জগজিৎ সিং অরোরা || মুক্তিযুদ্ধে বিদেশির অবদান
জগজিৎ সিং অরোরা || মুক্তিযুদ্ধে বিদেশির অবদান
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ কমান্ডের অন্যতম অধিনায়ক লে জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার নাম অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সাথে জড়িয়ে আছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে লে জেনারেল আরোরার কৃতিত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ ও বীরত্বপূর্ণ ফলাফলের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীরপ্রতীক পদকে ভূষিত করে সম্মানিত করে।
জগজিৎ সিং অরোরা ১৯১৬ সালের
১৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে পাকিস্তানের ঝিলামে সম্ভ্রান্ত শিখ পরিবারে
জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর জেনারেল ছিলেন। জগজিৎ সিং অরোরা ১৯৩৯
সালে ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমি থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ২য় পাঞ্জাব
রেজিমেন্টে কমিশন পদ পান। ১৯৬১ সালে চীনা সামরিক বাহিনীকে মোকাবেলা করতে সীমান্ত
এলাকায় সফলতার সাথে নেতৃত্ব দেন এবং ঐ সময়েই তিনি ব্রিগেডিয়ার হিসেবে পদোন্নতি পান।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তি লগ্নে ১৬ ডিসেম্বর তিনি
মিত্রবাহিনীর পক্ষে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ সম্পর্কীয় দলিল গ্রহণ করেন।
দলিলে স্বাক্ষরের মাধ্যমে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষ হয় এবং বাংলাদেশ নামক একটি নতুন
দেশের অভ্যুদয় ঘটে।
২১ নভেম্বর, ১৯৭১
সালে লে জেনারেল অরোরা ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান হিসেবে বাংলাদেশ-ভারতের
মিত্র বাহিনীর প্রধান হিসেবেও মনোনীত হন। ভারত-বাংলাদেশের সরকার প্রধানদের
রাজনৈতিক-সামরিক
সহযোগিতা চুক্তির আওতায় তিনি প্রধান হন। বাংলাদেশ পক্ষীয় দলের প্রধান ছিলেন
জেনারেল এম এ জি ওসমানী। তিনি পূর্ব-পাকিস্তানে যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে যাবতীয়
আলাপ-আলোচনায়
দায়বদ্ধ ছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার দু’সপ্তাহ পূর্বে ভারতীয় সামরিক বাহিনী
মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে পাশ কাটিয়ে অগ্রসর হয় ও ঢাকা
করায়ত্ত করে। এর ফলে তিনি পূর্ব-পাকিস্তানে নিয়োজিত পাকবাহিনীর প্রধান লে জে এ
এ কে নিয়াজী ও টার সৈন্যবাহিনীকে আত্মসমর্পণের জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। পাকিস্তানি সৈন্যদের অবস্থান ও আক্রমণ থাকা
স্বত্বেও অরোরা তার বাহিনীকে পাশ কাটিয়ে যেতে নির্দেশ দেন এবং যথাসম্ভব ও দ্রুততার
সাথে ঢাকাগামী হবার আদেশ দেন। ফলে, এক পর্যায়ে নিয়াজী ও তার দলবল আত্মসমর্পণ করতে
বাধ্য হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের ঘটনা পরম্পরায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ
ও জড়িয়ে পড়ার ফলে পাকিস্তান সামরিক জান্তা তার পূর্ব-পাকিস্তান
অংশের নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার
পাশাপাশি সামরিক আক্রমণে ভারতের মাসব্যাপী রণ পরিকল্পনা সফল হয়। অরোরা তাঁর নৈতিক
সহায়তা দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে অংশগ্রহ্ণ করে যুদ্ধ জয় করেন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার
প্রভূত উন্নয়ন ঘটান।
পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী
যখন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আত্মসমর্পণ
করে তখনো তাদের হাতে ৯৩ হাজার সদস্য। তাঁর মধ্যে পাকিস্তানের সামরিক পোশাকধারী
সদস্য ছিলেন ৫৬ হাজার ৬৯৪ জন। এই বিপুল সংখ্যক সৈন্য হাতে রেখেই ১৯৭১ সালের ১৬
ডিসেম্বর পড়ন্ত বিকালে ৫টা ১ মিনিটে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন
পাকিস্তানি জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি। আত্মসমর্পণের দলিলে বাংলাদেশ-ভারতের
যৌথ কমান্ডের অন্যতম অধিনায়ক লে জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা ভারতীয় ফিল্ড মার্শাল
শ্যাম মানেকশর পক্ষে স্বাক্ষর করেন। ভারত-বাংলাদেশের সরকার প্রধানদের রাজনৈতিক-সামরিক
সহযোগিতা চুক্তির আওতায় তিনি প্রধান হন। বাংলাদেশ পক্ষে দলের প্রধান ছিলেন জেনারেল
এম এ জি ওসমানী। আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করলেন দুজনে। স্বাক্ষরের পরপরই
সিনিয়র পাকিস্তানি অফিসারদের ওখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। কারণ আত্মসমর্পণ করেছে বলে
পাক সেনা অফিসারদের নিরাপত্তার দায়িত্ব বাংলাদেশের ওপরই বর্তায়। ওদিকে আশপাশ ঘিরে
থাকা হাজার হাজার মানুষ উল্লাসে মুখর হয়ে উঠে।
১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহারে দিল্লিতে নানা মর থাকলেও অরোরা যুদ্ধ শেষ হওয়ার তিন মাসের মধ্যে বাহিনী প্রত্যাহারে জোরালো মতামত রাখেন। তাঁর আলোচিত উক্তি ছিল- তিন মাস পর্যন্ত আমরা ‘মিত্রবাহিনী’ থাকতে পারি। কিন্তু এর বেশি হলেই আমরা ‘দখলদার’বাহিনীতে পরিণত হব। ১৯৭২ সালে ১৪ মার্চ মিত্রবাহিনী বিদায়ী প্যারেডে অংশ নেয় এবং দ্রুত বাংলাদেশ ভূখন্ড ত্যাগ করে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হবার পর কোথাও যেন বিশৃঙ্খলা মাথাচাড়া না দেয় সেজন্য তাঁর ছিল কঠোর নির্দেশ ও সতর্ক দৃষ্টি। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তাঁর অমায়িক ব্যবহার ও অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল। বঙ্গবন্ধুর সাথেও তাকে দেখা যায়।
সামরিক জীবন থেকে অবসর গ্রহণ
করে জগজিৎ সিং অরোরা বেশ কয়েক বছর ভারতীয় সংসদের রাজ্যসভায় সংসদ সদস্য হিসেবে
নির্বাচিত হয়েছিলেন। শিখ জনগোষ্ঠীর আকালী দলের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন তিনি। এভাবে
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে তিনি মিশে আছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে
চিরস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে ২০০৫ সালের ৩ মে ৮৯ বছর বয়সে ভারতের দিল্লিতে তাঁর
মৃত্যু হয়।
আরও পড়ুন:
বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ : dhaka voice: বাংলাদেশ
No comments