Adsterra

চার্লি চ্যাপলিন || যার অভিনয় বুকে মোচড় দিতে বাধ্য করে

চার্লি চ্যাপলিন || যার অভিনয় বুকে মোচড় দিতে বাধ্য করে



১৮৮৯ সালের ১৬ এপ্রিল লন্ডনের কেনিংটন বস্তিতে স্ল্যাপস্টিক কমেডি অভিনেতার জনক চার্লি চ্যাপলিন জন্ম গ্রহণ করেন। ষোল বছর বয়সী লিলি হার্লি ইংল্যান্ডের ছোট-বড় বিভিন্ন নাচিয়ে দলে নাচগান করে বেড়াচ্ছিলেন এবং ছোট বড় নানা ঘটনার ভেতর দিয়ে প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিবাহবন্ধন চুকিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেন ওই শ্রেণীর কোনো দলেরই এক গায়ককে। চার্লি চ্যাপলিন তাদের সন্তান। বাবা-মা দুজনেরই পেশা ছিল নাচগান, প্রয়োজনমতো, সুবিধামতো একদল ছেড়ে আরেক দলে চাকরি করেই তাদের সংসার চলতো। তাদের সংসার কোনোদিনই সচ্ছল ছিলোনা। একে তো বাবা- মায়ের সামান্য এলোমেলো আয় তার মধ্যে বাবা সামান্য কিছু বাড়তি আয় করলেই মদ খেয়ে তা উড়িয়ে দিতেন। সংসারে প্রায়ই অশান্তি লেগে থাকতো। তার মধ্যে অত্যধিক মদ্যপানের ফলে অল্প বয়সেই বাবা সেন্ট টমাস হাসপাতালে মারা যায়। বাবার মৃত্যু একদমই মেনে নিতে পারেন নি চ্যাপলিন। বাবার মৃত্যুর সেই রাতটা সে পার করেছে হাসপাতালের খোলা জানালার আলোটার দিকে তাকিয়ে। ঘোর অমানিশার মধ্যে সেই আলোটায় তার কাছে সামান্য সান্ত্বনা হয়েছিলো। বাবা মারা যাবার পর চ্যাপলিন মায়ের সাথে বেড়িয়ে পড়তেন রাস্তায় নাচ-গান-অভিনয়ের পারফরমেন্স করে কিছুটা রোজগার করতে। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে চার্লির নাট্যজীবনের হাতে খড়ি। একবার মায়ের অসুস্থতার কারণে তার অভিনয় করা একদম অসম্ভব হয়ে পড়েছিলো। বাবা তখন মায়ের পরিবর্তে ছোট্ট চার্লিকে নিয়ে গেলেন থিয়েটারে, একরকম জোর করেই তাঁকে মঞ্চে পাঠান তিনি। প্রথমে বেশ কিছুক্ষণ ভয় পেলেও হঠাত সে সাহস করে চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে গান করতে শুরু করলো। এই শিশুর সাহস দেখে উপস্থিত দর্শকরা ভীষণ খুশি হলো। অডিটোরিয়াম থেকে টাকা পয়সা স্টেজের উপর পড়তে থাকলো। কিন্তু এতে বাবা নিজেকে ভীষণ অপমানিতবোধ করলেন। তিনি চার্লিকে নামিয়ে দিলেন। এরপর বাবা-মায়ের সাথে স্ট্রিট পারফরমেন্সের সুবাদে লন্ডনের অলিগলি ঘুরেছেন। কিন্তু বাবা মারা যাবার পর সংসার চালাতে মায়ের সাথে সে নাচ-গান-মূকাভিনয় যখন যা প্রয়োজন তেমনই স্ট্রিট পারফর্মেন্স করতেন। এমনকি মূকাভিনয় করতে গিয়ে তাঁকে কুকুর-বিড়াল পর্যন্ত সাজতে হয়েছিল। মাঝেমাঝে এই আয়ের পথটিও বন্ধ হয়ে যেতো যখন পুলিশ এসে তাদের সরিয়ে দিতো। এটা-সেটা করে নাপিতের দোকানে সামান্য মাইনের চাকরি পর্যন্ত করেছেন। এমনকি এক দিনের জন্য একটি কাচের কারখানায় মজুরের কাজ করতে গিয়ে হাত পুড়িয়ে ফিরে এসেছিলেন এমনটাও শুনা যায়। চার্লির অভিনয়ের শিক্ষক ছিলেন তার মা। তার মায়ের পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা ছিলো দারুণ। শিল্পীর চোখ তার। যেকোনো মানুষ পাশ দিয়ে হেটে গেলেই তিনি বুঝতে পারতেন তিনি কি আজ পর্যাপ্ত আয় করেছেন নাকি বাড়িতে স্ত্রীর সাথে ঝগড়া করে পার্কে বিষণ্ণ মনে সময় পার করছেন। শুধু স্ট্রিট পারফর্মেন্সে সংসার চলছিলোনা বিধায় মা সেলাইয়ের কাজ করে উপার্জন করতে শুরু করলেন কিন্তু যার রক্তে অভিনয় তাঁকে কি আর দমিয়ে রাখা যায়! তাই সাত বছর বয়সে চার্লি এক অখ্যাত ভ্রাম্যমান মিউজিক দলে নাম লেখান। বছর দুয়েক সেই দলের হয়ে নানা জায়গায় ঘুরে ফিরে আসার পর তার মা তাঁকে দু’বছরের জন্য বাড়ির কাছাকাছি একটি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। অবশ্য চার্লির স্কুলের দৌড় সেই দু’বছর পর্যন্তই ছিলো। মা যখন বুঝতে পারেন তার ছেলে অভিনেতা হবার জন্যেই জন্মেছে তখন তিনি তাঁকে একরাশ মানুষের সামনে তাঁকে পারফর্ম করার জন্য একটি যাত্রা দলে তাঁকে নিয়ে গেলেন। সেখানে তার সাথে মজার ঘটনা ঘটে। দলে চার্লিকে ‘শার্লক হোমসের’ বিলির চরিত্রে অভিনয় করতে বলা হলো, তখন তার মাত্র এগারো বছর বয়স। চার্লি পরিচালককে ভয়ে বলার সাহস পাচ্ছিলো না যে সে লেখা পড়া জানেনা। তাই সে বাড়িতে গিয়ে মায়ের সাথে বিষয়টি আলাপ করলো এবং মা তাঁকে সারারাত ধরে পাঠটি মুখস্থ করালেন এবং সেই চরিত্রে চার্লির অভিনয়ে পরিচালক মুগ্ধ হয়ে যান। এভাবে টুকটাক করে তার অভিনয় জীবন চলতে থাকে। একদিন লন্ডনের বিখ্যার কারনো কোম্পানি দলে যোগ দেবার জন্য চার্লির ডাক আসলো। চার্লি চ্যাপলিনের শিল্পীজীবনে কারনো কোম্পানির প্রাধান্য অনস্বীকার্য এ কথা তিনি নিজ মুখে বহুবার বলেছেন। কারনো কোম্পানির রঙ্গরসের মার্জিত আঙ্গিক চ্যাপলিনকে প্রথম থেকেই মুগ্ধ করেছে। কারনো কোম্পানির হয়ে পশ্চিম ইউরোপের নানা জায়গায় ঘুরে বিভিন্ন দেশের কমেডি বৈশিষ্ট্য ও ধারার সঙ্গে পরিচিত হওয়াটাও চ্যাপলিনের জীবনের কম বড় ঘটনা নয়। বিশেষ করে প্যারিসে বিখ্যাত ফরাসি কৌতুকাভিনেতা ম্যাকস লিন্ডারের নির্বাক ছবি চ্যাপলিনের শিল্পীমনে গভীর রেখাপাত করতে সমর্থ হয়েছিল এবং তা স্বীকার করতে তিনি একটুও দ্বিধান্বিত নন। ১৯১০- ১৩ সালের মধ্যে কারনো কোম্পানির হয়ে দু’দুবার চ্যাপলিন আমেরিকায় যান এবং সেখানে নিউইয়র্কের কোনো থিয়েটারে ওই ভ্রাম্যমাণ দলটির ‘A night in English Music Hall’ নাম এক কমেডিতে মাতালের চরিত্রে নেমে যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দেন। তার অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে যান বিশ্ববিখ্যাত পরিচালক ডি ডাবলিউ গ্রিফিথের কৃতি ছাত্র ম্যাক্স সেনেট যিনি কিনা আমেরিকার কমেডি সিনেমার দিকপাল।  ১৯১৩ সালের ডিসেম্বরে ম্যাক সেনেট তার ২৫ ডলারের বিনিময়ে তার দল কিস্টোন স্টুডিওর সঙ্গে নিয়ে নেন। তবে থিয়েটার থেকে স্টুডিওতে এসে কাজ করতে শুরুতে মানিয়ে নিতে তার একটু অসুবিধাই হচ্ছিলো বটে! সবাই তাঁকে ঈর্ষার চোখে দেখতো। নায়িকা মারলে নরমান্ড তো একরকম কথাই বলতেন না। তিনি প্রকাশ্যে সবার সামনে একদিন বলেছিলেন, ‘এমন বেটে ইংলিশম্যানের সাথে আমি অভিনয় করতে চাইনা।’ অবশ্য এই কথা তোয়াক্কা না করে চ্যাপলিন ঠিকই কাজ করে গিয়েছিলেন। সেই প্রোডাকশনেই চ্যাপলিন প্রথম অভিনয় করলেন ‘Making A Living” সিনেমাতে যা দর্শকদের মনে দাগ কেটেছিলো। ম্যাক সনেট তার অভিনেতাদের দিয়ে নানারকম পারফর্ম করাতেন এই যেমন কোথাও খেলাধুলা হচ্ছে, কোথাও কুচকাওয়াজ হচ্ছে সেখানে গিয়ে বিদঘুটে পোশাক পরে তার অভিনেতাদের নানা রকম পারফর্ম করতে হতো। সেখানে তার ক্যামেরাম্যান চলে যেতো এবং অভিনেতা হিসেবে অধিকাংশ সময়েই চ্যাপলিনকে পাঠানো হতো। একবার বাচ্চাদের এক সাইকেল রেসের মধ্যে চ্যাপলিনকে উদ্ভট কাপড় পড়িয়ে, উল্টো করে বুট পড়িয়ে, নাকে নিচে টুথব্রাশের মতো গোফ ছড়িয়ে এক অদ্ভত সং সেজে চ্যাপলিনকে পাঠানো হলো। তারপর সেখানে দৌড় ঝাপ, ছুটাছুটি এবং মানুষজনের চিল্লাপাল্লা ক্যামেরায় ধারণ করা হচ্ছিলো। এভাবেই সেখানে তার দ্বিতীয় ছবি KID AUTO RACES AT VEVICE এর শুটিং হয়ে গেলো। আনুমানিক ২৫ ফিটের এই ছবির সবাই প্রশংসা করতে লাগলো। পেন্টামাইমের উপর ছিলো চ্যাপলিনের বেশ দক্ষতা। এই বিশেষ আর্ট ফর্মের উপর দক্ষতা ছিল বলেই কোনো গভীর আবেগে অনুপ্রাণিত না হলেও চ্যাপলিনের তখনকার ছবিগুলো এক উন্নতর হাসির খোরাক জুগিয়েছিল। বিশেষ করে তার সঙ সাজা, বিদঘুটে পোশাক তাঁকে দর্শকদের কাছে আলাদা স্থান দিয়েছিলো। ডেনমার্কের রাজকুমার বাদ দিয়ে যেমন মহাকবি শেক্সপীয়রের ‘হ্যামলেট’ অর্থহীন। তেমনি ঢিলে ঢালা ট্রাউজার, আঁটসাঁট কোট, ছড়ি আর বিটকেল-ডাবি-জুতো ছাড়া ভবঘুরে চার্লির কল্পনা করাও ঠিক তেমন অসম্ভব। কিস্টোন স্টুডিওর সাথে সে প্রায় ৩৫ টি সিনেমায় কাজ করেছেন। জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকায় চার্লি তার মাইনে বাড়ানোর কথা সেনেটকে বললেন। সেনেট তাঁকে সপ্তাহে ৪০০ ডলার দিতে চেয়েছিলো কিন্তু চার্লি তখন জাঁদরেল শিল্পী বনে যাওয়ায় সাড়ে ৭০০ টাকা সপ্তাহে দাবি করলেন যা সেনেটের পক্ষে দেওয়া তখন সম্ভব ছিলোনা। তাই অনেক বেশি পারিশ্রমিকের বিনিময়ে চার্লি কিস্টোন ছেড়ে এসানি নামক প্রতিষ্ঠানে চলে গেলেন। এসানিতে চৌদ্দটি ছবি করেছেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো দুই রিলের একটি ছবি ‘THE TRAMP.’’ এই প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ ছবিতেই চার্লির স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করতেন এডনা। এডনা চার্লির সাথে সপ্তাহে মাত্র ১০০ ডলারের বিনিময়ে অভিনয় করতেন। এডনা-চার্লির সম্পর্ক এত ভালোছিলো যে সবাই ভাবতে শুরু করেছিলো তাদের সম্পর্কটা প্রেমে রূপ নিয়েছে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে চার্লি বিয়ে করেন ষোল বছরের এক মেয়ে মিলড্রেড হ্যারিসকে। অবশ্য খুব বেশিদিন সেই সম্পর্ক তাদের টিকেনি। চার্লি তার জীবনে মোট চার বার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। চার্লির ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট হয়ে থাকা দুটো ছবি-SHOULDER ARMS এবং THE GREAT DICTATOR. THE GREAT DICTATOR সিনেমাটিকে অনেকেই মনে করেছেন কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার এক ধরনের কৌশল। সিনেমাটিতে গণতন্ত্রকে জনগণের বিরোধী হিসেবে দেখানো হয়েছে। হিটলার, মুসোলিনির মতো স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে এই ছবি আখ্যায়িত হয়। একজন ইহুদির উপর জার্মান শাসকের অত্যাচার এবং সেখান থেকে শাসনের অবসান ঘটিয়ে সেই ব্যক্তির জয়গান বা বন্দনা দেখানোটাই তার অপরাধ হয়ে গিয়েছিলো। সবাই তখন ভেবেছিলো সে একজন কমিউনিস্ট, তার সিনেমা জনস্বার্থ বিরোধী। যুদ্ধের বিপরীতে গিয়ে শান্তির প্রতিষ্ঠা পর্দায় দেখানোটাই তার কাল হয়ে দাড়িয়েছিলো। অনেক দেশbএই সিনেমাটি প্রদর্শন বন্ধ করে দেয়। বিশেষ করে যেই আমেরিকাতেই তার ক্যারিয়ারের অধিকাংশ সময় পার করা সেই আমেরিকাও এই সিনেমা নিষিদ্ধ করে দেয়। স্ল্যাপস্টিক কমেডির যে কারসাজী তিনি দেখিয়েছেন তা তার পরবর্তী সময়ের কোনো অভিনেতা আর দেখাতে পারেন নি। তার নির্বাক চলচ্চিত্রের প্রতি মুগ্ধ হয়ে ‘দি বাইসাইকেল থিভস’ সিনেমার পরিচালক ভিত্তোরিও ডি সিকা বলেছিলেন, আসলে সিনেমা জন্মের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত এমন কোনো শিল্পী নেই যে কিনা চ্যাপলিনের প্রতিভাকে ছাপিয়ে গিয়েছে। এই বিশ্ববরেণ্য অভিনেতা ১৯৭৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর সুইজারল্যান্ডে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর এত বছর পর আজও তাঁকে সবাই অভিনয়ের প্রতিষ্ঠান হিসেবে মনে করে।

No comments

Powered by Blogger.