২৪ ঘণ্টার পথে হাঁটছে ঢাকা
একসময় ঢাকায় সন্ধ্যা নামলেই শহর ঘুমিয়ে যেত। একবার বাসায় ঢুকলে বাসা থেকে অভিভাবকরা আর বের হতে দিতেন না। সেই সময় রাতে চলাচল করা ছিল একরকম আতঙ্ক। কিন্তু এখন আর আগের মতো নেই শহর। দিনের মতো রাতের বেলায়ও জমজমাট। সন্ধ্যার সেই ঘুমন্ত শহর এখন ক্রমেই ২৪ ঘণ্টার নগরীতে রূপান্তরিত হচ্ছে।
রাত যত বাড়ে, শহরের ব্যস্ততা ঠিক ততই বাড়তে থাকে। রাস্তায় থাকে বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কার ও ব্যাটারিচালিত যানের দাপট। এরই মধ্যে শহরে গড়ে ওঠা রাতের বাজারগুলো ও আশপাশে কর্মব্যস্ত হাজারো লোকের হাঁকডাক শোনা যায়। ভবন বা যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণ ঘিরে ব্যস্ত থাকে আরও অনেক লোকজন। যদিও রাত ১টার পর খুব একটা গণপরিবহনের দেখা মেলে না। তবে বিকল্প বাহন ও অ্যাপভিত্তিক পরিবহন সেবায় ভরসা করা যায় রাতের যাত্রায়।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী মাছের আড়ত, ঠাটারীবাজার, সোয়ারীঘাট মাছের বাজার, কারওয়ান বাজার, বাদামতলী ফলের বাজারে রাতভর ব্যস্ত থাকে। মূলত এ বাজারগুলো কেন্দ্র করে প্রতিরাতে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা-বাণিজ্য হয়। এ বাজারগুলো কেন্দ্র করে আরও বেশ কয়েকটি ছোট ছোট ব্যবসায়িক কর্মকা- হয়। আর যার প্রভাব রাজধানী জুড়ে দেখা যায়। আর বসুন্ধরা কুড়িল এলাকায় রাতভর খোলা থাকে দোকানপাট। বসুন্ধরার ভেতরে আবাসিক এলাকায় দোকানপাট না থাকায় রাতে জরুরি জিনিসপত্রের চাহিদা মেটানোর জন্য মূলত এ দোকানগুলো খোলা থাকে। তবে অনেক তরুণও রাতে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে দেশ-বিদেশে বড় রকমের যোগাযোগ নেটওয়ার্ক তৈরি করে। সেখান থেকে বড় রকমের মুনাফা আসে দেশে ফ্রিল্যান্স কাজের মাধ্যমে।
সরেজমিন গত সপ্তাহের মঙ্গল ও বুধবার রাতে গুলিস্তান এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কিছু কিছু জায়গায় তীব্র যানজট। সড়কের পাশে বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী ওঠানামার কাজ করছেন শ্রমিকরা। আর পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর যাত্রাবাড়ী এলাকার সড়কে ব্যস্ত আগের চেয়ে বেড়েছে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকায় পণ্য আসে রাতভর, দূরপাল্লার বাসগুলো শহর থেকে যাওয়া-আসা করছে বিভিন্ন গন্তব্যে। মালিবাগ আবুল হোটেলের সামনেও অনেক গার্মেন্ট রাতভর খোলা থাকে।
গুলশানেও অনেক রেস্তোরাঁ খোলা থাকতে দেখা যায়। মহাখালী এলাকায়ও গাড়ির চাপ থাকে চোখের পড়ার মতো। এর মধ্যে মেট্রোরেল, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসসহ শহরের উন্নয়নকাজ চলতে দেখা যায় রাতের বেলায়। আর উত্তরবঙ্গের যাত্রার প্রবেশপথ গাবতলী এলাকায় গাড়ির চাপ দেখা যায়। শহর পরিষ্কার করতে দেখা যায় পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের। এ ছাড়া রাতে আগের চেয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংখ্যা বেশি দেখা যায়। রাজধানীর প্রবেশ ও বের হওয়ার পথে জোরালো তৎপর দেখা যায় পুলিশের।
গত বুধবার রাত ১২টার পর পান্থপথ এলাকায় কথা হয় এক চা দোকানের মালিকের সঙ্গে। ‘স্মার্ট চা বিক্রেতা’ নামে বেশ পরিচিত মো. হান্নান নামে এ ব্যক্তির। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এই এলাকায় রাত যত বাড়ে, আমার বেচাবিক্রি তত বাড়তে থাকে। বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ এ দোকানে আসে চা খেতে। অনেকে চলার পথে একটু বিরতি নেয় এ দোকানের সামনে। তাছাড়া রাতে বেচাকেনা করতে বেশ ভালো লাগে।’
কারওয়ান বাজারের ডিম ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আমাদের এ আড়তে ডিমের চালান আসে। প্রতিরাতেই আমাদের ব্যস্ততা থাকে। রাজধানীর খুচরা দোকানদার বা যারা দোকানে দোকানে সরবরাহ করে, তারা আমাদের কাছ থেকে ডিম নিয়ে যায়। রাতভরই বেচাকেনা হয়।’
একইদিন রাতে কথা হয় মো. জামান নামে এক উবার চালকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার বাসা মুগদা এলাকায়। নিজের ব্যক্তিগত একটি প্রাইভেট কার আছে। দিনের বেলায় রাস্তাঘাটে অনেক যানজট থাকে। তাই রাত ১২টার পর গাড়ি নিয়ে বের হই। এ সময় গাড়ি চালাতে বেশ ভালো লাগে। তাছাড়া রাতের বেশিরভাগ যাত্রী উবার সেবায় ভরসা করে।’ সব খরচ বাদ দিয়ে ২ হাজার মতো টাকা থাকে বলে জানান তিনি।
রাজধানীর কুড়িল এলাকায় রংপুর থেকে আসা দুলাল মিয়া নামে এক ট্রাকচালক বলেন, ‘রাত ১২টার আগে শহরে প্রবেশ করা যায় না। তাই রংপুর থেকে এসে অপেক্ষা করছি। রাত ১২টার পর শহরে প্রবেশ করব। তবে রাতে কিছু জায়গায় ট্রাক থামিয়ে কেউ কেউ চাঁদা তোলে। এ ছাড়া আর কোনো সমস্যা নেই। গাড়ির গতি স্বাভাবিকই থাকে।’
রাতের সড়কে কিছু জায়গায় আবাসিক এলাকার স্থানীয় লোকজন ভেতরের প্রবেশ গেট বন্ধ করায় কিছুটা বেগ পেতে হয় বলে জানান রাজধানীর মহানগর আবাসিক এলাকার বাসিন্দা মো. রায়হান। তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়িক কাজে অনেক সময় রাত করে বাসায় ফিরতে হয়। তাছাড়া আমাদের শহর আর আগের মতো নেই। এখন দিনে-রাতে সবসময় ব্যস্ত থাকে শহর। সে হিসাবে এভাবে বন্ধ করার কোনো মানে হয় না।’ প্রয়োজনে এলাকায়গুলোতে সিকিউরিটি বাড়িয়ে গেট খুলে রাখার দাবি জানান তিনি।
রাত ২টার পর গুলশান গুদারাঘাট এলাকায় মাহাবুব ও আকাশ নামে দুজন পথচারীর সঙ্গে দেখা হয়। তারা বলেন, সাতক্ষীরা থেকে ঢাকায় এসেছেন কিছুক্ষণ আগে। একটা সময় ছিল রাতে এভাবে রাস্তায় হাঁটা যেত না। এখন আর আগের মতো নেই শহর। রাতের বেলায়ও চারপাশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা থাকেন। তাই গ্রাম থেকে ঢাকায় আসতে গভীর রাত হলেও সমস্যা নেই।
রাত যত বাড়ে পুরান ঢাকার নাজিরাবাজারে ভোজনরসিকদের আড্ডা বাড়তে দেখা যায়। ‘হানিফ বিরিয়ানি’র বিক্রেতা মো. শাকিল জানান, এই এলাকায় রাত ১২টার পর লোকজন আসে। দিনের বেলা থেকেও বেশি। শহরের বিভিন্ন এলাকার লোকজন আসে। যে কারণে নাজিরাবাজার দিনে-রাতে সবসময় ব্যস্ত থাকে।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ইকার সঙ্গে কথা হয় নাজিরাবাজারে। তিনি বলেন, ‘এখন রাতে ঘুরতে বেশ ভালো লাগে। একটা সময় ছিল রাতে বের হওয়া যেত না। নীরব থাকত চারপাশ। কিন্তু সেই ঢাকা আর আজকের ঢাকার মধ্যে অনেক পার্থক্য। এখন ঢাকা ক্যাপিটাল সিটিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। যার ফলে দিনের বেলার মতো রাতে পুরো শহর ঘোরা যায়। আর এতে করে আমাদের সিটি অর্থনৈতিকভাবে আরও বেশি সমৃদ্ধ হচ্ছে।’ নাজিরাবাজার সবসময় জেগে থাকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আসলাম খাবারের খোঁজে।’
রাত ১টার পর গণপরিবহন খুব একটা দেখা যায় না। ফলে রাতে চলাচলের জন্য ব্যক্তিগত পরিহনের পাশাপাশি ব্যাটারিচালিত যানের দাপট থাকে। মো. রাজু নামে এক চালক বলেন, ‘দিনের বেলায় রোদে গাড়ি চালাতে ভালো লাগে না। তাই রাত ১২টার পর ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিয়ে বের হই। ছয় ঘণ্টা চালালে গড়ে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা আয় হয়। দিনের বেলায় এত আয় করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।’
গত ১২ আগস্ট গুলিস্তান মাজারের সামনে পরিচ্ছন্নতাকর্মী রাবেয়াকে (৪০) কাজ করতে দেখা যায়। তিনি বলেন, দিনের আলো ফোটার আগেই শহর পরিষ্কারের কাজ শেষ হয়ে যায়। একটা সময় সকাল বেলায় এ কাজ করলেও এখন রাত ১২টায় শুরু হয়ে যায়। তাই পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা রাতে অনেক ব্যস্ততা থাকেন। আর রাতের এ সময়টায় কাজ করতে ভালো লাগে বলে জানান তিনি।
ঢাকা মহানগর ফল আমদানি-রপ্তানিকারক ও আড়তদার ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক শেখ আবদুল করীম বলেন, ‘আমাদের ঢাকা সিটি এখন ২৪ ঘণ্টার নগরীতে রূপান্তর হয়েছে। যার সুফল ভোগ করছি আমাদের বাদামতলী এলাকার ব্যবসায়ীরা। রাতভর বিভিন্ন জায়গা থেকে ফলের গাড়ি আসে। সেগুলো কেন্দ্র করে রাতভর ব্যস্ত থাকেন এখানকার ব্যবসায়ীরা। সমিতির পক্ষ থেকে দিনের বেলার মতো রাতের বেলায়ও ভালোভাবে মনিটরিং করার জন্য লোকজন রাখা হয়েছে।’
পূর্বাচলে ভূঁইয়া হোটেলের ম্যানেজার সজীব বলেন, ‘আমাদের হোটেল ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। সন্ধ্যার পর থেকে ভোর পর্যন্ত বেশি চলে। কারণ শহরে প্রবেশের আগে এই এলাকায় ট্রাক দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। ট্রাকচালক ও তাদের সহকারীরা এ হোটেলে খাওয়াদাওয়া করেন। তাছাড়া অনেকেই বিভিন্ন জায়গা থেকে রাতের বেলায় এ হোটেলে খেতে আসেন।’ তিনি জানান, রাতের বেলা ব্যবসা ভালোই চলে।
No comments