পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ
ভারতবর্ষে মুঘলদের অস্তিত্ব যখন সংকটে তখন তাদের রাজত্ব ফিরিয়ে আনতে পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ বড় ভূমিকা পালন করে। এই যুদ্ধের ফলে পুরো ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি আরও সুদৃঢ় হয়।
পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিলো ১৫৫৬ সালের ৫ই নভেম্বর। এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো হিন্দুস্তানের রাজা হেমচন্দ্র এবং মুঘল সম্রাট আকবর দ্যা গ্রেটের বাহিনী। রাজা হেমচন্দ্র প্রায় এক মাস আগেই দিল্লির যুদ্ধে মুঘলদের পরাজিত করে দিল্লির সিংহাসন দখল করেছিলেন। এরপরেই তিনি নিজেকে বিক্রমাদিত্য উপাধি দেন। এইসময়ে সম্রাট আকবরের অভিভাবক বৈরাম খান এবং তিনি নিজে ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের জন্য দিল্লি পৌছেছিলেন। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। রাজা হেমচন্দ্র ছিলেন শেরশাহের আমলে একজন বাজার পরিদর্শক। তখন শেরশাহ তার বিচক্ষণতা এবং কার্যক্রমে খুশি হয়ে তাঁকে পাঞ্জাবের গভর্নরের দায়িত্ব দেন। শেরশাহ তৎকালীন মুঘল সম্রাট হুমায়নকে দিল্লি ছাড়া করলে পুরো ভারতেই তখন আফগানদের রাজত্ব চলতে থাকে। শেরশাহর মৃত্যুর পর তার পুত্র ফিরোজ শাহকে হত্যা করেন আদিল শাহ এবং তখন তিনি আফগানদের নেতা হয়ে যান। এরপর হেমচন্দ্রকে তার দায়ভার ন্যাস্ত করে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেন এবং নিজে আমোদ-প্রমোদে দিন পার করতে থাকেন। তখন হেমচন্দ্র নিজের যোগ্যতায় আদিল শাহের বিশ্বস্ত হয়ে সুরিদের প্রধান জেনারেল হন। সম্রাট হুমায়নের মৃত্যুর সময় হেমচন্দ্র বাংলায় ছিলেন। এই মৃত্যুর সুযোগে হেমচন্দ্র দিল্লি ও আগ্রা দখল করতে ৫০ হাজার সৈন্যের এক বাহিনী নিয়ে অভিযান করেন এবং মুঘল শাসক তানজি বেগকে সহজে পরাজিত করতে সক্ষম হন। এভাবেই হেমচন্দ্র বিক্রমাদিত্য উপাধি নিয়ে দিল্লির সিংহাসন আরোহন করেন। এর ফলেই ভারতে হিন্দু রাজত্ব শুরু হয়। এরপর তিনি বাংলার দিকে দৃষ্টিপাত করেন। তারপর ছাপ্পারগার যুদ্ধে বাংলার মুঘল সম্রাট মোহাম্মদ শাহকে পরাজিত করে বাংলাও দখল করে নেন। এটি ছিলো উত্তর ভারতে হেমচন্দ্রের ২০ তম রাজ্য জয়। এরপর এঁকে এঁকে বায়ানা,
ইতাহা, সম্বলি থেকে মুঘলদের বিতাড়িত করতে শুরু করলেন। এভাবেই তিনি এক প্রভাবশালী রাজা হয়ে উঠলেন। অপরদিকে সম্রাট আকবরের অভিভাবক বৈরাম খান যিনি কিনা ১৬ বছর বয়সে সম্রাট বাবরের রাজ দরবারে যোগ দেন এবং একসময় মুঘলদের মহামন্ত্রী হয়ে উঠেন। শেরশাহ যখন সম্রাট হুমায়নকে রাজ্য থেকে বিতারিত করেছিল তখন রাজ্য ফিরে পেতে তাঁকে সহায়তা করেন বৈরাম খান। তাই সম্রাট হুমায়ন তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘আমাদের পরিবারের দুঃসময়ে আপনার মতো সাহায্যকারী আর কেউ নেই।’ সিংহাসনে কিশোর আকবরকে মোহাম্মদী আকবর হয়ে উঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি। সেই সময় মুঘলদের সাম্রাজ্য ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে খুব দক্ষতার সাথে কাজ করে যান তিনি। রাজা হেমচন্দ্রের আগ্রাসনের কারণে ধীরে ধীরে মুঘল সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়তে থাকে। বৈরাম খান যখন মুঘলদের দায়িত্ব নিলেন তখন মুঘলদের অধীনে কান্দাহার, কাবুল এবং পাঞ্জাবের কিছু গ্রাম ব্যাতিত আর তেমন কোনো রাজ্য ছিলোনা। এমনকি মুঘলদের অধীনে পর্যাপ্ত অস্ত্র
,রসদ এবং সেনাবাহিনীও ছিলোনা। তবুও বৈরামখান আকবরের পক্ষ থেকেই হেমচন্দ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ফরমান জারি করলেন। কিন্তু সভায় অন্যান্য সদস্যরা তাতে প্রথমে সায় দিতে চাচ্ছিলনা। পানিপথের যুদ্ধে আকবরের পক্ষে ছিলেন আলিকুলী খান, সিকান্দার খান, হোসেনকুলী খান সহ আরও অনেকে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সৈনিক জড় করতে থাকলেন বৈরাম খান। তিনি পদাতিক, অশ্বরোহী এবং তীরন্দাজ বাহিনী নিয়ে একটি মাঝারি ফোর্স গঠন করেন। যদিও শক্তিতে হেমচন্দ্রকে পরাজিত করার মতো অবস্থা তখন মুঘলদের ছিলোনা। কারণ হেমচন্দ্রের প্রায় ৫০০ যুদ্ধবাজ হাতি,
প্রায় ৩০ হাজার অশ্বরোহী এবং তীরন্দাজ নিয়ে যে ফোর্স গঠন করেন তা মুঘলদের তুলনায় দ্বিগুণ ছিলো। যুদ্ধ উপলক্ষে হেমচন্দ্র ওলন্দাজ বাহিনীর জন্য উন্নতমানের কামান সংগ্রহের জন্য লোক পাঠান। হেমচন্দ্রের জন্য উন্নতমানের কামান গোলাবারুদ নিয়ে দিল্লি ফিরে যাচ্ছিলো ছোট আকারের একটি ফোর্স কিন্তু যাত্রাপথেই আলিকুলী খানের হাতে ধরা পড়ে যায় তারা। আলিকুলী খানের সৈনিকদের সাথে লড়াইয়ে গোলাবারুদগুলো নষ্ট হয়ে যায়। হেমচন্দ্রের সৈনিকেরা প্রাণ ভয়ে পালিয়ে যায়। এর ফলে যুদ্ধ শুরু হবার পূর্বেই মুঘল সম্রাট হেমচন্দ্রকে আঘাত করতে সক্ষম হয়। ১৫৫৬ সালের ৫ই নভেম্বর পানিপথের প্রান্তরে সৈন্যদের নিয়ে উপস্থিত হন রাজা হেমচন্দ্র এবং সম্রাট আকবর। পানিপথের প্রান্তর থেকে প্রায় ৮ মাইল দূরে অবস্থান করেছিলেন সম্রাট আকবর ও বৈরাম খান। অপরদিকে নিজের প্রিয় হাতির পিঠে বসে যুদ্ধ পরিচালনা করছিলেন রাজা হেমচন্দ্র। তার দেহ তখন বর্ম দিয়ে আবৃত ছিল। মুঘলরা মূলত ৩ ভাগে ভাগ হয়ে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। মুঘল সম্রাজ্যের ডান অংশের দায়িত্বে ছিলেন সিকান্দার খান, বাম অংশের দায়িত্বে ছিলেন আবদুল্লাহ খান এবং মাঝখানে তীরন্দাজ বাহিনীর দায়িত্বে থাকেন আলিকুলী খান। আর পেছন থেকে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন বৈরাম খান। যুদ্ধের প্রথমদিকে মুঘলরা হেমচন্দ্রের বাহিনীকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করেন কিন্তু হেমচন্দ্রের হস্তীবাহিনীর জন্য মুঘলদের আক্রমণ ব্যর্থ হয়। এর ফলে তারা আত্মরক্ষামূলকভাবে অবস্থান করে। হেমচন্দ্র মুঘলদের ডান ও বামদিকে মারাত্মকভাবে বিধ্বস্ত করলেও কেন্দ্রের দিকে সুবিধা করতে পারছিলেন না। কারণ কেন্দ্রের দিকে অগ্রসর হলে তার সৈনিকরা মুঘল সীমানায় ঢুকে পড়বে। তাই তিনি ধীরে ধীরে সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে আঘাত হানা শুরু করলেন। মুঘলরা যখন সামনের দিকে অগ্রসরের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো তখন মুঘলদের অশ্বরোহীরা হেমচন্দ্রের হস্তীবাহিনীর আঘাতে বিপর্যস্ত। তখন হেমচন্দ্র মুঘলদের ঘিরে ফেলতে থাকেন কিন্তু অভিজ্ঞ বৈরাম খান তার প্রতিপক্ষের দূর্বলতা সম্পর্কে জানতেন। তিনি মুঘল তীরন্দাজ বাহিনীকে ডাকলেন এবং তাদেরকে হেমচন্দ্রকে আঘাত করার নির্দেশ দিলেন। বৈরাম খান হেমচন্দ্রের হস্তীবাহিনীকে আক্রমণ করে এবং এদিকে হেমচন্দ্র সামনের দিকে অগ্রসর হতেই একটা তীর এসে তার বা চোখে লাগে এবং তিনি হাতির পিঠ থেকে সরাসরি মাটিয়ে লুটিয়ে পড়েন। এতে করে হেমচন্দ্রের সৈন্যরা বিচলিত হয়ে পরে এবং তাদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। মূহুর্তেই যুদ্ধের মোড় পরিবর্তন হয়। মুঘলরা নতুন করে এবার আক্রমণ করে এবং এভাবেই হেমচন্দ্র বাহিনীকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়। এরপর হেমচন্দ্রকে বন্দি করা হয় এবং তার শিরচ্ছেদ করা হয়। এতে করে মুঘলরা আবার সিংহাসন দখল করে নেয়। এই যুদ্ধে উভয় পক্ষেরই প্রায় ৫ হাজার সৈন্যের প্রাণহানী ঘটে। এই যুদ্ধের ফলে ভারতবর্ষের শাসন ব্যবস্থায় আবার পরিবর্তন ঘটে। রাজনৈতিক ,ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং ব্যবসায়িক পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। সম্রাট আকবের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের সময় শুরু হয়। শিরচ্ছেদের পর হেমচন্দ্রের মাথা কাবুলে পাঠানো হয়েছিলো এবং তার দেহ দিল্লির বিশাল প্রবেশদ্বারে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। এছাড়াও অন্যান্য মৃত দেহের মাথা দিয়ে মুঘলরা একটি হাড়ের মিনার নির্মিত করেছিল। যদিও হেমচন্দ্রের সমর্থকরা পানিপথের যেখানে শিরচ্ছেদ করা হয়েছিলো সেখানে তার একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেছিল। বর্তমানে এটি হেমচন্দ্রের সমাধিস্থান হিসেবে পরিচিত।
No comments