Adsterra

পলাশীর বিশ্বাসঘাতকদের শেষ পরিণতি

পলাশীর বিশ্বাসঘাতকদের শেষ পরিণতি ঢাকা ভয়েজ  dhaka voice;


মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে কেউ ক্ষুর চালিয়েছেন নিজের গলায়, কেউ উন্মাদ হয়ে ঝাপ দিয়েছেন কূপেগলায় বালির বস্তা বেঁধে কাউকে নিক্ষেপ করা হয়েছে দুর্গের চূড়া থেকে কাউকে ডুবিয়ে মারা হয়েছে নদীর জলে মীরজাফর, ঘসেটি বেগম কিংবা লর্ড ক্লাইভ পলাশী যুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্রকারীরই স্বাভাবিক মৃত্যু হয় নি আজকের প্রতিবেদনে তুলে ধরা হবে প্রকৃতির নির্মম প্রতিশোধের চিত্র

 

মিরন

মিরন ছিলেন পলাশী ষড়যন্ত্রের অন্যতম নায়ক তার পুরো নাম মীর মুহাম্মদ সাদেক আলি খান তিনি মীরজাফরের জ্যেষ্ঠ পুত্র আলীবর্দী খানের ভগ্নী শাহ খানমের গর্ভে তাঁর জন্ম হয়েছিল এই সূত্রে মিরন ছিলেন আলিবর্দীর বোনপো অত্যন্ত দুর্বৃত্ত, নৃশংস হীনচেতা এবং সিরাজ হত্যাকাণ্ডের মূল নায়ক মিরন আমিনা বেগম, ঘষেটি বেগম হত্যার নায়কও তিনি লুৎফুন্নিসার লাঞ্ছনার কারণও মিরন মীর্জা মেহেদীকেও নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিলেন তিনি এই মিরনকে হত্যা করে ইংরেজদের নির্দেশে মেজর ওয়ালস তবে তার এই মৃত্যু ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার জন্যে ইংরেজরা মিথ্যা গল্প বানিয়েছিল তারা বলেছে, মিরন বিহারে শাহজাদা আলি গওহারের  সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে পথের মধ্যে বজ্রাঘাতে নিহত হন ইংরেজরা বলেছে, বজ্রপাতের ফলে তাঁবুতে আগুন ধরে যায় এবং তাতেই তিনি নিহত হন ফরাসী সেনাপতি লরিস্টনের ঔবধহখধি ঘটনাকে অস্বীকার করেছেন বরং এই মত পোষণ করেন যে, মিরনকে আততায়ীর দ্বারা হত্যা করা হয়েছিল

 

মুহাম্মদীবেগ

মুহাম্মদীবেগ জুলাই বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল নবাব সিরাজ সময় তার কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাননি তিনি কেবল তার কাছে থেকে দুরাকাত নামাজ পড়ার অনুমতি চেয়েছিলেন কিন্তু কুখ্যাত মুহাম্মদীবেগ নবাব সিরাজকে সে সুযোগ প্রত্যাখ্যান করার পরপরই তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে পরবর্তী পর্যায়ে মুহাম্মদী বেগের মস্তিস্ক বিকৃতি ঘটে, এমতবস্থায় সে বিনা কারণে কূপে ঝাঁপিয়ে পড়ে মৃত্যুবরণ করেছিল এই মুহাম্মদীবেগ সিরাজউদ্দৌলার পিতা মাতামহীর অন্নে প্রতিপালিত হয় আলীবর্দীর বেগম একটি অনাথ কুমারীর সাথে তার বিয়ে দিয়েছিলেন

 

মীরজাফর

পলাশী ষড়যন্ত্রের অন্যতম প্রধান নায়ক ছিলেন মীরজাফর আলি খান তিনি পবিত্র কোরআন মাথায় রেখে নবাব সিরাজের সামনে তাঁর পাশে থাকবেন বলে অঙ্গীকার করার পরও বেঈমানী করেছিলেন প্রকৃত পক্ষে ষড়যন্ত্রের মধ্যমণি ছিলেন জগৎশেঠ মীর জাফর নয় তিনি ছিলেন ষড়যন্ত্রের শিখণ্ডি মীরজাফরের মৃত্যু হয় অত্যন্ত মর্মান্তিকভাবে তিনি দুরারোগ্য কুষ্ঠব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন নিখিলনাথ রায় লিখেছেন, ক্রমে অন্তিম সময় উপস্থিত হইলে, হিজরী ১১৭৮ অব্দের ১৪ই শাবান ইংরেজিতে ১৭৬৫ সালের জানুয়ারী মাসে বৃহস্পতিবার তিনি কুষ্ঠরোগে ৭৪ বৎসর বয়সে পরলোকগত হন তাঁহার মৃত্যুর পূর্বে নন্দকুমার কিরীটেশ্বরীর চরণামৃত আনাইয়া তাহার মুখে প্রদান করাইয়াছিলেন এবং তাহার তাহাই শেষ জলপান


ঘষেটি বেগম

এই ঘসেটি বেগম ছিলেন পলাশীর যুদ্ধে সিরাউদ্দৌলার পরাজয়ের পেছনে একজন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, যার জীবনের শেষ দিনগুলো কেটেছিল ঢাকার কাছে একটি প্রাসাদে বন্দী অবস্থায়পলাশী যুদ্ধ পরবর্তীতে তিনিও নিজেও শিকার হয়েছিলেন প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের এই ষড়যন্ত্রের ফলস্বরূপ বুড়িগঙ্গায় ডুবে করুণ মৃত্যু হয় তার। ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে বাংলার মানুষের কাছে তিনি বরাবর ঘৃণিত এবং জটিল মানসিকতার প্রতীক এক চরিত্র

 

জগৎশেঠ মহাতাপচাঁদ এবং মহারাজা স্বরূপচাঁদ

পলাশী বিপর্যয়ের নীল নক্সা তিনিই প্রণয়ন করেন সিরাজের সাথে ইংরেজদের সংঘাত এবং তার বিপর্যয় পর্যন্ত সব কিছুর মধ্যমনি ছিলেন তিনি আলীবর্দী খাঁর শাসনামলেই জগৎশেঠের সাথে ইংরেজদের সম্পর্ক গভীর ছিল নবাব সিরাজ ক্ষমতায় এলে এই গভীরতা আরো বৃদ্ধি পেলো এবং তা ষড়যন্ত্রে রূপ নিলো পলাশী বিপর্যয়ের পর জগৎশেঠ রাজকোষ লুণ্ঠনে অংশ নেন নিখিলনাথ রায় লিখেছেন ইহার পর ক্রমে ইংরেজদিগের সহিত মীর কাসেমের বিবাদ গুরুতর হইয়া উঠিলে, নবাব কাটোয়া গিরিয়া, উধুয়ানালা প্রভৃতি স্থানে পরাজিত হইয়া মুঙ্গেরে জগৎশেঠ মহাতাপচাঁদকে অত্যুচ্চ দুর্গশিখর হইতে গঙ্গারগর্ভে নিক্ষেপ কর হয় মহারাজা স্বরূপচাঁদও সাথে ইহজীবনের লীলা শেষ করিতে বাধ্য হন

 

রবার্ট ক্লাইভ

নবাব সিরাজ বিরোধী ষড়যন্ত্রের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব ছিলেন রবার্ট ক্লাইভ ক্লাইভ খুব অল্প বয়সে ভারতে আসেন প্রথমে তিনি একটি ইংরেজ বাণিজ্য কেন্দ্রের গুদামের দায়িত্বে নিযুক্ত হন বিরক্তিকর এই কাজটিতে ক্লাইভ মোটেও সন্তুষ্ট ছিলেন না সময় জীবনের প্রতি তার বিতৃষ্ণা হতাশা জন্মে তিনি আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন তিনি রিভলভার দিয়ে নিজের কপালের দিকে লক্ষ্য করে পর পর তিনটি গুলী ছোঁড়েন কিন্তু গুলী থাকা অবস্থাতেই গুলী রিভলবার থেকে বের হয়নি পরে তিনি ভাবলেন ঈশ্বর হয়ত তাকে দিয়ে বড় কোন কাজ সম্পাদন করবেন বলেই এভাবে তিনি তাঁকে বাঁচালেন পরবর্তীতে দ্রুত তিনি ক্ষমতার শিখরে উঠতে শুরু করেন পরিশেষে পলাশী ষড়যন্ত্রে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি কোটি টাকার মালিক হন ইংরেজেরা তাকেপ্লাসি হিরোহিসেবে আখ্যায়িত করেন তিনি দেশে ফিরে গিয়ে একদিন বিনা কারণে বাথরুমে ঢুকে নিজের গলায় নিজের হাতেই ক্ষুর চালিয়ে আত্মহত্যা করেন

 

ইয়ার লতিফ খান

পলাশী ষড়যন্ত্রের শুরুতে ষড়যন্ত্রকারীরা ইয়ার লতিফ খানকে ক্ষমতার মসনদে বসাতে চেয়েছিলেন কিন্তু পরে এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে এক্ষেত্রে মীর জাফরের নাম উচ্চারিত হয় ইয়ার লতিফ খান ছিলেন নবাব সিরাজের একজন সেনাপতি তিনি এই ষড়যন্ত্রের সাথে গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন এবং যুদ্ধের মাঠে তার বাহিনী মীর জাফর, রায় দুর্লভের বাহিনীর ন্যায় ছবির মতো দাঁড়িয়েছিলো তার সম্পর্কে জানা যায়, তিনি যুদ্ধের পর অকস্মাৎ নিরুদ্দিষ্ট হয়ে যান অনেকের ধারণা, তাকে কে বা কারা গোপনে হত্যা করেছিল মুসলিম আমলে বাংলার শাসনকর্তা, আসকার ইবনে শাইখ, পরিশিষ্ট

 

মহারাজা নন্দকুমার

মহারাজা নন্দকুমার এই ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন মুর্শিদাবাদ কাহিনী গ্রন্থে নিখিলনাথ রায় লিখেছেন- নন্দকুমার অনেক বিবেচনার পর সিরাজের ভবিষ্যৎ বাস্তবিকই ঘোরতর অন্ধকার দেখিয়া, ইংরেজদিগের সহিত বন্ধুত্ব স্থাপনের ইচ্ছা করিলেন ইংরেজ ঐতিহাসিকগণ বলিয়া থাকেন যে, ইংরেজরা সেই সময়ে উমিচাঁদকে দিয়া নন্দকুমারকে ১২ হাজার টাকা প্রদান করিয়াছিলেন পলাশী ষড়যন্ত্রের পর নন্দকুমারকে মীরজাফর স্বীয় দেওয়ান নিযুক্ত করে সব সময় তাকে নিজের কাছে রাখতেন মীরজাফর তার শেষ জীবনে যাবতীয় কাজকর্ম নন্দকুমারের পরামর্শানুসারে করতেন তার অন্তিম শয্যায় নন্দকুমারই তার মুখে কিরীটেশ্বরীর চরণামৃত তুলে দিয়েছিলেন তহবিল তছরূপ অন্যান্য অভিযোগের প্রেক্ষিতে আদালত মহারাজা নন্দকুমারের প্রাণ দণ্ডের আদেশ প্রদান করে

 

 

 

রায় দুর্লভ

রায় দুর্লভ ছিলেন নবাবের একজন সেনাপতি তিনিও মীরজাফরের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন যুদ্ধকালে তিনি এবং তার বাহিনী মীরজাফররের সাথে যুক্ত হন এবং সেখানেই তার মৃত্যু ঘটে

 

উমিচাঁদ

ক্লাইভ কর্তৃক উমিচাঁদ প্রতারিত হয়েছিলেন ইয়ার লতিফ খান ছিলেন উমিচাঁদের মনোনীত প্রার্থী কিন্তু যখন অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারীরা ক্ষেত্রে মীরজাফরের নাম ঘোষণা করলেন, তখন উমিচাঁদ বেঁকে বসলেন এবং বললেন, আপনাদের প্রস্তাব মানতে পারি এক শর্তে, তা হলো যুদ্ধের পর নবাবের রাজকোষের ভাগ সম্পদ আমাকে দিতে হবে ক্লাইভ তার প্রস্তাব মানলেন বটে কিন্তু যুদ্ধের পরে তাকে তা দেয়া হয়নি যদিও ব্যাপারে একটি মিথ্যা চুক্তি হয়েছিল ওয়াটস রমণী সেজে মীর জাফরের বাড়িতে গিয়ে লাল সাদা কাগজে দুটি চুক্তিতে তার সই করান লাল কাগজের চুক্তিতে বলা হয়েছে, নবাবের কোষাগারের পাঁচ শতাংশ উমিচাঁদের প্রাপ্য হবে এটি ছিল নিছক প্রবঞ্চনামাত্র যাতে করে উমিচাঁদের মুখ বন্ধ থাকে যুদ্ধের পর ক্লাইভ তাকে সরাসরি বলেন, আপনাকে কিছু দিতে পারবো না কথা শুনে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন এবং স্মৃতিভ্রংশ উন্মাদ অবস্থায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে তার মৃত্যু ঘটে

 

রাজা রাজবল্লভ

ষড়যন্ত্রকারী রাজা রাজবল্লভের মৃত্যুও মর্মান্তিকভাবে ঘটেছিল জানা যায়, রাজা রাজবল্লভের কীর্তিনাশ করেই পদ্মা হয় কীর্তিনাশা


দানিশ শাহ বা দানা শাহ

দানিশ শাহ সম্পর্কে বিতর্ক রয়েছে অনেকে বলেছেন, এই দানেশ শাহ নবাব সিরাজকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় লিখেছেন, দানিশাহ ফকির মোটেই জীবিত ছিলেন না আসকার ইবনে শাইখ তাঁর মুসলিম আমলে বাংলার শাসন কর্তা গ্রন্থে লিখেছেনবিষাক্ত সর্প দংশনে দানিশ শাহর মৃত্যু ঘটেছিল

 

ওয়াটস

ওয়াটস এই ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি রমণী সেজে মীর জাফরের বাড়িতে গিয়ে চুক্তিতে মীরজাফরের স্বাক্ষর এনেছিল যুদ্ধের পর কোম্পানীর কাজ থেকে বরখাস্ত হয়ে মনের দুঃখে অনুশোচনায় অকস্মাৎ মৃত্যুমুখে পতিত হন। যড়যন্ত্রকারী ওয়াটসন ক্রমাগত ভগ্নস্বাস্থ্য হলে কোন ওষুধেই ফল না পেয়ে কলকাতাতেই করুণ মৃত্যুর মুখোমুখি হন

  

স্ক্রাফটন

ষড়যন্ত্রের পিছনে স্ক্রাফটনও বিশেষভাবে কাজ করেছিলেন জানা যায়, বাংলার বিপুল সম্পদ লুণ্ঠন করে বিলেতে যাওয়ার সময় জাহাজডুবিতে তার অকালমৃত্যু ঘটে

 

মীর কাশিম

মীরজাফরের ভাই রাজমহলের ফৌজদার মীর দাউদের নির্দেশে মীর কাশিম নবাব সিরাজের খবর পেয়ে ভগবানগোলার ঘাট থেকে তাকে বেঁধে এনেছিলেন মুর্শিদাবাদে পরে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তিনি নবাব হন এবং সময় ইংরেজদের সাথে তার বিরোধ বাঁধে কয়েকটি যুদ্ধে পরাজিত হন পরে ইংরেজদের ভয়ে হীনবেশে পালিয়ে যান এবং রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ান।। অবশেষে অজ্ঞাতনামা হয়ে দিল্লীতে তার করুণ মৃত্যু ঘটে মৃতের শিয়রে পড়ে থাকা একটা পোটলায় পাওয়া যায় নবাব হিসেবে ব্যবহৃত মীর কাশেমের চাপকান থেকেই জানা যায় মৃত ব্যক্তি বাংলার ভূতপূর্ব নবাব মীর কাশিম আলী খান

 

এই ভাবেই বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীরা পলাশী যুদ্ধের কিছুকালের মধ্যেই বিভিন্ন পন্থায় মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুমুখে পতিত হন পলাশী ষড়যন্ত্রকারীদের ওপরে আল্লাহর গজব নাজিল হয়েছিল বলেই অনেকের ধারণা আসলে এইসব ঘটনা থেকেই আমাদের অনেক কিছু শেখার বিষয় রয়েছে

 

 

 

No comments

Powered by Blogger.