Adsterra

জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেল নাটোরের কাঁচাগোল্লা

 

জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেল নাটোরের কাঁচাগোল্লা

মধুসূদন পাল এখন আর পৃথিবীতে নেই। তবে তার রেখে যাওয়া অসাধারণ সৃষ্টি কাঁচাগোল্লা দেশ দেশের বাইরে সুনাম কুড়িয়েছে অনেক আগেই। 
অত্যন্ত সুস্বাদু কাঁচাগোল্লা সুনামের পাশাপাশি ঐতিহ্য বহন করছে যুগযুগ ধরে। শুধু তাই নয়, অর্ধ বঙ্গেশ্বরী খ্যাত নাটোরের রানি ভবানীর প্রিয় খাদ্যের তালিকায় ছিল কাঁচাগোল্লা।

নাটোরের ইতিহাস ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে কাঁচাগোল্লার নাম। তাই কাঁচাগোল্লার নাম শুনলেই নাটোর এবং নাটোর নামটি শুনলে সবার আগে চলে আসে কাঁচাগোল্লার নামটি।  নাটোর কাঁচাগোল্লা যেন একই সূত্রে গাঁথা। এখন সেই বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (জিআই) হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। কাঁচাগোল্লা দেশের ১৭তম নিজস্ব জিআই পণ্য।
গত মঙ্গলবার (০৮ আগস্ট) শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ট্রেডমার্ক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান স্বাক্ষরিত জিআই সনদপত্র নাটোরের জেলা প্রশাসকের (ডিসি) কাছে পাঠানো হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (১০ আগস্ট) দুপুরে জেলা প্রশাসক আবু নাছের ভূঁঞা তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, নাটোরের ঐতিহ্যবহনকারী জনপ্রিয় কাঁচাগোল্লা এখন জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এতে আমরা নাটোরবাসী গর্বিত। ভবিষ্যতে কীভাবে বিশ্বব্যাপী কাঁচাগোল্লার প্রসার ঘটানো যায়, সে ব্যাপারে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কেউ যাতে পণ্যকে বিকৃত করতে না পারে, সে ব্যাপারেও সজাগ দৃষ্টি রাখা হবে।

তিনি বলেন, নাটোরের সাবেক রাজশাহীর বর্তমান জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ কাঁচাগোল্লার জিআই নিবন্ধনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। গত ৩০ মার্চ অ্যাফিডেভিটের মাধ্যমে শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, ডিজাইন ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরের (ডিপিডিটি) মাধ্যমে নাটোরের কাঁচাগোল্লার জিআই আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। নাটোরের -কমার্স ডেভেলপমেন্ট সেন্টার প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে। আর শিল্প মন্ত্রণালয় গত আগস্ট সনদ দেয়।  

তিনি আরও বলেন, জিআই তালিকাভুক্তির মধ্য দিয়ে নাটোরের ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণের পাশাপাশি দেশবিদেশে কাঁচাগোল্লার ব্র্যান্ডিং চাহিদা আরও বাড়বে।

স্থানীয়রা জানান, কাঁচাগোল্লা বানানোর পেছনে রয়েছে এক মজাদার ইতিহাস। অর্ধ বঙ্গেশ্বরী খ্যাত নাটোরের রানি ভবানীর প্রিয় খাদ্যের তালিকায় ছিল মিষ্টি। তার রাজপ্রাসাদে নিয়মিত মিষ্টি সরবরাহ করতেন শহরের লালবাজারের মধুসূদন পাল নামে এক মিষ্টি বিক্রেতা।

একদিন মধুসূদন পালের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সব কর্মচারীই অসুস্থ হয়ে পড়েন। সে সময় মিষ্টি তৈরির জন্য দুই মণ ছানা সংগ্রহ করা ছিল। ছানাগুলো নষ্ট হয়ে যাবে ভেবে মধুসূদন পাল ছানার সঙ্গে চিনি মিশিয়ে চুলায় তাপ দেন। এতে কারিগর ছাড়াই এলোমেলো আয়োজনে তৈরি হয় নতুন এক মিষ্টি। তবে দেখতে যাই হোক না কেন, স্বাদে ছিল অতুলনীয়।

আর অবস্থায় নতুন মিষ্টিই পাঠিয়ে দেওয়া হয় রানির রাজবাড়িতে। রানি সেই মিষ্টি খেয়ে খুব প্রশংসা করেন। মিষ্টি খাওয়ার পর নাম জানতে চান রানি। তখন মধুসূদন পাল পড়ে যান বিপাকে। পরে কাঁচা ছানা থেকে তৈরি বলে এর নাম দেন কাঁচাগোল্লা। সেই থেকে এর নাম হয় কাঁচাগোল্লা।  

কাঁচাগোল্লার ইতিহাস শত শত বছর ধরে বেঁচে আছে মানুষের মুখে মুখে। কাঁচাগোল্লার সঙ্গে জড়িয়ে আছে নাটোরবাসীর আবেগ ভালোবাসা। প্রায় ২৫০ বছর আগে আবিষ্কৃত হয়ে আজও সুনাম ধরে রেখেছে কাঁচাগোল্লা। বিয়ে, বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান অতিথি আপ্যায়নে সরবরাহ করা হয় এটি। শুধু দেশেই নয়, সারাবিশ্বেই নাটোরের কাঁচাগোল্লা এখন প্রসিদ্ধ মিষ্টি। নাম গোল্লা হলেও এটি দেখতে গোল নয়। মূলত এটি ছানা আর চিনির সংমিশ্রণে তৈরি এক ধরনের সন্দেশ।

এদিকে কাঁচাগোল্লাকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেতে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগেকে স্বাগত জানিয়েছেন নাটোরের জনগণ।  

শহরের লালবাজারস্থ জয়কালীবাড়ি মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মালিক প্রভাত কুমার পাল বাংলানিউজকে বলেন, আরও অনেক আগেই কাঁচাগোল্লার জন্য জিআই পণ্যের আবেদন করা উচিত ছিল। কেননা বিভিন্ন ধরনের মানহীন কাঁচাগোল্লা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি করা হয়। এতে আসল কাঁচাগোল্লার সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এখন জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় মানহীন কাঁচাগোল্লা উৎপাদন বন্ধ হবে। দেশের মানুষ আসল কাঁচাগোল্লা চিনে কিনতে পারবেন। 

তিনি বলেন, দেরিতে হলেও কাঁচাগোল্লাকে জিআই পণ্যের জন্য স্বীকৃতি আদায়ে জেলা প্রশাসন যে ভূমিকা রেখেছে, সে জন্য কৃতজ্ঞ নাটোরবাসী। এজন্য নাটোরবাসী এবং সব মিষ্টি ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসনকে ধন্যবাদ কৃতজ্ঞতা জানাই। একই অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন শহরের শিলা মিষ্টিবাড়ি, মৌচাক, ঘোষ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারসহ আরও অনেক দোকানের মালিক।

নাটোর পৌরসভার মেয়র উমা চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, কাঁচাগোল্লা জিআই তালিকাভুক্ত হলো। এর মধ্য দিয়ে নাটোরের ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণের পাশাপাশি দেশবিদেশে কাঁচাগোল্লার ব্র্যান্ডিং চাহিদা বাড়বে। সংক্রান্ত যে কোনো উদ্যোগে পৌর কর্তৃপক্ষ পাশে থাকবে। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগকে স্বাগত জানাই।

এর আগে বাংলাদেশে প্রথম বারের মতো জিআই পণ্য হিসেবে ২০১৬ সালে স্বীকৃতি পেয়েছিল জামদানি। এরপর ২০১৭ সালে ইলিশ, ২০১৯ সালে খিরসাপাতি আম, ২০২০ সালে ঢাকাই মসলিন এবং ২০২১ সালে রাজশাহী সিল্ক, রংপুরের শতরঞ্জি, কালিজিরা চাল, দিনাজপুরের কাটারীভোগ চাল এবং নেত্রকোনার সাদামাটি মোট ৫টি পণ্যকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

 

 

No comments

Powered by Blogger.