Adsterra

সুড়ঙ্গ : লোভ, ক্রোধ আর প্রতিশোধের গল্পে রায়হান রাফির সেরা নির্মাণ

ঢাকা ভয়েজ  dhaka voice; সুড়ঙ্গ : লোভ, ক্রোধ আর প্রতিশোধের গল্পে রায়হান রাফির সেরা নির্মাণ


গত বছরের ঈদে পরাণসিনেমার মাধ্যমে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন নির্মাতা রায়হান রাফী। নির্মাতা হিসেবে নিজের সক্ষমতার প্রমাণ অবশ্য তিনি দিয়েছেন তার অভিষিক্ত পোড়ামনসিনেমায়। এছাড়া সুড়ঙ্গসিনেমার মাধ্যমে প্রথমবারের মত বড় পর্দায় অভিষিক্ত হয়েছেন আফরান নিশো। ছোট পর্দার অন্যতম জনপ্রিয় এই অভিনেতার বড় পর্দায় অভিষেকের কারনে শুরু থেকেই আলোচনায় ছিলো সিনেমাটি। সিনেমাটির মাধ্যমে চলচ্চিত্রে নিজের যাত্রাটা কেমন করলেন আফরান নিশো? নির্মাতা হিসেবে নিজের ধারাবাহিকতা কি ধরে রাখতে পেরেছেন রায়হান রাফী? দর্শকদের প্রত্যাশার কতটুকু প্রতিফলন হয়েছে এই সিনেমায়? এসবের উত্তর জানতে বিস্তারিত আলোচনা থাকছে সুড়ঙ্গসিনেমার আজকের পর্যালচনায়।


চলচ্চিত্রের নামঃ সুড়ঙ্গ (২০২৩)

মুক্তিঃ জুন ২৯, ২০২৩
অভিনয়েঃ আফরান নিশো, তমা মির্জা, সানজাত হাসান তুহিন, শহীদুজ্জামান সেলিম এবং মোস্তফা মন্ওয়ার প্রমুখ।
পরিচালনাঃ রায়হান রাফী
প্রযোজনাঃ শাহারিয়া শাকিল এবং রেদওয়ান রনি
পরিবেশনাঃ দ্য কন্টেন স্পেশালিস্ট, বায়োস্কোপ ফিল্মস, বনগোজ ফিল্মস এবং শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মস (ভারত)
কাহিনী এবং চিত্রনাট্যঃ নাজিম উদ দৌলা এবং রায়হান রাফী
সম্পাদনাঃ সুমিত রায় অন্তর
চিত্রগ্রহনঃ সুমন সরকার
সংগীতঃ আরাফাত মহসিন, সাজিদ সরকার এবং ইমন চৌধুরী



কাহিনী সংক্ষেপঃ ‘সুড়ঙ্গসিনেমার গল্প মূলত তিনটি চরিত্রকে কেন্দ্র করে। গল্পের শুরুতে আমরা দেখতে পাই একজন ইলেকট্রিক মিস্ত্রীর বিয়ের ঘটনা। মাসুদ (আফরান নিশো) একজন ইলেকট্রিক মিস্ত্রী যে ভালোবেসে বিয়ে করে ময়না (তমা মির্জা)-কে। মাসুদের সাথে সার্বক্ষনিক দেখা যায় তার একমাত্র কাছের মানুষ বন্ধু জহির (সানজাত হাসান তুহিন)-কে। মোটামুটি ভালোভাবেই বিয়ের পর্ব শেষ করে সংসারিক জীবনে পদার্পন করে মাসুদ। কিন্তু বিয়ের পর স্ত্রী ময়নার চাহিদা মেটাতে হিমশিম খায় মাসুদ। বিয়ের জন্য করা ধারদেনা শোধের পাশাপাশি স্ত্রীর চাহিদার চাপে অতিষ্ঠ হয়ে উঠে মাসুদ।

বিয়ের কিছুদিনের মধ্যে ময়নার পরামর্শ এবং চাপে বিদেশে পাড়ি জমায় মাসুদ। দেশে রয়ে যায় তার প্রাণের স্ত্রী ময়না এবং সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু জহির। গ্রামের মোড়ল এবং অন্যদের কাছ থেকে ধারদেনা করে ভালো কিছুর আশায় বিদেশে পাড়ি জমায় মাসুদ। এরপরই মাসুদের জীবনে নেমে আসে একের পর এক বিপর্যয়। যে কাজের কথা বলে তাকে বিদেশ পাঠানো হয়েছিলো, সে কাজের বদলে অন্য কাজ করতে হয় তাকে। এদিকে ময়না মাসুদের কাছে টাকার পরিমাণ বাড়ানোর চাপ দিতে থাকে ক্রমাগত। বিভিন্ন সময়ে বাজার সদাইয়ের পাশাপাশি ময়নাকে আর্থিকভাবে সাহায্য সহযোগিতা করে জহির। সাথে মাঝে মাঝে ময়নার জন্য বিভিন্ন উপহারও নিয়ে আসতে থাকে জহির।

ময়নাকে জহিরের এই সাহায্যের পিছনে একটি খারাপ মতলব ছিলো। অন্যদিকে অর্থের লোভে অন্ধ ময়নাও সব বুঝেও না বুঝার মত করে থাকে। একদিন প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে স্বামীর বন্ধুর সাথে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পরে ময়না। প্রথমে কিছুটা অপরাধবোধ কাজ করলেও, একসময় জহিরের কাছে নিজেকে পুরোপুরি সমর্পন করে দেয় ময়না। বিদেশে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে মাসুদ, আর দেশে ময়না লিপ্ত হয় জহিরের সাথে পরকীয়ায়। এক সময় ময়নাকে নিয়ে জহির গ্রাম থেকে পালিয়ে যায়। আর পিছনে পরে থাকে মাসুদের সব স্বপ্ন এবং সাধনা।

ময়নাকে নিয়ে জহিরের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা শুনতে পায় মাসুদ। কিন্তু সত্যটা জানার জন্য মাসুদ দেশে ফিরে দেখে যা শুনেছে সেটি পুরোপুরি সত্য। এদিকে বিদেশ যাওয়ার জন্য করা ধারের কারনে শেষ সম্বল বাড়ির চাবিও মাসুদকে তুলে দিতে হয় সেই মোড়লের হাতে। সবকিছু হারিয়ে, ময়নাকে ভালোবাসার স্মৃতি নিয়ে অচেনার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায় মাসুদ। কিন্তু কিছুতেই সে ময়নাকে ভুলতে পারেনা। খোঁজে বেড়ায় সবখানে। একসময় গ্রামের এক ছোট ভাইয়ের সাহায্যে ময়নার খোঁজ পায় মাসুদ। কিন্তু ময়না বাজারে সবার সামনে মাসুদকে চিনতে অস্বীকৃতি জানায়। জহিরের সাথে নিজের নতুন সংসার নিয়ে আছে ময়না।

সবকিছু জানার পরও ময়নার পিছু ছাড়ে না মাসুদ। মাসুদের জীবন ধ্বংস করার পর জহিরের সাথে বিয়ে করেও ময়নার টাকার প্রতি লোভ কমে না। মাসুদ বুঝে জীবনে টাকার চেয়ে মূল্যবান কিছুই নেই। মাসুদ সিদ্ধান্ত নেয় যে, সে একটি সুড়ঙ্গ করে ব্যাংক ডাকাতি করবে। মাসুদ তার এই পরিকল্পনার অংশীদার করে ময়নাকে। ময়নাও টাকার লোভে জহিরকে ছেড়ে মাসুদের সাথে যোগ দেয়। দীর্ঘ নয়মাস পরিশ্রমের পর মাসুদ সেই সুড়ঙ্গ দিয়ে ব্যাংকের ভোল্ট পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম হয়। মাসুদ এবং ময়না দুজনেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। পরিকল্পনা মত টাকা নিয়ে তারা দুজন অনেক দূরে কোথাও চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়।

কিন্তু এরপরই গল্পে আসে নতুন মোড়। মাসুদ এবং ময়না কি পারবে চুরি করা টাকা নিয়ে পালিয়ে যেতে? ময়না কি আসলেই মাসুদের সাথে হাত মিলিয়েছে, নাকি তাকে নতুন কোন ফাঁদে ফেলার পাঁয়তারা করতেসে? লোভী ময়না কি শেষ পর্যন্ত মাসুদের হাত ধরে ছিলো? মাসুদ কি ভূলে গেছে তার স্ত্রী এবং বন্ধুর সেই পরকীয়ার ঘটনা? মাসুদের কাছে এই সব কি শুধুই ভালোবাসা? এইসব যখন হচ্ছে তখন জহির কোথায়? জহির কি ময়নার উপর বিশ্বাস রাখতে পেরেছে না নতুন কোন জায়গায় তার নৌকার নোঙ্গর করেছে? গল্পের মূল টুইস্ট জানতে হলে আপনাকে দেখতে হবে সিনেমার পরের অংশ।

গল্প এবং চিত্রনাট্যঃ ‘সুড়ঙ্গসিনেমার গল্প এবং চিত্রনাট্য যৌথভাবে রচনা করেছেন নাজিম উদ দৌলা এবং রায়হান রাফী। গল্প বলার ক্ষেত্রে এই দুজনই সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম সেরা দুটি নাম। এই সিনেমায়ও নিজেদের নামের প্রতি সুবিচার করেছেন তারা। বাংলা চলচ্চিত্রের গতানুগতিক গল্পের বাইরে গিয়ে দুর্দান্ত একটি থ্রিলার নিয়ে হাজির হয়েছেন নাজিম উদ দৌলা এবং রায়হান রাফী। গল্প নিয়ে এক কথায় বললে বলতে হয় যে, ‘সুড়ঙ্গসিনেমার গল্পই আসলে এই সিনেমার মূল চালিকা শক্তি। প্রথম দিকে সিনেমার প্রেক্ষাপট দাড় করাতে কিছুটা সময় নিয়েছেন তারা, তবে শেষ ভাগে এসে দর্শকদের নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করেছেন। গল্পের সাথে সিনেমার চিত্রনাট্যও ছিলো দারুণ কাজের উদাহরণ। দর্শকদের কখনোই গল্প থেকে বিচ্ছিন্ন হতে দেয়নি নাজিম উদ দৌলা এবং রায়হান রাফীর চিত্রনাট্য।

পরিচালনাঃ পরিচালক হিসেবে রায়হান রাফী আবারো সফল। সিনেমাটিতে নিজের মুন্সিয়ানা দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। একটি থ্রিলার সিনেমার সাথে দর্শকদের সংযোগ ধরে রাখতে, গল্প এবং চিত্রনাট্যের বাইরেও নির্মাতাদের নিজস্ব কিছু কারিশমা থাকতে হয়। রায়হান রাফী সেই পরীক্ষায় শতভাগ সফল হয়েছেন। আফরান নিশোকে নিয়ে এরকম একটি সিনেমা নির্মানের সিদ্ধান্তেই প্রমাণিত হয় যে, নির্মাতা হিসেবে রায়হান রাফী দুরদর্শী। বিশেষ করে দ্বিতীয় ভাগে সিনেমার গল্পে বেশ কিছু প্লট পরিবর্তন দেখতে পাবেন দর্শকরা। এই প্লট পরিবর্তনের সময়গুলোকে বেশ দক্ষতার সাথে উপস্থাপন করেছেন রাফী।

অভিনয়ঃ মাসুদ চরিত্রে আফরান নিশো এক কথায় অসাধারণ। এর আগে ছোট পর্দায় আফরান নিশো এরকম চরিত্রে ভালো অভিনয় করেছেন। প্রথম সিনেমায় নিজের প্রতি সুবিচার করতে পেরেছেন এই অভিনেতা। ময়না চরিত্রে তমা মির্জা সম্ভবত তার ক্যারিয়ারের সেরা অভিনয়টা করেছেন। সিনেমায় নিজের চরিত্রকে তিনি এমনভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, যে অনেক নারী দর্শকও তাকে ঘৃণা করবে। জহির চরিত্রে সানজাত হাসান তুহিন প্রত্যাশা অনুযায়ী ভালো অভিনয় করেছেন। তবে সিনেমাটিতে তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে শহীদুজ্জামান সেলিমের কথা আলাদা ভাবে উল্লেখের দাবী রাখে। তার চরিত্রের ব্যাপ্তি কম হলেও, তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন কত বড় মাপের অভিনেতা সেলিম। সংলাপে আঞ্চলিকতার ছোঁয়ার পাশাপাশি কথায় হতাশা এবং বিরক্তি দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন শহীদুজ্জামান সেলিম।

চিত্রগ্রহন এবং সম্পাদনাঃ থ্রিলার গল্পের সিনেমার অন্যতম গুরুত্বপূর্ন বিষয় হচ্ছে সম্পাদনা। সম্পাদক হিসেবে সুমিত রায় অন্তর আবারো নিজের মেধার প্রমাণ দিলেন সুড়ঙ্গসিনেমায়। এই সিনেমার চিত্রগ্রহণের দায়িত্বে ছিলেন সুমন সরকার। সিনেমাটির চিত্রগ্রহণ ছিলো ঢাকাই সিনেমার অন্যতম সেরা কাজগুলোর মধ্যে একটি। কয়েকটি দৃশ্য তিনি এমনভাবে তুলে এনেছেন যা, দর্শকদের মাঝে লম্বা সময়ের জন্য প্রভাব ফেলে যাবে। যেমন, বাজারে মাসদুকে চিনতে অস্বীকার করার পর মানুষের হাতে মাসুদের পিটুনি খাওয়া এবং সেটিকে পিছনে ফেলে ময়নার হেটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য। এরকম অনেকগুলো দৃশ্য দর্শক দেখতে পাবেন পুরো সিনেমা জুড়ে।


সুড়ঙ্গসিনেমাটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশে নির্মিত সেরা সিনেমাগুলোর মধ্যে অন্যতম। বিগত বছরগুলোতে যে কয়েকটি সিনেমা দেশীয় চলচ্চিত্রকে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখাচ্ছে তার মধ্যে সুড়ঙ্গঅগ্রগণ্য হিসেবে বিবেচিত হবে। মাল্টিপ্লেক্স বলেন আর একক স্ক্রিনের প্রেক্ষাগৃহ বলেন, ‘সুড়ঙ্গসব শ্রেণীর দর্শকদে কাছে ভালোলাগার মত সিনেমা। সিনেমাটি আপনাকে হতাশ করবে না এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। পরিশেষে একটি কথাই বলবো লোভ, ক্রোধ এবং প্রতিশোধের গল্পে সুড়ঙ্গএখন পর্যন্ত রায়হান রাফি পরিচালিত সেরা সিনেমা। এর মাধ্যমে তিনি দর্শকদের কাছে নিজের মানদণ্ড অনেক উঁচুতে নিয়ে গেছেন।

 

 

No comments

Powered by Blogger.