ভাগ্য নির্ধারণী ১৩০ দিন, কী ঘটবে রাজনীতিতে
বহুদিন পর রাজনীতি ড্রাইভিং সিটে। এটা সত্য তবে সমস্যার শেষ নেই। বাজারে হাসিমুখ মানুষের খোঁজ মেলা ভার। চাকরিজীবীদের মাস কিছুতেই শেষ হয় না। দ্রব্যমূল্য আর জীবন-যাপনের খরচ শেষ করে দিয়েছে বহু স্বপ্ন। হিসাব মেলাতে না পেরে কতো মানুষ যে এই শহর ছেড়ে গেছেন তার ইয়ত্তা নেই। ডেঙ্গু দেখা দিয়েছে ভয়ঙ্কর রূপে। মৃত্যুর খাতায় প্রতিদিন উঠছে নতুন নতুন নাম। এ নিয়ে কথা হচ্ছে খুবই কম। যদিও কেউ কেউ মশকরাও করছেন।
এই পরিস্থিতিতেও রাজনীতি নিয়েই আলাপ হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশে অবশ্য এটা কোনো বিস্ময়কর ঘটনা নয়। এটা বলা হতো, এদেশের মানুষ রাজনীতি খায়, পান করে। কিন্তু গেল ক’বছর পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে অনেক। রাজনীতির ওপর আমজনতার নিয়ন্ত্রণ হারানোই এর প্রধান কারণ। জিজ্ঞেস করতে পারেন, তাদের নিয়ন্ত্রণ ছিলই বা কবে! তবুও এরশাদের পতনের পর অন্তত চারটি নির্বাচনে তাদের কেন্দ্র থেকে ফিরিয়ে দেয়া হয়নি। খুব বেশি মৃত মানুষ ভোট দেয়নি। গেল দু’টি নির্বাচন কেমন হয়েছে তা সবারই জানা। জাতীয় বা স্থানীয় কোনো নির্বাচনেই পরিস্থিতি খুব একটা পাল্টায়নি। এই অবস্থায় মানুষ রাজনীতি নিয়ে আগ্রহ হারালে অবাক হওয়ার কিছু নেই। দরজায় কড়া নাড়ছে আরেকটি নির্বাচন। এই সময়ে গ্রামের চায়ের দোকান থেকে গুলশানের কূটনৈতিক পাড়া প্রধান প্রশ্ন একটাই-কী হচ্ছে? কী হবে? আগামী ১৩০ দিনকে মনে করা হচ্ছে ভাগ্য নির্ধারণী সময়। এ সময়ে প্রতিটি দিনই হতে পারে ঘটনাবহুল। শাসক বনাম বিরোধী শিবির, আমেরিকা বনাম রাশিয়া-চীন, দৃশ্যপটে ভারত। খেলাতো আসলে বহুমুখী।
শাসক দল কোনো ছাড় দিতে রাজি নয়। তাদের সাফ কথা সংবিধানের বাইরে কিছুই হবে না। অর্থাৎ বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় রেখেই আরেকটি নির্বাচনের জোর প্রস্তুতি চলছে। আওয়ামী লীগ এরইমধ্যে দলীয় প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা যাচাই শুরু করেছে। হয়েছে একাধিক জরিপ। নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রশাসনে এবং পুলিশে এক ধরনের রদবদল হয়েছে। নানা পর্যায় থেকে সরকারের প্রতি সমর্থন সূচক বক্তব্য এসেছে সম্প্রতি। সংলাপ নিয়ে দৃশ্যত আগ্রহী নয় সরকার। তবে বিরোধী দল প্রস্তাব করলে কিংবা পরিস্থিতি পরিবর্তন হলে আওয়ামী লীগ সংলাপে আগ্রহী হতে পারে। নির্বাচনকালীন সরকারে মন্ত্রী অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রেও কিছুটা ছাড় দেয়া হতে পারে। এর বাইরে দৃশ্যত সরকারি দলের ছাড় দেয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। কিছুদিন আগে একজন বিশ্লেষক প্রকাশ্যেই মন্তব্য করেছিলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে জরুরি অবস্থা জারি করা হতে পারে।
ভারতীয় বিশ্লেষক ড. শ্রীরাধা দত্ত ঢাকার একটি পত্রিকাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘বর্তমান সরকারের সময়ে বাংলাদেশে অনেক দারুণ কাজ হয়েছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ অনেক ভালো ভালো কাজ হয়েছে। তাই সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনে এ সরকারের আবার ক্ষমতায় ফিরে আসার কথা ছিল। কিন্তু বিগত কয়েক মাস বা এক বছর ধরে এ সরকারের মধ্যে একটি আশঙ্কার ব্যাপার লক্ষ্য করা যাচ্ছে।’ গেল কয়েক মাসে মাঠে বিরোধীদের কিছুটা ছাড় দেয়া হলেও সামনের দিনগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং আওয়ামী লীগ আরও কঠোর অবস্থান নিতে পারে। তবে মাঠ সামলালেই সরকারের হচ্ছে না। বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দুনিয়ার কার্যক্রমের ওপর বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হচ্ছে। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই মন্তব্য করা হয়েছে। নিয়ন্ত্রণ যদি কখনো আলগা হয়ে যায় শাসক দল কী করবে? তখন কি ছাড় দেয়ার ঘটনা ঘটবে? শাসন পদ্ধতি পরিবর্তন, জরুরি অবস্থা নানা গুজবই রয়েছে।
মোটাদাগে দেখলে মনে হয় বাংলাদেশের রাজনীতি কেবল সংঘাতের। এখানে সমঝোতার কোনো সম্ভাবনা বা সুযোগ নেই। তবে বিষয়টি পুরো সত্য নয়। ১৯৯০ সালে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করতে সক্ষম হয়েছিল। সে সমঝোতার বলেই তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হয়েছিলেন। পরে তিনি আবার প্রধান বিচারপতির পদে ফিরে আসেন। ১৯৯৬ সালেও তীব্র আন্দোলনের মুখে পর্দার আড়ালে এক ধরনের সমঝোতা হয়েছিল। যার আলোকে ত্রয়োদশ সংশোধনী সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, এবার কি সে ধরনের সমঝোতার কোনো সম্ভাবনা আছে। বিএনপি’র চাওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার। আওয়ামী লীগের চাওয়া সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ভারতের সংবাদপত্রকে বলেছেন, এর বাইরেও তার কাছে একটি ফর্মুলা আছে। তিনি তার ফর্মুলার ব্যাপারে খোলাসা করে কিছু বলেননি। তবে এটা বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যখন সংলাপ হবে তখন তিনি তা উপস্থাপন করবেন। জিএম কাদের সম্প্রতি ভারত সফর করে এসেছেন। তবে সে সফরের ব্যাপারে মিডিয়ায় খুব বেশি কিছু তিনি বলেননি।
ভাইয়ের মতো তাকেও ‘হাসপাতালে চিকিৎসা’ নিতে হয় কিনা সে আলোচনাও রয়েছে। কারণ তার ভারত সফরের সময়ই জাপায় চেয়ারম্যান পদ নিয়ে কয়েক ঘণ্টার নাটক হয়ে গেছে। অনেকে অবশ্য বলেন, এটা পরীমনির সংসারের মতো। এমন নাটক হতেই পারে। সে যাই হোক, জাতীয় পার্টির জনপ্রিয়তা হ্রাস পেলেও জিএম কাদের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আলোচনায় রয়েছেন। মার্কিন দূতাবাস তার সঙ্গে গেল কয়েক মাসে দফায় দফায় বৈঠক করেছে। আলোচনায় রয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে রাজনৈতিক সমঝোতার ভিত্তিতে এক ধরনের নির্বাচনকালীন সরকারেরও। এ ছাড়া, আইনবিদরা এটাও বলছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার মামলাটির রিভিউ এখনো ফাইল করা হয়নি। রাজনৈতিক সমঝোতা হলে আপিল বিভাগে এ ব্যাপারে রিভিউ দায়ের করা যেতে পারে। তারা স্মরণ করছেন, ওই মামলার সংক্ষিপ্ত আদেশে সুপ্রিম কোর্ট কিন্তু উল্লেখ করেছিল, দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে বিচার বিভাগকে এর বাইরে রাখার পরামর্শ দিয়েছিল। এর বাইরে আরেকটি দিকও কোনো কোনো আইনবিদ উল্লেখ করেছেন। রাজনৈতিক দলগুলো চাইলে নিরপেক্ষ ব্যক্তিদেরও নির্বাচিত করে নিয়ে আসতে পারে। এর সব ক্ষেত্রেই প্রথমত প্রয়োজন রাজনৈতিক সমঝোতা।
আপাতত রাজনৈতিক সমঝোতার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে বিএনপি। মিছিল আর সমাবেশের মতো কর্মসূচিই পালন করছে দলটি। অবশ্য সম্প্রতি ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে কঠোর পুলিশি অ্যাকশনের মুখে পড়ে বিএনপি। দলটির কিছু অভ্যন্তরীণ দুর্বলতাও নতুন করে সামনে আসে। যার জের ধরে পদ হারাতে হয় ছাত্রদল সভাপতিকে। বিএনপি’র বর্তমান কর্মসূচি কি সরকারের ওপর তেমন কোনো চাপ তৈরি করেছে। সামনের দিনগুলোতে কেমন কর্মসূচি আসছে? আন্দোলনে সফলতার সম্ভাবনাই বা কতোটুকু? বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এক নেতার কাছে সম্প্রতি এ ব্যাপারে জানতে চেয়েছিলাম।
তিনি জানালেন, সহসাই আরও জোরালো কর্মসূচি আসছে। বিশেষত সেপ্টেম্বর মাসকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। গত দুই নির্বাচনের আগে বিএনপি’র শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে এক ধরনের সংশয় ছিল। এবার সফলতার ব্যাপারে শীর্ষ নেতা আত্মবিশ্বাসী। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, শাসক দল এবং প্রশাসন হার্ডলাইনে গেলে বিএনপি কতোটা শক্ত অবস্থানে থাকবে তা নিয়ে নানা আলোচনা রয়েছে।
জামায়াত, হেফাজত এবং ইসলামী আন্দোলনের মতো ইসলামপন্থি দল বা সংগঠনগুলোর এবার নড়াচড়া কম। সরকার এবং বিরোধী দুই শিবিরের সঙ্গেই তাদের এক ধরনের যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। জামায়াতের নেতারা বলছেন, সরকারের সঙ্গে সমঝোতার কোনো সম্ভাবনা নেই। বিএনপি’র যুগপৎ আন্দোলনেও অবশ্য জামায়াত নেই। হেফাজত সরাসরি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে কখনো অংশ নেয়নি। ইসলামী আন্দোলন বিএনপি’র দাবির প্রতি সমর্থন জানালেও যুগপৎ আন্দোলনে যোগ দেয়নি। তবে সম্প্রতি ভারতের একাধিক পত্রিকার রিপোর্টে এটা স্পষ্ট হয় যে, ইসলামী দলগুলোর ব্যাপারে ভারতের এস্টাবলিসমেন্টের এক ধরনের আপত্তি রয়েছে।
বাংলাদেশের নির্বাচন অবশ্য এবার অনেকটাই আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। চীন ও রাশিয়ার অবস্থান স্পষ্ট। নির্বাচনকে তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় মনে করে। চীনের প্রেসিডেন্টও বলেছেন, চীন বাংলাদেশে বাইরের হস্তক্ষেপের বিরোধী। যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের পশ্চিমামিত্ররা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে তাদের অবস্থান বার বার ব্যক্ত করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এরইমধ্যে বাংলাদেশের ব্যাপারে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে। দেশটির পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে পারে তা নিয়ে নানা গুজব ছড়াচ্ছে প্রতিদিনই। ভারতের অবস্থান নিয়ে ভারতীয় পত্রিকায় নানামুখী ভাষ্য প্রকাশিত হচ্ছে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় আগামী মাসে অনেক কিছু স্পষ্ট হতে পারে।
২০১৪ সালের মতো একতরফা নির্বাচন। বিএনপি’র ভগ্নাংশকে নিয়ে নির্বাচন। বিলম্বিত নির্বাচন। নাটকীয় সমঝোতা। অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। দৃশ্যপটে নানা ছবি। রাজনীতি তো আর জ্যোতিষশাস্ত্র নয়। এখানে হলফ করে বলা কঠিন কী হবে। তবে এটি নিশ্চিত সামনের দিনগুলো হবে শ্বাসরুদ্ধকর।
No comments