Adsterra

নিকোলাই ভিক্টোরোভিচ পদগোর্নি || মুক্তিযুদ্ধে বিদেশির অবদান

নিকোলাই ভিক্টোরোভিচ পদগোর্নি || 
মুক্তিযুদ্ধে বিদেশির অবদান 

নিকোলাই ভিক্টোরোভিচ পদগোর্নি || মুক্তিযুদ্ধে বিদেশির অবদান
নিকোলাই ভিক্টোরোভিচ পদগোর্নি || ছবি: উইকিপেডিয়া

নিকোলাই ভিক্টোরোভিচ পদগোর্নি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সুপ্রিম সোভিয়েত প্রেসিডিয়ামের চেয়ারম্যান। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং স্বাধীনতাবিরোধী দেশগুলোর চক্রান্ত ব্যর্থ করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের বিপক্ষে ছিল যুক্তরাষ্ট্র। সে সময় পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ছিল সুসম্পর্ক; পাকিস্তানের সমর্থনে ভারত মহাসাগরে নৌবহরও পাঠিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। পাকিস্তানের সঙ্গে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নেরও অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে সোভিয়েত ইউনিয়নের। পাকিস্তানের দোসরমার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীনতাকামী বাঙ্গালির বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশের যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব পাশের আবেদন করে। তাতে ভেটো দিয়ে প্রস্তাবটি বাতিল করেন তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নি। প্রস্তাব পাশ হলে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে যেত, শেষ হতো স্বাধীনতার স্বপ্ন।

স্নায়ুযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন দক্ষিণ এশিয়ায় নিজের প্রভাব অক্ষুন্ন রাখার স্বার্থে ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে সচেষ্ট ছিল। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর তাসখন্দে ওই দেশসের মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের ঘটনা সোভিয়েত নেতাদের মধ্যস্থতার ফল। তাঁর পরের বছরগুলোতেও সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয় দেশকে নিজের প্রভাব বলয়ের মধ্যে রাখার চেষ্টা অব্যাহত রাখে। পাকিস্তান মার্কিন শিবিরের অধিকতর ঘনিষ্ঠ দেশ হওয়া স্বত্ত্বেও সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে তাঁর অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পায়। ১৯৬৮ সালে মস্কো ও ইসলামাবাদের মধ্যে এক দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় সোভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানকে সীমিত সামরিক সরঞ্জাম পাঠাতে রাজি হয় এবং পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় ইস্পাত কারখানা নির্মাণে সাহায্য প্রদানে চুক্তি করে। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের সুসম্পর্ক ছিল। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ঢাকায় গণহত্যা চালানো শুরু করলে সোভিয়েত সরকার কঠোর ভাষায় এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায়।

নিকোলাই পদগোর্নি ১৯৭১ সালের ২ এপ্রিল পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে একটি চিঠি লিখে পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের বিরুদ্ধে সামরিক বলপ্রয়োগে সোভিয়েত ইউনিয়নের গভীর উদ্বেগ সঞ্চার করেছেন। পাকিস্তানের অগণিত মানুষের প্রাণহানি, নিপীড়ন ও দুঃখকষ্টের খবরে সোভিয়েতের জনগণ বিচলিত না হয়ে পারে না। মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বন্দি করায় এবং নির্যাতন করায়ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এইসব নেতারা সম্প্রতি সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের সমর্থন লাভ করেছিলেন। পাকিস্তানে যে জটিল সমস্যার সমধান আরো কঠিন হয়ে উঠবে এবং তাতে পাকিস্তানের বিরাট ক্ষতি হবে। সমস্যা সমাধানের শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক উপায় উদ্ভাবনের জন্য অতি জরুরি ব্যবস্থা নিতে আপনাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছি।

ঢাকায় গণহত্যার ঘটনাকে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে বর্ণনা করে এ নিয়ে তাদের কিছু বলার নেই বলে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দেয়। কিন্তু ভারতের পরেই সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিবাদ জানিয়ে নিজেদের অবস্থান ব্যক্ত করে। প্রেসিডেন্ট পদগোর্নির চিঠির উত্তরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ৫ এপ্রিল এক কঠোর বার্তা পাঠান। সেই বার্তার ভাষা ছিল রুক্ষ ও কিছুটা অশালীন। সেই সময় মস্কো পাকিস্তানের অখণ্ডতায় পুরোপুরি আস্থাবান ছিল; বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নটি তাদের বিবেচনায় তখন পর্যন্ত আসেনি। কারণ, সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সেই কোসিগিন ও পার্টিপ্রধান লিওনিদ ব্রেজনেভের নেতৃত্বে মস্কো ভারত ও পাকিস্তানকে একই সঙ্গে কাছে টানার ভারসাম্যপূর্ণ নীতি অনুসরণ করে আসছিল, বাংলাদেশ প্রশ্নে সেই নীতি ঝুঁকির মুখে পড়ুক এটা সোভিয়েত নেতৃত্ব চাননি। তাই পাকিস্তান সরকারকে পূর্ব পাকিস্তানে গৃহীত সামরিক কৌশল থেকে ফিরিয়ে এনে সংকটের শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানে উৎসাহিত করেছিল। ১৭ এপ্রিল সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে পাঠানো এক বার্তায় বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন সংকটের সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর আইনসম্মত অভিপ্রায়পূরণের ওপর। কিন্তু পাকিস্তান সামরিক বলপ্রয়োগের মাধ্যমেই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা অব্যাহত রাখলে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষের মনোভাব বদলে যেতে শুরু করে।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও ইপিআরের বাঙ্গালি সদস্যরা বিপুল সংখ্যায় স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিলে এবং ভারতের সহায়তায় সীমান্ত অঞ্চলে গেরিলা মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠলে পরিস্থিতি বদলে যেতে থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথমে ভারতকে প্রত্যক্ষ সামরিক সংঘাত এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছে। কারণ, সোভিয়েত ইউনিয়ন চীনকে ঠেকানোর লক্ষ্যে ভারত ও পাকিস্তানকে নিয়ে যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য পরিকল্পনা করে এসছিল। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘর্ষ বাধলে তাদের পরিকল্পনা ভণ্ডুল হতে পারে আশঙ্কা ছিল। চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক উন্নয়নেও সোভিয়েতের উদ্বেগ বাড়ছিলএই পরিস্থিতিতে ১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট নতুন দিল্লিতে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ২০ বছর মেয়াদি এক শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তিস্বাক্ষরিত হয়। এর ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত-সংশ্লিষ্টতা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয় এবং তা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নতুন শক্তি সঞ্চার করে। চুক্তিতে বলা হয়, ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন কখনো কারও দ্বারা আক্রান্ত হলে তারা তা নিজেদের উপর আক্রমণ বলে গণ্য করবে এবং পরস্পরের সহযোগিতায় এগিয়ে আসবে। এই চুক্তি যুক্তরাষ্ট্র এবং পাকিস্তানের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের ব্যাপারে পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নিলে সোভিয়েত ইউনিয়ন নীরব থাকবেনা স্পষ্ট জানিয়ে দেয় পাকিস্তানকে। ভারতে বাঙ্গালি উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান ছাড়া পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। সে জন্য রাজনৈতিক সমঝোতা প্রয়োজন; শেখ মুজিবের বিচার সমাঝোতার পথে আনার ব্যর্থ চেষ্টা করে। কিন্তু পাকিস্তান পূর্ব ও পশ্চিম উভয় সীমান্তে সেনা সমাবেশ সম্পন্ন করে। ১ নভেম্বর থেকে আকাশপথে শুরু হয় ভারতের জন্য সোভিয়েত সামরিক সরবরাহ। সোভিয়েত ইউনিয়ন সামরিক পদক্ষেপ এড়িয়ে চলার সর্বাত্মক চেষ্টা করে। ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতের পশ্চিম ও পূর্ব সীমান্তে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ শুরু করলে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পথে খুলে যায়।

৯ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট নিক্সন মার্কিন সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরের দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেন। লক্ষ্য ছিল মুক্তপ্রায় বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর চূড়ান্ত পতন রোধের জন্য নৌ, বিমান ও স্থল তৎপরতা চালানো; বঙ্গোপসাগর ভারতের নৌ-অবরোধ ব্যর্থ করা, পাকিস্তানি স্থলবাহিনীর তৎপরতায় সাহায্য করা, ভারতীয় বিমান তৎপরতা প্রতিহত করা এবং মার্কিন নৌ-সেনা অবতরণে সাহায্য করা। এর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র চীনকেও ভারতের সীমান্তে সেনা-সমাবেশের প্ররোচনা দিতে থাকে। কিন্তু চীন-সোভিয়েত সীমান্তে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিশাল সেনা সমাবেশ ছিল বলে চীন মার্কিন প্ররোচনায় বিভ্রান্ত হয়নি। আর মার্কিন সপ্তম নৌবহর আসার আগেই ভারত মহাসাগরে সোভিয়েত নৌবহরের সমাবেশ সম্পূর্ণ হয়; তাঁর আগে মার্কিন সপ্তম নৌবহরের গতিবিধি জানার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন কসমস ৪৬৪ পর্যবেক্ষণ উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করে।

অন্যদিকে জাতিসংঘে পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন বারবার ভেটো দিতে থাকে। তাদের প্রস্তাবে বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক অধিকারের বিষয়টি বরাবরের মতো এগিয়ে গিয়ে যুদ্ধবিরতি, উভয় দেশের সেনা প্রত্যাহার ও উদ্বাস্তু প্রত্যাবর্তনের কথা বলা হয়। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পোল্যান্ড পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাবসহ যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানায়। ফলে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে বিষয়টি অমীমাংসিতভাবে ঝুলে থাকে। ১৩ ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদের সভায় জাতিসংঘে সোভিয়েত প্রতিনিধি ইয়াকভ মালিক যুক্তি দেখান, সাম্প্রতিক ঘটনাবলির কারণে এই সংকটে শুধু পাকিস্তান ও ভারত নয়, বাংলাদেশও একটি পক্ষ। দেড় লাখ গেরিলা যোদ্ধা স্বাধীনতার জন্য লড়েছেন, তাদের প্রতিনিধির বক্তব্যও শোনা উচিৎ। কিন্তু পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যদের বিরোধিতার কারণে মালিকের সে অনুরোধ প্রত্যাখ্যাত হয়। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের দুই অংশেই প্রবল যুদ্ধ চলতে থাকে এবং পাকিস্তানের পরাজয় অত্যাসন্ন হয়ে ওঠে। ভারত নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবের ব্যাপারে স্বভাবতই কালক্ষেপণের কৌশল নেয় এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন বারবার ভেটো দিয়ে ভারত-বাংলাদেশ যৌথবাহিনীর বিজয়কে সুনিশ্চিত করে তোলে। এভাবেই ১৬ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় চূড়ান্ত হয়।

যুদ্ধের সকল পর্যায়েই সোভিয়েত ইউনিয়ন স্বাধীনতা সংগ্রামী জনগণের পাশে দাড়িয়েছে। বাংলাদেশের জনগণ সবসবয় কৃতজ্ঞতার সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন-সহযোগিতার কথা স্মরণ করে। মুক্তিযুদ্ধের পরও বাংলাদেশকে সমর্থন করেছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৭২-এর ২৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ৫ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের এক প্রতিনিধি দলসহ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভ্রমণ করেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাসে ব্যতিক্রম ঘটিয়ে রাষ্ট্রীয় অতিথিকে বরণ করতে মস্কো বিমান বন্দরে উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্রপতি নিকোলাই পদগোর্নি, কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক লিওনিদ ব্রেজনেভ এবং প্রধানমন্ত্রী আলেক্সেই কোসিগিন। এটি ছিল একটি বিরল ব্যতিক্রমী ঘটনা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত সম্মানের। মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখায় বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা দেন নিকোলাই  পদগোর্নি। 

আরও পড়ুন: dhaka voice: মুক্তিযুদ্ধ

No comments

Powered by Blogger.