধীনতার পর, ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ
আন্দোলনের চতুর্থ সম্মেলনে বংগবন্ধুর সাথে কাস্ত্রোর সাক্ষাৎ হয়। সে সময় তিনি
বঙ্গবন্ধুকে আলিঙ্গন করে বলেছিলেন, “ আই হ্যাভ নট সিন দ্য
হিমালয়েজ। বাট আই হ্যাভ সিন শেখ মুজিব। ইন পারসোনালিটি অ্যান্ড ইন কারেজ, দিস
ম্যান ইজ দ্য হিমালয়েজ। আই হ্যাভ দাজ হ্যাড দ্য এক্সপেরিয়েন্স অব উইটনেসিং দ্য
হিমালয়েজ।”
কাস্ত্রো ধীরে ধীরে সোভিয়েত
ইউনিয়নের দিকে ঝুঁকে পড়েন। তাঁকে ৬৩৮ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কাস্ত্রো
বাহিনী তা প্রতিহত করে। যুক্তরাষ্ট্রের এই ধারাবাহিক চেষ্টাকে নিয়ে কৌতুকও করেছেন
ফিদেল কাস্ত্রো। বলেছেন- ‘হত্যার চেষ্টা এড়িয়ে যাওয়ার যদি কোনো অলিম্পিক
ইভেন্ট থাকত, তাহলে নির্ঘাত তাতে স্বর্ণপদক জিততাম আমি।”
কিউবাতে ১০ হাজার নতুন স্কুল
খুলে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেন পাহাড়ি, দুর্গম প্রত্যন্ত অঞ্চলে। ফল মেলে সাক্ষরতার
হার দাঁড়ায় ৯৮ শতাংসগ। তিনি গড়ে তোলেন সার্বজনীন স্বাস্ত্যসেবা; যেখানে
শিশুমৃত্যুর হার হাজারে ১১ জন। বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতি
হিসেবে ২০১৩ সালে তাঁকে ‘মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননায়’ ভূষিত
করে। ২০১৬ সালের ২৫ নভেম্বর এই বিপ্লবী হাভানায় মৃত্যুবরণ করেন।
No comments