সালমান শাহ, যার শূন্যতা আর পূরণ হলোনা
১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর। সিলেট শহরে শুনশান নিরবতা। পাকিস্তানি আর্মিরা পুরো শহরটকে ঘিরে রেখেছে। বিশেষ প্রয়োজনে বাহিরে বের হওয়াটাও জীবনের জন্য বড় ঝুকি। দাড়িয়া পাড়ার হায়াত ভবনে উদ্বিগ্ন মূহুর্তের অবসান হলো। নীলা চৌধুরী এবং তার সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তান দুজনেই বেশ সুস্থ। কমর-নীলা দম্পতি তাদের এই খুশির মূহুর্তটাকে ভাষায় প্রকাশ করতে পারছেন না। কয়েক ঘন্টা আগেও বাড়ির সবাই অত্যন্ত চিন্তিত ছিল। রোগীর এতটাই কষ্ট হচ্ছিলো যে তাকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করানো প্রয়োজন কিন্তু দেশের যে পরিস্থিতি তাতে করে হাসপাতাল পর্যন্ত নিরাপদে পৌছানোই যেনো অনিশ্চিত। নীলা শুধু তার পরিবারের কাছে একটাই অনুরোধ করলেন যেনো হাসপাতালে তাকে কোনোভাবে না নেওয়া হয়।তার প্রথম সন্তানের জন্ম এই হায়াত ভবনেই হয়! অন্তত তিনি যদি মারাও যান তাও বাচ্চাটা যেনো নিরাপদে থাকে, সুস্থ থাকে, যত্নে থাকে। কমর সাহেব তার স্ত্রীর সাথে একমত। ইদানীং নাকি হাসপাতাল থেকে বাচ্চা চুরি হয় আবার যদি আল-বদরদের বদৌলতে পাক বাহিনীরা কোনো নবজাতকের সন্ধান পায় তবে তার আর দুচোখ খুলে এই পৃথিবী দেখার সম্ভাবনা নেই তা এক প্রকার নিশ্চিত। প্রথম সন্তানের আগমনে হায়াত ভবনে আজানের সুর বেজে উঠলো। তার নাম রাখা হলো শাহরিয়ার চৌধুরি ইমন।
সালমান শাহর বেড়ে উঠা ইস্কাটনে। লেখাপড়ার পাশাপাশি স্কুল,
কলেজে সহপাঠ কার্যক্রমে সালমানের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিলো। তিনি ছোট বেলায় ভালো গান গাইতেন,
শিশু শিল্পী হিসেবে অভিনয় করতেন। মা চাইতেন ইমন যেনো সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে উঠুক। ১৯৮৬ সালে তিনি ছায়ানট থেকে পল্লিগীতির উপর কোর্স সম্পন্ন করেন। ছোট পর্দায় অভিনয়ের মধ্য দিয়ে সালমান তার ক্যারিয়ার শুরু করেন।
‘আকাশ ছোঁয়া’ তার অভিনীত প্রথম নাটক। এরপর একে একে অভিনয় করেন ‘সব পাখি ঘরে ফিরে’,
সৈকতে সারস, নয়ন সহ বেশ কিছু জনপ্রিয় নাটকে। সহশিল্পী হিসেবে সালমান ছিলেন দূর্দান্ত। তার অমায়িক ব্যবহারের জন্য তিনি সবার কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। নয়ন নাটকে সেটে সহ-অভিনেত্রী তমালিকা কর্মকারের মা এসেছিলেন তাকে বসতে দেবার মতো শুটিং সেটে কোনো চেয়ার ছিলনা। সালমান টিমের ব্যর্থতার দায় ভার নিজ কাঁধে তুলে নিলেন। নিজের খরচে প্রোডাকশন বয়কে দিয়ে একটা চেয়ার আনানোর ব্যবস্থা করলেন। সালমানের ক্রেজের কারনে এফডিসির দারোয়ানরা পর্যন্ত তার কাজগুলো টিভি পর্দায় দেখতে চাইতো। চলচ্চিত্র সমিতির সদস্যরা এই ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ না নিলেও সালমান তাদের দাবি মিটিয়ে ছিলেন। দারোয়ানদের বিশ্রামরুমে তিনি রঙিন টিভি বসানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। সহশিল্পী নতুন বা পুরোনো যেই হোক না কেনো সেটে সবার সাথে অভিজ্ঞতা শেয়ার করতেন, সেটকে অনেকটা শান্ত রাখতেন। তার কাজের প্রতি নিষ্ঠার ব্যাপারে তার সমসাময়িক সহশিল্পীরা এখনো নানা সময়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বলে থাকেন। সেটে খুব কম সময় দেরি করতেন এমনকি রিহ্যারসেলেও সময়ের আগেই পৌঁছে যেতেন।
সালমানের শিশু শিল্পী হিসেবে সালমানের অভিনয় জীবন শুরু হওয়ায় বেশ কিছু টিভিসি,
ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে প্রোটাগোনিস্ট ক্যারেক্টার হিসেবে কাজ করেছেন কিন্তু ব্যাটে বলে ঠিকমতো সংযোগ না হওয়ায় ছোট পর্দায় আশানরূপ সাফল্য তিনি পাচ্ছিলেন না। ১৯৯৩ সালে সোহানুর রহমান সোহান পরিচালিত
‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’
ছবিতে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তার চলচ্চিত্রে অভিষেক হয়। এরপর তো সেই সিনেমা দেশীয় চলচ্চিত্রে এক ইতিহাস সৃষ্টি করে। মুক্তির পর সিনেমার বক্স অফিস কালেকশন যেনো প্রত্যাশার পারদকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। দেশীয় সেরা ১০ ব্যবসা সফল চলচ্চিত্রের তালিকায় এই সিনেমার নাম এখনো রয়েছে!
ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে যা হয় আর কি! এই সিনেমার জন্য পরিচালকের পছন্দের তালিকায় ছিলেন তিনি এবং খ্যাতনামা মডেল আদিল হোসেন নোবেল। মডেলিং ক্যারিয়ারে নোবেলের গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় তিনি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের ব্যাপারে অনাগ্রহী ছিলেন। পরিচালক সোহান তার সাথে শিডিউল মিলিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে দেখা করতে চাইলেন। সালমান ২০ মিনিটের মধ্যে সেখানে উপস্থিত থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কিন্তু তিনি ১৩ মিনিটের মধ্যেই সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। সালমানের সাথে প্রথম সিনেমায় সহশিলী হিসেবে অভিনয় করলেন তার স্কুলের ব্যাচমেট মৌসুমি। এরপর একে একে অভিনয় করলেন স্নেহ, তুমি আমার,
স্বপ্নের পৃথিবী, এই ঘর এই সংসার,
বিক্ষোভ সহ প্রায় ২৭ টি সিনেমায়। প্রতিটি সিনেমায় তিনি সমসাময়িক শিল্পীদের তুলনায় সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পেতেন। সালমানের অভিনয়ের প্রতি এত বেশি সততা এবং নিষ্ঠা ছিলো তার প্রমাণ তিনি
‘এই ঘর এই সংসার’ সিনেমায় দিয়েছেন। সিনেমার একটি দৃশ্যের জন্য তিনি আলাদা করে ১০ মিনিট রিহ্যারসেল করেছিলেন। বোনের সাথে সেই আবেগঘন মূহুর্তের দৃশ্যায়নটি মাত্র এক টেকেই শেষ হয়েছিলো। দৃশ্যটা ভালো করার যে তাড়না তার মধ্যে ছিলো তা প্রতিটা আর্টিস্টের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিলো। রাত ২ টার সময় শেষ হওয়া সেই সিনের প্রতিটি সংলাপ প্রত্যেকেই মুখস্থ করেছিলেন।
সালমানের ক্রেজ কতটা বেশি ছিলো তা কয়েকটা ঘটনার মাধ্যমে প্রমাণ পাওয়া যায়।
‘বিক্ষোভ’ সিনেমার শুটিঙ্গের জন্য পুরো টিম তখন বান্দরবান সার্কিট হাউজে অবস্থান করছিলো। প্রিয় নায়ককে একবার দেখার জন্য তার শত শত ভক্ত সেই শুটিং সেটে উপস্থিত হয়েছিলো। বর্তমান সময়ের আলোচিত চলচ্চিত্র অভিনেত্রী নিপুণ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন তাকে দেখার জন্য তার পুরো পরিবার সেখানে গিয়েছিলো। ক্লান্ত সালমান ক্লান্তিকে উপেক্ষা করে স্টারডমকে ধারণ করে সার্কিট হাউজের ছাদ থেকে হাত নেড়ে ভক্তদের ইচ্ছা পূরণ করেছিলেন। একদিন এক মেয়ে স্কুল পালিয়ে তার শুটিং দেখতে এসেছিলো। টিনএইজ বয়সী সেই তরুনীকে তিনি পাশে বসিয়ে তার দায়িত্ব ঠিকঠাকভাবে পালনের প্রতিশ্রুতি দিতে বললেন এবং তিনি নিজেও প্রতিশ্রুতি দিলেন তার মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে তিনি নিজে তাকে তার পরবর্তী শুটিং সেটে নিয়ে আসবেন। তার মৃত্যুর খবর পেয়ে আরও ২৩ জন তরুণী সেইদিনই আত্মহত্যা করে। সালমানের মৃত্যুর সংবাদ পাবার পর তার বাল্যকালের বন্ধু নজরুল সেই যে তার ছবি হাতে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন! এখন পর্যন্ত তিনি আর ফিরে আসেননি।মৃত্যুর ২৬ বছর পরেও তার ভক্তদের দাবিগুলো এখনো অপূর্ণ রয়ে গেছে। যার জন্য যেই ইন্ডাস্ট্রিতে তিনি এত্ অবদান রেখে গেছেন বিনিময়ে তিনি কখনো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার পান নি, এফডিসিতে তার নামে একটা ফলক পর্যন্ত নেই, তার স্মৃতি রোমন্থনে নেই কোনো মেমোরিয়াল,
এমনকি তার জীবনীর উপরেও তেমন কোনো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি!
৬ সেপ্টেম্বর,
১৯৯৬। ঢাকা থিয়েটারের কর্মীরা একটি মঞ্চ নাটকে অভিনয় করতে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় অবস্থান করছিলো। বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যে ৬ টায় সেখানে একটা ফোন কল এলো। সবাই রিহ্যারসেলে মগ্ন। কয়েকবার রিং হওয়ায় ফোন বুথের কাছে গিয়ে ফোনটা ধরলেন শ্রদ্ধেয় হুমায়ূন ফরিদী। কি কথা ওপাশ থেকে হচ্ছিলো তা কেউ আন্দাজ করতে পারেনি কিন্তু ফোনটা রেখে দেবার মূহুর্তেই হুমায়ূন ফরিদী মাটিয়ে এক ঝটকায় নিস্তেজ হয়ে বসে পড়লেন। কান্নায় জর্জরিত হয়ে সালমানের মৃত্যুর খবর সবাইকে জানালেন। ইস্কাটনে সালমানের বাসার পাশের গলিতেই থাকতেন সঙ্গীত শিল্পী আগুন। বিকালে একটা গানের রেকর্ডিং হবে। সন্ধ্যায় তার সাথে সালমানের স্টুডিওতে যাবার কথা। কিন্তু তা আর হলো কই! সালমানের স্ত্রী কাদছেন। মৃত্যুটা কীভাবে হলো তা তিনি বলতে পারছেন না। শরীরে কোনো আঘাতের চিনহ নেই। তবে কি এটা আত্মহত্যা নাকি ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পিত কোনো হত্যা? স্ত্রীর মুখে তালা। সালমানের মা এবং ছোটভাই তাদের বাড়ীতে ততক্ষণে উপস্থিত হয়েছেন। সালমানের ভাইয়ের মতে এটা মোটেও আত্মহত্যা নয় বরং এটা পরিকল্পিত খুন। লাশ ময়না তদন্তে পাঠানো হলো। সেই যে তদন্ত শুরু হয়েছিলো আজ প্রায় ২৬ বছর হয়ে গেলো তার কোনো সূরাহা হলোনা! সালমান দেহ ত্যাগ করেছেন ঠিকই কিন্তু তার কর্মের মধ্য দিয়ে আমাদের মনে ঠিকই বেঁচে আছেন এবং থাকবেন।
No comments