মারা গেছেন একাত্তরের দেইল্লা রাজাকার ওরফে আল্লামা সাঈদী
মারা গেছেন একাত্তরের দেইল্লা রাজাকার ওরফে আল্লামা সাঈদী। একাত্তরের আগে মুদি দোকানদার ও তাবিজ বিক্রেতা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলে হয়ে গেলেন প্রথমে শান্তি কমিটির সদস্য ও পরে রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার।
নিজে জড়িত থেকে, নেতৃত্ব বা সহযোগিতা দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং রাজাকার
বাহিনী নিয়ে সংঘটিত করলেন হত্যাযজ্ঞ, অগ্নিসংযোগ, লুট, ধর্ষণসহ জঘণ্যতম মানবতাবিরোধী নানা অপরাধ। আগের ‘দেইল্লা’ নামের সঙ্গে তাই
রাজাকার যুক্ত হয়ে তিনি কুখ্যাত হলেন ‘দেইল্লা রাজাকার’ নামে।
মুক্তিযুদ্ধের পরে দীর্ঘদিন পালিয়ে থাকার পর আবির্ভুত হলেন ‘আল্লামা মাওলানা’ পরিচয়ে। ওয়াজ করে
বেড়ালেন দেশে-বিদেশে। কালক্রমে হলেন যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতের নায়েবে আমির।
এভাবেই বাবা-মায়ের দেওয়া দেলোয়ার হোসেন শিকদার ওরফে ‘দেইল্লা’ বা ‘দেইল্লা রাজাকার’ নামক ব্যক্তিটি
হয়ে গেলেন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী।
তবে একাত্তরের অপরাধ ঢেকে নতুন পরিচিতি পেতে তিনি দাখিল পাসের
সনদপত্র জালিয়াতি করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ অভিযোগের তদন্ত করে সত্যতা পেয়েছে
সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গঠিত উপ-কমিটি। তদন্তকালে ওই উপ-কমিটি খুঁজে পেয়েছেন আরও কয়েক
ধাপে নাম পাল্টানোর আরও ঘটনাও। কেননা, মাত্র ১০ বছরে পাস করা কথিত দাখিল পাসের সনদপত্রে তার নাম দেখানো
হয় মোস্তফা দেলাওয়ার হোসাইন। আলিমের সনদপত্রেই সেটা হয়ে যায় আবু নাঈম মো. দেলাওয়ার
হোসাইন। আর জালিয়াতি করে জন্ম তারিখের পাশাপাশি এসব নামকেও পাল্টে করা হয়
দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী।
তাবিজ বিক্রেতা থেকে রাজাকার
কমান্ডার
বর্তমানে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী পিরোজপুর
জেলার তৎকালীন ইন্দুরকানীর (বর্তমানে জিয়ানগর উপজেলা) সাউথখালী গ্রামে ১৯৪০ সালের
২ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম ইউসুফ আলী শিকদার। তার প্রকৃত নাম
দেলোয়ার হোসেন শিকদার। তাকে সবাই ‘দেইল্লা’ নামে চিনতেন। জামায়াতের ছাত্র রাজনীতি করার কারণে সাঈদী শর্ষিনা
মাদ্রাসা থেকে বহিষ্কৃত হন। পরে বারইপাড়া মাদ্রাসা থেকে তৃতীয় বিভাগে আলিম পাস
করেন। এরপর উচ্চতর ডিগ্রি না নিলেও নামের সঙ্গে আল্লামা টাইটেল ব্যবহার করছেন।
মুক্তিযুদ্ধের আগে শ্বশুর বাড়িতে ঘরজামাই থাকতেন সাঈদী। সংসার
চালানোর জন্য পারেরহাটে তার একটি ছোট মুদি দোকান থাকলেও তিনি মূলত তাবিজ বিক্রি
করতেন।
অভিযোগ করা হয়েছে, সাঈদী ছিলেন আরবি ও উর্দু ভাষায় পারদর্শী এবং বাকপটু। এটাকে
ব্যবহার করে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে তিনি সখ্য এবং
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন এজাজের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করেন।
এ কারণে তিনি রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার হতে সক্ষম হন। অবশ্য মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর
পরই তিনি ছিলেন শান্তি কমিটির সদস্যও। তার নেতৃত্বে এবং তার সহযোগিতায় পিরোজপুরের
পারেরহাট বন্দরসহ বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং রাজাকার বাহিনী
হত্যাযজ্ঞ,
অগ্নিসংযোগ, লুট, ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত করে।
২ অভিযোগে ফাঁসির আদেশ
সাঈদীর বিরুদ্ধে গঠন করা অভিযোগ, ৮৮ পৃষ্ঠার সূচনা বক্তব্য এবং
৭৭ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন বা আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্রে একাত্তরের মহান
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিন হাজারেরও বেশি নিরস্ত্র ব্যক্তিকে হত্যা বা হত্যায়
সহযোগিতা,
নয়জনেরও বেশি নারীকে ধর্ষণ, বিভিন্ন বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট, ভাঙচুর এবং ১০০
থেকে ১৫০ হিন্দুকে ধর্মান্তরে বাধ্য করার ২০টি ঘটনার অভিযোগ আনা হয়।
এগুলোর মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীত ভাবে ৮টি অভিযোগই প্রমাণ করতে
পারায় বৃহস্পতিবার সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ
ট্রাইব্যুনাল-১। এর মধ্যে দু’টি অভিযোগে অর্থাৎ ৮ ও ১০ নং অপরাধে সাঈদীর মৃত্যুদণ্ড হয়েছে।
এছাড়া ৬, ৭, ১১, ১৪, ১৬ ও ১৯নং অভিযোগ
প্রমাণিত হলেও এগুলোতে কোনো সাজার কথা ঘোষণা করেননি ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনাল
জানান, দুই অভিযোগে
সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়ায় বাকিগুলোতে আর সাজা দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে
সহযোগিতা করার জন্য তার নিজ এলাকায় আলবদর, আলশামস এবং রাজাকার বাহিনী গঠন করেন এবং তাদের সরাসরি সহযোগিতা
করেন। সে সময় তিনি সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা ছিলেন না। তবে তথাকথিত মওলানা
হিসেবে তিনি তার স্বাধীনতাবিরোধী তৎপরতা পরিচালনা করেছেন। পবিত্র ধর্মের দোহাই
দিয়ে একজন ‘মওলানা’ হিসেবে নিজেকে
পরিচয় দিয়ে পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময় সাঈদী নানা অপকর্ম করেছেন বলে অভিযোগ করা
হয়েছে।
পিরোজপুরে মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা, হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, লুটতরাজসহ নানা
যুদ্ধাপরাধের অন্যতম হোতা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী। নিজে নেতৃত্ব দেওয়া ছাড়াও
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে গণহত্যা ও নির্যাতনে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করেছেন
সাঈদী।
ধর্ষণ
অভিযোগগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, সাঈদী
মুক্তিযুদ্ধকালে পারেরহাট বন্দরের বিপদ সাহার মেয়ে ভানু সাহাকে নিয়মিত যৌন
নির্যাতন করতেন। বিপদ সাহার বাড়িতেই আটকে রেখে অন্যান্য রাজাকারসহ সাঈদী ভানু
সাহাকে নিয়মিত ধর্ষণ করতেন বলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়। এক সময় ভানু সাহা দেশ
ত্যাগে বাধ্য হন। বর্তমানে তিনি ভারতে অবস্থান করছেন।
মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে সাঈদীর নেতৃত্বে একদল রাজাকার পিরোজপুরের
হুগলাবুনিয়া গ্রামে হানা দেয়। রাজাকারদের আগমন দেখে গ্রামের অধিকাংশ হিন্দু নারী
পালিয়ে যান। কিন্তু মধুসূদন ঘরামীর স্ত্রী শেফালী ঘরামী ঘর থেকে বের হতে পারেননি।
তখন সাঈদীর নেতৃত্বে রাজাকাররা তাকে ধর্ষণ করেন। এর ফলে স্বাধীনতার পর তিনি একটি
কন্যা সন্তান প্রসব করেন। এ নিয়ে গ্রামে বিভিন্ন কথা ওঠায় শেফালী ঘরামী দেশ ছেড়ে
ভারতে চলে যেতে বাধ্য হন।
এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ শেষের দিকের কোনো একদিন ১০/১২ জন রাজাকারের
বাহিনী নিয়ে পাড়েরহাট বাজারের গৌরাঙ্গ সাহার বাড়িতে যান সাঈদী। সেখানে তার ৩ বোন
মহামায়া, অন্ন রানী ও কমলা
রানীকে আটক করে পিরোজপুরে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে প্রেরণ এবং সেখানে তাদেরকে
৩ দিন আটকে রেখে ধর্ষণ করার অভিযোগও আনা হয়েছে সাঈদীর বিরুদ্ধে।
পিরোজপুরের বিখ্যাত তালুকদার বাড়িতে লুটতরাজ শেষে ওই বাড়ি থেকে
২০-২৫ জন মহিলাকে ধরে এনে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে পাঠানোর অভিযোগও করা হয়েছে
সাঈদীর বিরুদ্ধে।
ধর্মান্তর
সাঈদীর নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর
বিভিন্নভাবে নির্যতন চালাতো। তাদের বাড়ি-ঘর লুট করাসহ আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিত। পরে
লোকজন সর্বস্ব হারিয়ে ভারতের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেন। আর যারা যেতে পারেননি, তাদের সাঈদী
ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করেন। তাদের নিয়ে তিনি মসজিদে নামাজ পড়তেন। তাদের মুসলমান
নামও দেন তিনি।
অভিযোগ করা হয়েছে, যুদ্ধ চলাকালে সাঈদী প্রভাব খাটিয়ে পারেরহাটসহ অন্য গ্রামের
১০০-১৫০ জন হিন্দুকে এভাবে ইসলাম ধর্মে রূপান্তর করেন। তাদের মসজিদে গিয়ে নামাজ
পড়তে বাধ্য করা হতো।
হত্যা-গণহত্যা, লুটপাট-অগ্নিসংযোগ
অভিযোগ করা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ৪ মে সকাল বেলা পিস কমিটির মেম্বার হিসাবে সাঈদীর
নেতৃত্বে মধ্য মাছিমপুর বাসস্ট্যান্ডের পেছনে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য জমায়েত
হওয়া ২০ জন বেসামরিক ব্যাক্তিকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়।
একই সময়ে মাছিমপুর হিন্দুপাড়ায় প্রকাশ্য দিবালোকে পাকিস্তানি
সেনাদের সহায়তায় লুটপাট করে তাদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেন এবং পলায়নরত অজ্ঞাত
সংখ্যক ব্যক্তিদের মধ্য থেকে পূর্ব পরিকল্পিত ভাবে শরত চন্দ্র মন্ডল, বিজয় মিস্ত্রি, উপেন্দ্রনাথ, জগেন্দ্রনাথ
মিস্ত্রি,
সুরেন্দ্রনাথ মিস্ত্রি, মতিলাল মিস্ত্রি, জগেশ্বর মণ্ডল, সুরেশ মণ্ডলসহ অজ্ঞাতনামা ৫ জনসহ আরও ১৩ জনকে হত্যা করেন সাঈদী ও
তার সহযোগীরা। এরপর সাঈদী নেতৃত্ব দিয়ে এলজিইডির পেছনে ধোপা বাড়ির নিকটস্থ
হিন্দুপাড়ায় ঢুকে দেবেন্দ্রনাথ মণ্ডল, জগেন্দ্রনাথ মণ্ডল, পুলিন বিহারী ও মুকুন্দ বালাকেও গুলি করে হত্যা করেন।
এর পর তারা কালিবাড়ি, মাছিমপুর, পালপাড়া, শিকারপুর, রাজারহাট, কুকারপাড়া, ডুমুরতলা, কদমতলা, নবাবপুর, আলমকুঠি, ঢুকিগাতি, পারেরহাট এবং চিংড়াখালী গ্রামে ধর্মীয় কারণে বেসামরিক জনগোষ্ঠির
বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে।
এছাড়া অভিযোগ করা হয়েছে, সাঈদীর পরামর্শ, পরিকল্পনা এবং প্রণীত তালিকা অনুযায়ী এলাকার বুদ্ধিজীবী ও
ছাত্রদের পাইকারি হারে নিধন করা হয়।
সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মিজানুর রহমান, স্কুলের প্রধান শিক্ষক আব্দুল
গাফফার মিয়া,
সমাজসেবী শামসুল হক ফরাজী, অতুল কর্মকার প্রমুখ সরকারি কর্মকর্তা ও বুদ্ধিজীবীদেরও সাঈদীর
প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। সাঈদী এবং তার সহযোগীরা
পিরোজপুরের মেধাবী ছাত্র গণপতি হালদার, তদানীন্তন ইপিআর সুবেদার আব্দুল আজিজ এবং পারেরহাট বন্দরের
কৃষ্ণকান্ত সাহা, বাণীকান্ত সিকদার ও তরণীকান্ত সিকদারসহ আরো অনেক ব্যবসায়ীকেও ধরে
নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছেন।
৭ মে পাকিস্তান আর্মিরা পারেরহাটে এলে সাঈদী শান্তি কমিটির সদস্য
হিসেবে তাদের স্বাগত জানান। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কারণে পারেরহাটের আওয়ামী লীগ নেতা ও
হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি-ঘরে প্রবেশ করে তিনি মাখন লাল সাহার দোকান থেকে ২২ সের
সোনা ও রুপা লুট করে নেন।
৮ মে বেলা দেড়টার দিকে আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল ইসলাম খান সেলিমের
পুত্র শহিদুল ইসলামের বাড়িতে প্রবেশ করে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেন সাঈদীরা। এরপর
দুপুর ৩টার দিকে তারা মানিক পশারীর বাড়িতে প্রবেশ করেন এবং সেখান থেকে মফিজ উদ্দিন
ও ইব্রাহিম কুট্টিকে আটক করে নিয়ে আসেন। এর পর মানিক পশারীর বাড়িতে লুটপাট ও
অগ্নিসংযোগ করা হয়। অাটককৃত মফিজ উদ্দিন ও ইব্রাহিম কুট্টিকে নিয়ে এসে পাড়েরহাট
বন্দরে ইব্রাহিম কুট্টিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আর মফিজউদ্দিনকে রাজলক্ষী
হাইস্কুলের রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন চালানো হয়। নির্যাতনের এক পর্যায়ে
সে পালিয়ে আসেন মফিজ উদ্দিন।
২ জুন সকাল ৯টায় সাঈদীর নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনারা নলবুনিয়ায়
আবদুল হালিম বাবুলের বাড়ি থেকে মূল্যবান জিনিসপত্র লুট ও অগ্নিসংযোগ করে। এরপর
তারা উমেদপুর হিন্দুপাড়ায় প্রবেশ করে ২৫টি বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়ে বিশা বালীকে গুলি
করে হত্যা করে।
২ জুন পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে নিয়ে টেংরাখালী গ্রামের মাহবুবুল
আলম হাওলাদারের বাড়িতে যান সাঈদী। তারা মাহবুবের ভাই আব্দুল মজিদ হাওলাদারকে আটক ও
নির্যাতন এবং বাড়িতে স্বর্ণালঙ্কারসহ নগদ টাকা লুট ও ভাঙচুর করে।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার ২/৩ মাস পরে একদিন পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে নিয়ে
নলবুনিয়া গ্রামের আজহার আলীর বাড়িতে যান সাঈদী। সেখানে আজহার আলী ও তার ছেলে সাহেব
আলীকে নির্যাতনের পর সাহেব আলীকে পিরোজপুরে পাঠান। সেখানে সাহেব আলীকে গুলি করে
হত্যা করা হয়।
জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে সাঈদী মুক্তিযোদ্ধা মিজান তালুকদারের
বাড়িতে হামলা চালান। তারা মিজানের বড়ো ভাই আব্দুল মান্নান তালুকদারকে ধরে পারেরহাটে
পিস কমিটির অফিসে নিয়ে যান। সেখানে তার ওপর সাঈদী পাশবিক নির্যাতন চালান এবং তার
ভাই মুক্তিযোদ্ধা মিজান তালুকদার কোথায় আছে জানতে চান ও তার সন্ধান দিতে বলেন।
মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে সাঈদীর নেতৃত্বে ১৫-২০ জনের রাজাকার দল
হোগলাবুনিয়া গ্রামের ১৪ জন হিন্দু নাগরিককে ধরে। পাকিস্তানি সেনারা তাদের সবাইকে
হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়।
সাঈদীর সহযোগিতায় পিরোজপুরের হিমাংশু সাহার ভাই ও আত্মীয়-স্বজনকে
হত্যা করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করেছেন রাষ্ট্রপক্ষ।
নভেম্বরের শেষ দিকে সাঈদী খবর পান, সাধারণ মানুষ ভারতে পালিয়ে যাচ্ছে।
তার নেতৃত্বে ১০-১২ জনের একটি সশস্ত্র দল পরিকল্পিতভাবে ইন্দুরকানি গ্রামের
তালুকদার বাড়িতে আক্রমণ চালায়। ৮৫ জন ব্যক্তিকে আটক করে তাদের কাছ থেকে মালামাল
কেড়ে নেওয়া হয়। ১০-১২ জন বাদ দিয়ে বাকিদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।
রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ, মুক্তিযুদ্ধের সময় সাঈদী তার এলাকায় অপর চারজন সহযোগী নিয়ে ‘পাঁচ তহবিল’ নামে একটি সংগঠন
গড়ে তোলেন,
যাদের প্রধান কাজ ছিল মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী বাঙালি
হিন্দুদের বাড়িঘর জোরপূর্বক দখল করা এবং তাদের সম্পত্তি লুট করা। লুট করা এ সমস্ত
সম্পদকে সাঈদী ‘গনিমতের মাল’ আখ্যায়িত করে নিজে ভোগ করতেন এবং পারেরহাট বন্দরে এসব বিক্রি করে
ব্যবসা পরিচালনা করতেন।
তিনি ধর্মের দোহাই দিয়ে পারেরহাট বন্দরের হিন্দু সম্প্রদায়ের
ঘরবাড়ি লুট করেছেন ও নিজে মাথায় বহন করেছেন এবং মদন নামে এক হিন্দু ব্যবসায়ীর
বাজারের দোকানঘর ভেঙে তার নিজ বাড়িতে নিয়ে গেছেন।
বাজারের বিভিন্ন মনোহরি ও মুদি দোকান লুট করে লঞ্চঘাটে দোকানও
দিয়েছিলেন সাঈদী। সাঈদী এবং তার সহযোগীরা পিরোজপুরের নিখিল পালের বাড়ি তুলে এনে
পারেরহাট জামে মসজিদের ‘গণিমতের মাল’ হিসেবে ব্যবহার করেন। মদন সাহার বাড়ি উঠিয়ে নিয়ে সাঈদী তার
শ্বশুরবাড়িতে স্থাপন করেন। পারেরহাটের আনোয়ার হোসেন, আবু মিয়া, নূরুল ইসলাম খান, বেনীমাধব সাহা, বিপদ সাহা
প্রমুখের বসতবাড়ি, গদিঘর ও সম্পত্তিও এই সাঈদী লুট করে নেন।
প্রমাণিত হয়নি হুমায়ূনের
পিতাকে হত্যার অভিযোগ
ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়েছে, অভিযোগ আনলেও রাষ্ট্রপক্ষ
সাঈদীর বিরুদ্ধে লেখক হুমায়ূন আহমেদ ও মুহম্মদ জাফর ইকবালের বাবা পুলিশ কর্মকর্তা
ফয়জুর রহমান আহমেদকে হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগটি প্রমাণ করতে পারেননি।
এজন্য ওই অভিযোগটি থেকে আসামি সাঈদীকে খালাস দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগটি করা হয় সাঈদীর বিরুদ্ধে আনা ৫ নম্বর অভিযোগে।
এ অভিযোগটিতে বলা হয়েছে, ৫ মে পিরোজপুরে বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ ও মুহাম্মদ
জাফর ইকবালের বাবা মহাকুমা পুলিশ কর্মকর্তা (এসডিপিও) ফয়জুর রহমান, পিরোজপুরের
তৎকালীন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সাঈফ মিজানুর রহমান এবং ভারপ্রাপ্ত মহাকুমা প্রশাসক
(এসডিও) আব্দুর রাজ্জাককে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সাঈদী ও রাজাকারদের সহায়তায় হত্যা
করে।
আরও বলা হয়েছে, তৎকালীন পিরোজপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সাইফ মিজানুর রহমান
সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। এজন্য সাঈদী তাকে প্রকাশ্যে আটকের ঘোষণা দিয়েছিলেন।
সাঈদী ও তার সহযোগী শান্তি কমিটির সদস্য মন্নাফ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা সদস্যকে
নিয়ে ৫ মে পিরোজপুর হাসপাতালের পেছন থেকে তাকে ধরে বলেশ্বর নদের তীরে নিয়ে যান।
একই দিনে পুলিশ কর্মকর্তা ফয়জুর রহমান আহমেদ (লেখক হুমায়ূন আহমেদ ও মুহম্মদ জাফর
ইকবালের বাবা) এবং ভারপ্রাপ্ত এসডিও আবদুর রাজ্জাককেও কর্মস্থল থেকে ধরা হয়। পরে
আর্মিদের জিপে চড়িয়ে বলেশ্বর নদীর ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। সাঈদীর উপস্থিতিতে এ তিন
সরকারি কর্মকর্তাকে গুলি করে লাশ বলেশ্বর নদে ফেলে দেওয়া হয়। হত্যার পরদিন সাঈদীর
বাহিনী পিরোজপুরে ফয়জুর রহমান আহমেদের বাড়ি সম্পূর্ণ লুট করে নিয়ে যায়।
রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে পারেননি আলোচিত ভাগীরথী সাহা হত্যায়
সংশ্লিষ্টতার অভিযোগও। এতে বলা হয়, যুদ্ধকালে ভাগীরথী সাহা পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে কাজ করতেন।
সাঈদী এক দিন খবর দেন, ভাগীরথী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়মিত নানা খবরা-খবর দেন। পাকিস্তানি
সেনারা তাকে মোটরসাইকেলের পেছনে বেধে পাঁচ মাইল পথ টেনে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা
করে লাশ বলেশ্বর নদে ফেলে দেয়।
দেইল্লা রাজাকার থেকে আল্লামা
সাঈদী!
রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ, সাঈদীর আসল নাম দেলোয়ার হোসেন শিকদার। একাত্তরের আগে তিনি
পিরোজপুরে এ নামেই পরিচিত ছিলেন। লোকে তাকে প্রথমে ‘দেইল্লা’ এবং
মুক্তিযুদ্ধকালে যুদ্ধাপরাধের জন্য ‘দেইল্লা রাজাকার’ নামেও চিনতেন। স্বাধীনতার পর একাত্তরের ১৯ ডিসেম্বর তিনি নিজের
অপরাধকে আড়াল করার জন্য বোরকা পরে গরুর গাড়িতে চড়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। পরে
অস্ত্রসহ যশোরের মো. রওশন আলীর বাড়িতে আত্মগোপন করেন। অনেকদিন পর তার অপরাধের
কাহিনী জানাজানি হলে তিনি পরিবার নিয়ে অন্যত্র চলে যান।
এরপর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর তিনি
আত্মগোপন অবস্থা থেকে বের হয়ে আসেন এবং ভুয়া মাওলানা পরিচয়ে ওয়াজ মাহফিল শুরু
করেন। নিজের নাম পাল্টে করেন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। এভাবেই তিনি আল্লামা মাওলানার
পরিচয়ে নিজের অপরাধ ঢাকার চেষ্টা করেন।
১০ বছরে দাখিল পাস!
এদিকে নিজেকে আল্লামা মাওলানা ও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী প্রমাণে এই
যুদ্ধাপরাধী দাখিল পাসের সনদপত্র জালিয়াতি করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
উল্লেখ্য, দাখিলের সনদপত্রে তার নাম ছিল মোস্তফা দেলাওয়ার হোসাইন। আলিমের
সনদপত্রে সেটা ছিল আবু নাঈম মো. দেলাওয়ার হোসাইন। আগের দাখিল সনদপত্র অনুযায়ী
সাঈদীর জন্ম তারিখ দেখানো হয়েছিল ১৯৪৭ সালের ৩ মার্চ। আর সেখানে তার দাখিল পাসের
বছর দেখানো হয়েছিল ১৯৫৭ সালে। সে হিসেবে তিনি দাখিল পাস করেন মাত্র ১০ বছর বয়সে!
জালিয়াতির মাধ্যমে তার নাম পরিবর্তন করে করা হয়েছে দেলাওয়ার হোসাইন
সাঈদী। অন্যদিকে সনদপত্রে ঘষামাজা করে দাখিলে তার বয়স করা হয় ১৬ বছর। আলিমে ১৯
বছর করা হয়।
জানা গেছে, সাঈদীর দাখিল ও আলিম পরীক্ষা পাসের সনদপত্র ও জন্ম তারিখ সংশোধন
করা হয়েছে কথিত পরীক্ষার যথাক্রমে ৪৮ ও ৫১ বছর পর। উল্লেখ্য, পাবলিক পরীক্ষার
আইন অনুযায়ী পাস করার দুই বছরের মধ্যে একজন উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর বয়স সংশোধন করা
যায়। কিন্তু দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী নাম ও বয়স পাল্টেছিলেন পাস করার ৫১ বছর পর।
অভিযোগ রয়েছে, ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সময় মনোনয়নপত্রে এসব
অসঙ্গতি ধরা পড়তে পারে তা বুঝতে পেরে ওই বছরের ১০ নভেম্বর মাত্র ৪ ঘণ্টার মধ্যে
মাদ্রাসা বোর্ড থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে নাম ও বয়স পরিবর্তন করে সংশোধিত সনদপত্র
বের করে আনা হয়। এ দুর্নীতি ও সনদ জালিয়াতির সঙ্গে মাদ্রাসা বোর্ডের কর্মকর্তারাও
জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।
তাই তিনি আদৌ দাখিল পাস করেছেন কি না সেটা নিয়েও প্রশ্ন দেখা
দিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, স্বঘোষিত এই “আল্লামা”পরীক্ষা না দিয়েই সরকারি নীতিমালা ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা
তৎকালীন মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড থেকে ১০ বছর বয়সে দাখিল পাসের সনদপত্র বের করে
এনেছেন।
গত বছরের ১২ আগস্ট সাঈদীর নাম ও বয়স পাল্টানোর অভিযোগের তদন্ত করতে
একটি উপ-কমিটি গঠন করে জাতীয় সংসদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি।
কমিটির সদস্য আব্দুল ওহাবকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের এ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির
অন্য সদস্যরা হলেন- মো. শাহ আলম ও বীরেন শিকদার। তদন্ত কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা দেন
ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ফাহিমা খাতুন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত
সচিব গোলাম ফারুক।
এ উপ-কমিটি দীর্ঘ তদন্ত করে সাঈদীর বিরুদ্ধে এ অভিযোগের সত্যতা
পেয়ে স্থায়ী কমিটির কাছে তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করে গত ২১ জানুয়ারি। তবে উপ-কমিটি
জালিয়াতি পেলেও তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে সাঈদীর সনদ বাতিল করার সুপারিশ এবং নাম ও
বয়স পাল্টানোর ঘটনায় জড়িত মাদ্রাসা বোর্ডের কর্মকর্তাদের শাস্তির সুপারিশ না থাকায়
প্রতিবেদনটি ফেরত পাঠানো হয়েছে।
এর আগে, সাঈদীর দশ বছর বয়সে দাখিল পাস ও পাস করার ৫১ বছর পর নাম ও বয়স
পাল্টানোর খবরটি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হলে শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশে শিক্ষা সচিব
মাদ্রাসা বোর্ডের কাছে প্রকাশিত খবরটির বিষয়ে সব কাগজপত্র তলব করেন।
No comments