Adsterra

পাকিস্তানের রাজনীতি আবারও সেনাবাহিনীর হাতে

পাকিস্তানের রাজনীতি আবারও সেনাবাহিনীর হাতে, ঢাকা ভয়েজ,  dhaka voice;

পাঁচ বছর এবং পঞ্চাশ মাইল- এই শব্দবন্ধ দুটি দিয়ে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তেহরিক-ই-ইনসাফ পার্টির প্রধান ইমরান খানের চূড়ান্ত উত্থানের দিন এবং তাঁর বর্তমান অবস্থানকে খুব ভালোভাবে উপস্থাপন করা যায়। পাঁচ বছর আগে, ২০১৮ সালে ইসলামাবাদে জাতীয় পরিষদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন তিনি। পাঁচ বছর পর দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত হয়ে ঠিক সেই জায়গা থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে পাঞ্জাব প্রদেশের কারাগারে ঠাঁই হয়েছে তাঁর। 


যদিও ইমরান খান নিজের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁর দাবি, এই দণ্ড রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সরকারও ইমরানের পাল্টা অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তবে ৩ বছরের কারাদণ্ডের রায়ের পরপরই ইমরানকে পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। আর এই সিদ্ধান্ত ইমরান ও তাঁর দলকে রাজনীতির মাঠ থেকে দূরে রাখার পাকিস্তানের প্রভাবশালী সেনাবাহিনীর চূড়ান্ত ইচ্ছাকে প্রতিফলিত করে। একই সঙ্গে তা রাজনীতিতে জেনারেলদের কঠোর নিয়ন্ত্রণের নির্দেশক।

ইমরান খানের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, তা তাঁর পারিবারিক ঐতিহ্য, ধর্মাচারী জীবন ও দুর্নীতিবিরোধী ভাবমূর্তির সঙ্গে বেমানান। তাঁর বিরুদ্ধে নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গের যেসব অভিযোগ করা হয়েছে, সেগুলোও পাকিস্তানে খুব একটা আমলে নেওয়া হয় না। সঙ্গতকারণেই দুর্নীতি বা নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গের কারণ দেখানো হলেও ইমরানের অপরাধ আসলে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে টক্কর দেওয়া।


পাকিস্তানের অন্য নির্বাচিত শাসকদের মতো ইমরান খানও এক সময় সেনাবাহিনীর আস্থাভাজন ছিলেন। কিন্তু একপর্যায়ে তাঁর সরকারের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক অবস্থান, ভুল আর্থিক ব্যবস্থাপনার কারণে সেনাবাহিনী ইমরানের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এর ফলে ২০২২ সালের এপ্রিলে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তাঁকে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। 


ক্ষমতাচ্যুত হলেও ইমরান খান তাঁর পূর্বসূরিদের মতো মুখ বন্ধ করে ছিলেন না। সরকারে থাকাকালে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যতটা না সরব ছিলেন, তার চেয়ে বেশি সরব হয়ে ওঠেন ক্ষমতা হারানোর পর। তিনি সেনাবাহিনীকে মৌখিক আক্রমণের পাশাপাশি দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে বিশাল বিশাল মিছিল, রাজনৈতিক জনসভা করেছেন। এ সময় তিনি একাধিক বার দাবি করেন, জেনারেলরা তাঁকে প্রাণে মেরে ফেলতে চায়। এমনকি ২০২২ সালের নভেম্বরে এক জনসভায় ইমরান খানকে গুলি করা হয়। চলতি বছরের ৯ মে ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের পর তাঁর বিক্ষুব্ধ সমর্থকেরা সেনা ও রাষ্ট্রীয় স্থাপনায় ভাঙচুর চালায় বলে অভিযোগ করে সেনাবাহিনী ও সরকার। 


ইমরান সমর্থকদের নজিরবিহীন বিক্ষোভের প্রতিক্রিয়ায় সেনাবাহিনীর জিঘাংসা আরও বেড়ে যায়। ‘বিদ্রোহীদের’ শায়েস্তা করতে ইমরান খানের দলকেই ভেঙে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করে তাঁরা এবং দলীয় নেতা-কর্মীদের ওপর ব্যাপক ধরপাকড় চালায়। কেবল তাই নয়, জ্যেষ্ঠ নেতাদের দল ছাড়তে বাধ্য করে। পাশাপাশি সাজা দিয়ে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার মাধ্যমে বাস্তবে ইমরানকে রাজনীতি থেকে ‘চিরতরে’ নির্বাসনের ছক বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সেনাবাহিনী। 


ইমরানকে রাজনীতির মাঠ থেকে বিদায় করার এই নকশা বরাবরের মতোই পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ জানান দেয়।  সেই উচ্চাভিলাষের পরিপূরক হাইব্রিড শাসনব্যবস্থা বাস্তবায়নে নিঃশর্ত সহায়তা দিয়েছে বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ও নতজানু জাতীয় পরিষদ। এমনকি বিদায়ের আগে সেনাবাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থার ক্ষমতাকে বাড়াতে নতুন একগাদা আইন পাশ করে গেছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এগুলোর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। 


কেবল সেনাবাহিনীকেই ক্ষমতায়িত করেনি বিদায়ী শাহবাজ সরকার, দেশটির অন্তর্বর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতার পরিধি বাড়িয়েছে। নির্বাচনকালীন এই সরকারের ধারণার সঙ্গে যায় না এমন ক্ষমতাও তাঁরা পেয়েছে। আইএমএফের সঙ্গে চুক্তি, বিদেশি বিনিয়োগের চুক্তি ও ভোটার তালিকা হালনাগাদকরণের মতো নির্বাচিত সরকারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে। এর পেছনে যে ছক সুপ্ত আছে তা হলো, সংবিধান নির্ধারিত ৯০ দিন মেয়াদের বেশি তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ক্ষমতায় থাকতে দেওয়া। সেক্ষেত্রে এসব কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষা অজুহাত হিসেবে দেখানো হতে পারে। তেমন ইঙ্গিত এরই মধ্যে দিয়েছেন সদ্য বিদায়ী সরকারের আইনমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, সব মিলিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে পাঁচ মাসেরও বেশি সময় লাগতে পারে। 


শাহবাজ শরিফ কেন সেনাবাহিনীকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন এবং কেন নির্বাচন বিলম্বিত হতে পারে সে বিষয়টি পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থার আলোকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। দেউলিয়ার মুখে পড়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ৩০০ কোটি ডলার ঋণ নিশ্চিত করেছেন শাহবাজ। কিন্তু জ্বালানিসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের আকাশচুম্বী দাম, উচ্চ সুদহার ও মুদ্রা বিনিময় হার বেশি হওয়ার কারণে শাহবাজ সরকারের বিরুদ্ধে জনঅসন্তোষ বাড়ছে। তাই নির্বাচন যত পেছাবে, শাহবাজ, তাঁর দল ও জোটের জন্য তত সুবিধাজনক বলে প্রতীয়মান হবে। কারণ, পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে তার দায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর বর্তানো সহজ হবে এবং অতীতের জনবিরোধী এবং অপ্রয়োজনীয় সিদ্ধান্তও জনমানস থেকে মুছে ফেলা সহজ হবে।


এর বাইরেও বিভিন্ন দিক থেকে শাহবাজ শরিফের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হতে পারে। এর মধ্যে প্রধান হলো, সেনাপ্রধানের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক। ৯ মাস আগে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে জেনারেল অসিম মুনীর শাহবাজের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া ইকোনমিক কাউন্সিল গঠন করে উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার চেষ্টাও করেছেন তিনি। বিশেষ করে সেসব দেশ থেকে পাকিস্তানে বিনিয়োগ আনার চেষ্টা করেছেন। 


তবে বিশ্লেষকদের মত হলো, জনগণের আস্থা হারানোর কারণে শাহবাজ আসলে অর্থনৈতিক সহযোগিতার আড়ালে রাজনৈতিক মদদ চাইছেন। একই কারণে সেনাবাহিনীর উপরও তার নির্ভরতা বেশি। এমন পরিস্থিতির মধ্যে ইমরান খানের অনুপস্থিতি পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপকে জোরালো করেছে। 


পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব লেজিসলেটিভ ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ট্রান্সপারেন্সির প্রেসিডেন্ট আহমেদ বিলাল মেহবুব মনে করেন, পাকিস্তান সম্ভবত ‘নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের’ নতুন এক রাজনৈতিক ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে নাগরিক অধিকার খর্ব করা হবে।’ তিনি আরো বলেন, সম্ভবত পাকিস্তানের জেনারেলরা চান দেশ হোক ‘চির অস্থিতিশীল’, যেখানে তাদের উচ্চাভিলাষ কোনো বাধার মুখে পড়বে না। 


No comments

Powered by Blogger.