Adsterra

গির্জা থেকে মসজিদে রূপান্তর হওয়া আয়া সোফিয়া


কখনো গির্জা,কখনো মসজিদ কখনো জাদুঘর, তুরস্কের ইস্তানবুলে দাঁড়িয়ে আছে স্থাপত্যের বিস্ময়কর স্থাপত্য আয়া সোফিয়া। দেড় হাজার বছরের যাত্রায় যার রূপ বদলেছে বহুবার। আর প্রতিবারই সমৃদ্ধ করেছে ইতিহাস।

ইস্তানবুল, একটি প্রাচীন শহর। এই শহর কেটে মর্মর সাগর থেকে কৃষ্ণসাগরে মিশেছে বসফরাস প্রণালী। প্রণালীর এক অংশ ইউরোপে। অন্য অংশ এশিয়ায়। অর্থাৎ ইস্তানবুল শহরটি দুই মহাদেশের অংশ। সম্ভবত এ কারণেই একে বলা হয় পৃথিবীর রাজধানী।যখন ইস্তানবুল মুসলমানদের অধিকারে আসে, তখন পৃথিবীর বড় একটি অংশ শাসন হতো সেখান থেকেই। আর এই শহরের গুরুত্বপূর্ণ অংশ আয়া সোফিয়া

রোমানদের সময় আয়া সোফিয়া ছিলো চার্চ। মুসলমানদের বিজয়রে পর মসজিদ। আর সালতানাত বিলুপ্তির পর ১০ জুলাই তুরস্কের সাংবিধানিক আদালত মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের আয়া সোফিয়াকে মসজিদ থেকে জাদুঘরে রূপান্তরের সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করে। সাংবিধানিক আদালতের এই ঘোষণার পর সরকারের পক্ষ থেকে আয়া সোফিয়াকে আবার মসজিদে রূপান্তরের ফরমান জারি করা হয়।

তবে আয়া সোফিয়া এবারই প্রথম আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসেনি। এর দীর্ঘ ইতিহাস আছে। প্রথমে এটি অর্থোডক্স গির্জা হিসেবে নির্মিত হয়েছিল। সে সময় বিশ্বের সর্ববৃহৎ গির্জা ছিল আয়া সোফিয়া। প্রায় সাড়ে ৯০০ বছর এটি গির্জা ছিল। এরপর মুসলিমদের কনস্ট্যান্টিনোপল বিজয়ের মাধ্যমে মসজিদে পরিণত হয়। আর প্রায় সাড়ে আট দশক ছিল জাদুঘর। তুরস্কের ঐতিহাসিক এই স্থাপনা নিয়েই এই লেখা।

আয়া সোফিয়ার সুদীর্ঘ ইতিহাস বিদ্যমান। তুরস্কের ইস্তানবুলে এর অবস্থান। প্রথমে যা গ্রিক অর্থোডক্স চার্চ হিসেবে নির্মিত হয়েছিল। গ্রিক ভাষায় আয়া সোফিয়াঅর্থ পবিত্র জ্ঞানআয়া সোফিয়ার একই স্থানে পূর্বে আরো দুটি গির্জা ছিল। ৫৩২ খ্রিষ্টাব্দে কনস্ট্যাটিনোপলে সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ানের বিরুদ্ধে সংঘটিত নিকা বিদ্রোহেরসময় দ্বিতীয় গির্জাটি ধ্বংস প্রাপ্ত হয়েছিল। এর ঠিক কয়েক সপ্তাহ পরে রোমান সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ান ৫৩২ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ ফেব্রুয়ারি কনস্ট্যান্টিনোপলের পূর্বের গির্জার স্থানে নতুন একটি গির্জা নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। তবে পূর্বের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন নকশার, বৃহত্তর এবং আড়ম্বরপূর্ণ একটি গির্জা নির্মাণের পরিকল্পনা করেন সম্রাট।

রোমান সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ান তৎকালীন সময়ের মাইলাতসের প্রখ্যাত গ্রিক স্থপতি এবং জ্যামিতিবিদ ইসিডোর এবং ট্রালসের গণিতবিদ অ্যান্থেমিয়াসকে নকশা করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। অবশ্য অ্যান্থামিয়াস এক বছর এই কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার পর মৃত্যুবরণ করেছিলেন।

বাইজেন্টাইন ইতিহাসবিদ প্রোকোপিয়ানের বর্ণনা মতে, আয়া সোফিয়ার নির্মাণের জন্য ভূমধ্যসাগর জুড়ে সমস্ত সাম্রাজ্য থেকে কলাম এবং অন্যান্য মার্বেল পাথর আনা হয়েছিল। ১০ হাজারেরও অধিক শ্রমিক নিযুক্ত ছিল এর নির্মাণ কাজে। ৫৩২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে ৫৩৭ খ্রিষ্টাব্দে শেষ হয়। সে সময় এটি বিশ্বের বৃহত্তম স্থাপত্য ইমারত ছিল।আয়া সোফিয়া ৫৩৭ থেকে ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অর্থোডক্স গির্জা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে চতুর্থ ক্রুসেডের সময় ইউরোপের ক্যাথলিক খ্রিষ্টানরা কনস্ট্যান্টিনোপল দখল করে নেয়। ইউরোপের ক্যাথলিক খ্রিষ্টানরা অর্থোডক্স চার্চ আয়া সোফিয়াকে ক্যাথলিক চার্চে রূপান্তরিত করে। তবে ১২৬১ খ্রিষ্টাব্দে ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের পরাজয়ের ফলে আয়া সোফিয়া পুনরায় অর্থোডক্স চার্চে রূপান্তরিত হয়। আয়া সোফিয়া সেসময় শুধু গির্জা হিসেবে নয়, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কেন্দ্র হিসেবেও গড়ে উঠেছিল।

অটোম্যান সুলতান দ্বিতীয় মেহমেত ১৪৫৩ খ্রিষ্টাব্দে কনস্ট্যান্টিনোপল দখল করেন। তিনি ১৪৫৩ সালের ৬ এপ্রিল কনস্ট্যান্টিনোপল নগরী অবরোধ করেন। এরপর ৫৪ দিনের অবরোধ শেষে ২৯ মে কনস্টান্টিনোপল অটোম্যান কাছে পরাজিত হয়। সম্রাট একাদশ কন্সটান্টাইন প্যালিওলোগাস যুদ্ধে নিহত হন। মূলত তার মৃত্যুর মধ্যমেই কনস্ট্যান্টিনোপলের অটোম্যান মুসলিমদের কাছে চূড়ান্ত পতন হয়। এই ঐতিহাসিক বিজয় অর্জনের জন্য দ্বিতীয় মেহমেতকে ফাতিহউপাধি দ্বারা সম্মানিত করা হয়। যার অর্থ বিজয়ীবা নগরদোর উন্মোচনকারীসুলতান দ্বিতীয় মেহমেত কনস্ট্যান্টিনোপলের নামকরণ করেন ইস্তানবুল এবং এখানেই অটোম্যান সাম্রাজ্যের নতুন রাজধানী স্থাপন করেন।

সুলতান ইস্তানবুল দখলের সঙ্গে সঙ্গে তৎকালীন যুদ্ধনীতি অনুযায়ী, আয়া সোফিয়াও দখল করেছিলেন বলে একটি মতবাদ প্রচলিত আছে। আবার অন্য একটি মতবাদ অনুযায়ী, তিনি খ্রিষ্টান পাদ্রিদের কাছ থেকে এটি ক্রয় করেছিলেন। তিনি তৎকালীন সময়ের বৃহত্তম চার্চ এবং নয়নাভিরাম এই স্থাপনা ভেঙে না ফেলে মসজিদে রূপান্তরের সিদ্ধান্ত নেন।

মসজিদে পরিণত হওয়ার পর ১৪৫৩ সালের ১ জুন আয়া সোফিয়ায় প্রথম জুমার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। সুলতান দ্বিতীয় মেহমেত এই নামজে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সুলতান দ্বিতীয় মেহমেতের নির্দেশে আয়া সোফিয়ার ব্যাপক সংস্কার করা হয়। আয়া সোফিয়ার গির্জার ক্রস চিহ্ন সরিয়ে চাঁদ তারা খচিত অটোম্যান পতাকা উত্তলন করা হয়। চার্চবেল বা ঘণ্টা সরিয়ে ফেলা হয়। যিশু, মেরি, খ্রিষ্টান সাধু এবং স্বর্গদূতদের চিত্রিত মোজাইকগুলোর বেশিরভাগ সরিয়ে ফেলা হয়েছিল এবং কিছু প্লাস্টার করে দেয়া হয়েছিল। এর উপর ইসলামি স্থাপত্যের নকশা যুক্ত করা হয়। এতে চারটি মিনার, মেহরাব স্থাপন করা হয়। দ্বিতীয় মেহমেতের সময়ই এটি ইমপেরিয়াল মসজিদে পরিণত হয়েছিল।

১৬১৬ সালে সুলতান আহমেদ মসজিদ নির্মিত হওয়ার আগ পর্যন্ত এটিই ছিল ইস্তানবুলের প্রধান মসজিদ। কালক্রমে আয়া সফিয়া মসজিদে মর্মর পাথরের নির্মিত বিভিন্ন অংশ সংযোজন করা হয়। ১৭৩৯ সালে এই মসজিদে একটি মাদ্রাসা স্থাপন করা হয়েছিল যা বর্তমানে লাইব্রেরি। যেখানে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মূল্যবান গ্রন্থ আছে। ১৮৪৮ এবং ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে আয়া সোফিয়ার ব্যাপক সংস্করণ করা হয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অটোম্যান সালতানাত বা উসমানীয় খিলাফতের সমাপ্তি ঘটে। ১৯২৩ সালে খিলাফতের পরিবর্তে তুরস্কে নতুন সরকার পদ্ধতি প্রচলিত হয়। আধুনিক তুরস্কের স্থপতি মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক তুর্কি প্রজাতন্ত্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি ধর্ম নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করেন। মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক ১৯৩৫ সালে আয়া সোফিয়া মসজিদ থেকে জাদুঘরে রূপান্তর করেন। প্রায় ৪৮২ বছর মসজিদ হিসেবে প্রচলিত থাকা আয়া সোফিয়া জাদুঘরে রূপান্তরিত হয়। জাদুঘরে রূপান্তরের পরে, এর দেওয়ালে প্লাস্টারে ঢেকে দেয়া যিশু খ্রিষ্টের অনেক পুনরুদ্ধার করা হয়। তবে এগুলোর বেশিরভাগই প্রায় ৫০০ বছর কংক্রিটের নিচে ঢাকা পড়ে অস্পষ্ট হয়ে যায়। আয়া সোফিয়া জাদুঘর সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়।

আয়া সোফিয়ার স্থাপত্যশৈলী অটোম্যান মুসলিম সাম্রাজ্যে ব্যাপক প্রভাব বিস্তারকারী ছিল। অটোম্যান শাসনামলের প্রায় সব মসজিদ এবং স্থাপনায় আয়া সোফিয়ার স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। পুরো অটোম্যান স্থাপত্যশৈলী আয়া সোফিয়া কেন্দ্রিক বললেও ভুল হয় না।

জন ফ্রিল এর আ হিস্ট্রি অব অটোম্যান আর্কিটেকচারগ্রন্থে এবিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। সলেমানিয়া মসজিদ, সুলতান আহমেদ মসজিদ, রুস্তম পাশা মসজিদ, আলি পাশা কমপ্লেক্সসহ অটোম্যান শাসনামলের প্রায় সব এবং স্থাপনা আয়া সোফিয়ার স্থাপত্য শৈলী দ্বারা প্রভাবিত।

 

  গির্জা থেকে মসজিদে রূপান্তর হওয়া আয়া সোফিয়া

No comments

Powered by Blogger.