যেভাবে পানিপথের প্রথম যুদ্ধ ভারতবর্ষে মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছিল
ষোড়শ শতাব্দীর শুরুতে ভারতবর্ষের বিশৃঙ্খল রাজনৈতিক অবস্থার সুযোগ গ্রহণ করে জহির উদ্দিন মুহম্মদ বাবুর ভারতবর্ষে মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৫২৬ সালের ২১শে এপ্রিল পাঞ্জাব এবং হরিয়ানা রাজ্যের রাজধানী পানিপথ শহর যা কিনা দিল্লি হতে ৯০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত সেখানে আফগান থেকে আগত প্রথম মুঘল সম্রাট জহির উদ্দিন মুহম্মদ বাবুর তৎকালীন ভারতবর্ষের সুলতান ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত করে দিল্লির সিংহাসন আহরণ করেন।যে সুলতান ইব্রাহিম লোদী যথেষ্ট সাহসী এবং উচ্চাভিলাষী হওয়া সত্ত্বেও তার কূটনৈতিক অদক্ষতার কারণে ক্ষমতা হারিয়েছিলেন। ১৩২০ থেকে ১৪১৩ সালের মধ্যে ভারতের সুদূরে দক্ষিণে বাহমনী ও বিজয়নগর রাজ্য,
উত্তরে কাশ্মীর ও জৌনপুর রাজ্য,
পূর্বাঞ্চলে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা এবং
পশ্চিমে পাঞ্জাব, মালব ও গুজরাটে স্বাধীন
রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের রাজারা ছিলেন উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও স্বাধীনতা প্রিয়।
এদের মধ্যে অন্তর্কোন্দলের ফলে দিল্লির কেন্দ্রীয় শক্তি দুর্বল ও সংকুচিত হয়ে
পড়ে। পাঞ্জাব প্রদেশের শাসনকর্তা ছিলেন দৌলত খান লোদী তিনি স্বাধীনভাবে রাজ্য পরিচালনা করতেন। দিল্লির সুলতান ইব্রাহিম লোদী দৌলত খানের স্বাধীন শাসনের বিরোধিতা করায় তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত তৈরি হয়। সুলতান লোদীর খালাতো ভাই আলম খান লোদী দৌলত খান লোদীর সাথে যোগ দিয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। বিহারের শাসনকর্তা দরিয়া খানও দৌলত খানের সাথে যোগ দেন। এতে করে ইব্রাহিম লোদীর সিংহাসনের গদি প্রায় নড়বড়ে হয়ে যাবার উপক্রম হয়। এদিকে দৌলত খান ও দরিয়া খান
আফগানিস্তানের কাবুলে গিয়ে বাবুরকে ভারত আক্রমণের আমন্ত্রণ জানান। এদিকে বিখ্যাত তুর্কি তৈমুর লং এবং মোঙ্গলীয়
শাসক চেংগিস খানের বংশধর বাবুর তার পিতা ওমর মির্জার মৃত্যুর পর ১৪৮৩ সালে
ফারগনার অধিপতি হন। একাধিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে তার পূর্বপুরুষ তৈমুরের রাজধানী সমরখন্দ দখল করে নেন। ১৫০৪ সালে উজবেক শাসনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বাবুর কাবুল জয় করেন এবং
তখনই অনুমান করা যাচ্ছিলো বাবুর ধীরে ধীরে ভারতবর্ষের দিকে অগ্রসর হবেন। ঐতিহাসিকদের মতে হিন্দুস্থান ও কাবুলের সান্নিধ্য
ভারতের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং নেতৃবর্গের আমন্ত্রণ বাবুরের ভারত অভিযানে প্রেরণা যুগিয়েছিল। পানিপথ যুদ্ধের পূর্বে বাবুর ভারতবর্ষে বিশেষ করে ১৫১৯ থেকে ১৫২০ পর্যন্ত বাবুর তিনটি অভিযান পরিচালনা করেন। এসব অভিযানে তিনি সিন্ধুনদ অতিক্রম করে অতি সহজেই বজৌর দুর্গ, ভীরা কুষব ও চেনার নদীর
অববাহিকা অঞ্চল দখল করেন। এই বিজয়ের পর
বাবুর পাঞ্জাবকে কয়েকভাগে ভাগ করে দৌলতখানের পুত্র দিলওয়ার খান, ইব্রাহিম লোদীর চাচা আলম খান এবং মুঘল আমিরদেরকে প্রশাসনের দায়িত্ব তুলে দিয়ে কাবুলে ফিরে যান। বাবুরের অনুপস্থিতিতে দৌলত খান পাঞ্জাব পুনরুদ্ধার করেন এবং আলম খান ও দিলোয়ার খানকে
বিতাড়িত করেন। ফলে বাধ্য হয়ে আলম খান কাবুলে গিয়ে আশ্রয় নেন এবং বাবুরের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। ফলে ১৫২৫ সালে বাবুর পাঞ্জাবের দিকে অগ্রসর হন এবং সহজেই
পাঞ্জাব জয় করে ফেলেন।
পাঞ্জাব দখল করে তিনি দিল্লির দিকে অগ্রসর হবার সময় তাঁকে দিল্লির সুলতান ইব্রাহিম লোদী বাধা দেন এবং পানিপথ প্রান্তরে ১৫২৬ সালের ২১ শে এপ্রিল
এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। বাবুর তার আত্মজীবনীমূলক বই তুযুক ই
বাবুরী’তে উল্লেখ করেছেন,
সেই যুদ্ধে তার মাত্র বারো হাজার সৈনিক ছিলো। পক্ষান্তরে ইব্রাহিম লোদীর প্রায় ১ লাখের মতো
সৈন্য ছিল। কিন্তু বাবুর এই যুদ্ধে ভিন্ন
রণকৌশল অবলম্বন করেন। তিনি অটোমানদের কৌশল অনুসরণ করেন। তিনি ডান এবং বাম দিক থেকে দিল্লি আক্রমণ করেন। ডানদিকে তিনি সৈন্য দিয়ে শহরকে সুরক্ষিত করেন এবং বামদিকে পরিখা খনন করে সেগুলো গাছের ডালপালা দিয়ে ঢেকে রেখেছিলেন এবং মাঝে ৬৭ টি গরুর
গাড়ী রেখেছিলেন, যেই গাড়ীগুলি একটি আরেকটির সাথে দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল এবং প্রতিটি গাড়ীর পিছনে তিনি কামান রেখেছিলেন। যা শত্রুপক্ষের নজরের
বাহিরে ছিল। প্রতিটি গাড়ীর মাঝে সৈন্যরা মতায়েন করেছিলেন এবং অশ্বরোহীদের অগ্রসর হবার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রেখেছিলেন। তার এই আধুনিক পরিকল্পনার
কাছে ইব্রাহিম লোদীর সেনারা দিশেহারা হয়ে পড়েছিলো। তারা সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারছিলোনা। অনেক সৈন্য গাছের ডালপালায় ঘেরা পরিখার ফাঁদে পড়ে গিয়েছিল। এমন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে অনেক সৈন্যরাই দিকবেদ্বিক পালানোর চেষ্টা করে এবং সেই সুযোগে অতর্কিত আক্রমণ চালায় বাবুর বাহিনী। অবধারিত পরাজয় ভেবে ইব্রাহিম লোদী পিছু হটতে চেষ্টা করেন কিন্তু শেষ রক্ষা আর হয়নি। তিনি
বাবুরের হাতে নিহত হন। এর মাধ্যমেই ভারতবর্ষে
মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়। শুধুমাত্র অন্নুনত যুদ্ধ কৌশল বা উন্নত অস্ত্রের
অভাবেই নয় ইব্রাহিম লোদীর
আত্মীয়দের ষড়যন্ত্র এবং তুর্কিদের কাছ থেকে বাবুরের তালিম নেওয়া ‘তুলঘুমা’ রণকৌশলের কাছেই ইব্রাহিম লোদীর পরাজয় হয়।
No comments