যেভাবে লেখক হয়ে উঠেছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
লেখালেখি করবেন, লেখক হবেন—এই স্বপ্ন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছিল না। ছেলেবেলা থেকেই অভাব-অনটনের মধ্যে বড় হয়েছেন। আর এই অভাব-অনটন ডিঙিয়েই তিনি লেখক হয়েছেন। তাঁর লেখক হওয়ার গল্পটা খুবই চমকপ্রদ।
১৯১৮ সালে রিপন কলেজ থেকে ডিসটিংশন নিয়ে বিএ পরীক্ষায় পাস করেন বিভূতিভূষণ। শুরু হয় চাকরির প্রচেষ্টা, যোগ দেন হুগলির জাঙ্গিপাড়ার মাইনর স্কুলে। পরে জাঙ্গিপাড়া থেকে যান সোনারপুরের হরিনাভিতে। আর এই হরিনাভিই বিভূতিভূষণের জীবনের ছক বদলে দেয়।
পরের দিন স্কুলে গিয়ে বিভূতিভূষণ দেখেন, তাঁর
উপন্যাস বেরোচ্ছে মর্মে দেয়ালে দেয়ালে বিজ্ঞাপন সাঁটা। কাজটা যে পাঁচুগোপালের তা
বুঝতে একমুহূর্তও দেরি হয় না বিভূতিভূষণের। তিনি উত্তেজিত হয়ে পাঁচুগোপালের কাছে
প্রশ্ন করেন, এমনটা কেন করলে? এই রসিকতার মানে কী? উত্তরে একটুও ভণিতা না করে
পাঁচুগোপাল বলেন, ভেবেছিলাম দুজনে মিলে লিখে ফেলব।
১৯২০ সালের জুন মাস। হরিনাভির দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ অ্যাংলো সংস্কৃত বিদ্যালয়ে পড়ানোর কাজে যোগ দিয়েছেন বিভূতিভূষণ। একা থাকেন। এর মধ্যে পরিচয় হয় স্থানীয় পাঁচুগোপালের (ভালো নাম যতীন্দ্রমোহন রায়) সঙ্গে। পাঁচুগোপাল লেখালেখি করেন। বয়স অল্প। স্কুলের সময়টুকু ছাড়া বেশির ভাগ সময় পাঁচুগোপালের সঙ্গেই কাঁটে বিভূতিভূষণের। তাঁরা গ্রামের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পায়ে হেঁটে ঘুরে ঘুরে দেখেন। আর এই ঘোরাঘুরি করতে করতেই পাঁচুগোপালের সঙ্গে বিভূতিভূষণের সখ্য হয়। একদিন বিভূতিভূষণের হাতে একটি বই ধরিয়ে দিয়ে দুজনে মিলে একটা বই লেখার প্রস্তাব দেন পাঁচুগোপাল।
প্রস্তাবে রাজি হওয়া তো দূরের কথা, বিভূতিভূষণ কোনো ভ্রুক্ষেপই করেন না। ফলে যা ঘটার তা–ই ঘটে।
পরের দিন স্কুলে গিয়ে বিভূতিভূষণ দেখেন, তাঁর উপন্যাস বেরোচ্ছে মর্মে দেয়ালে দেয়ালে বিজ্ঞাপন সাঁটা। কাজটা যে পাঁচুগোপালের, তা বুঝতে একমুহূর্তও দেরি হয় না বিভূতিভূষণের। তিনি উত্তেজিত হয়ে পাঁচুগোপালের কাছে প্রশ্ন করেন, এমনটা কেন করলে? এই রসিকতার মানে কী? উত্তরে একটুও ভণিতা না করে পাঁচুগোপাল বলেন, ভেবেছিলাম দুজনে মিলে লিখে ফেলব। এমন সোজাসাপটা উত্তরে কিছু বলতে পারেন না বিভূতিভূষণ। আবার সহ্যও করতে পারেন না। সহকর্মী থেকে শুরু করে পরিচিত, স্বল্পপরিচিত—সবার মুখে এক প্রশ্ন, কবে আসবে উপন্যাস? কী করব, কী করি ভাবতে ভাবতে শেষমেশ লেখার সিদ্ধান্ত নেন বিভূতিভূষণ।
কিন্তু কী লিখবেন? ভাবতে ভাবতে একটা গল্প লেখেন তিনি। তারপর প্রকাশের জন্য সেটি কলকাতার একটি মাসিক পত্রিকায় পাঠান। শুরু হয় অপেক্ষা। একেকজন একেক রকম বলেন। কেউ বলেন, পরিচয় না থাকলে লেখা ছাপা হওয়া না। আবার কেউ বলেন, লেখা ভালো হলে এমনিতেই ছাপে। এমন সব সংশয় নিয়েও আশা হারান না বিভূতিভূষণ। ওই সময় ডাকের মাধ্যমে লেখা পাঠাতে হতো। সঙ্গে একটি ফেরত খামও দিতে হতো। অমনোনীত লেখা ফেরত খামে ফেরত আসত। অবশেষে অপেক্ষার অবসান হয়। সপ্তাহখানেক বাদে ফেরত খাম আসে। বিভূতিভূষণ তখন স্কুলে। গল্প ফেরত এসেছে ভেবে কেউ দেখার আগেই দ্রুত খামটা পকেটে রেখে দেন। (ফেরত খাম আসা বিষয়ে দিনলিপিতে বিভূতি লিখেছেন, ‘দুঃখ তো হলো, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এই আনন্দও হলো যে রোজকার দুশ্চিন্তা তো কাটল। আমার মনের অবস্থা এমন হলো যে কোনো প্রিয়জন অসাধ্য রোগে মারা গিয়ে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেল।’)। কিন্তু বাড়ি ফিরে খাম খুলতেই বিস্মিত হন। খামের মধ্যে লেখার বদলে একটি চিঠি। সম্পাদক মহোদয় লিখেছেন, ‘আপনার রচনা মনোনীত হয়েছে, শীঘ্রই প্রকাশিত হবে।’ ১৩২৮ সালে ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় বিভূতিভূষণের প্রথম গল্প ‘উপেক্ষিতা’ প্রকাশিত হয়। ওই বছর শ্রেষ্ঠ গল্প ক্যাটাগরিতে গল্পটি শ্রেষ্ঠ গল্পের মর্যাদাও পায়।
এ তো গেল বিভূতির গল্প লেখার কথা, কিন্তু উপন্যাস? বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’। উপন্যাসটি বিভূতি যখন লেখেন, তখন তিনি ছিলেন ভাগলপুরে। স্কুলের চাকরি ছেড়ে নতুন কাজ নিয়ে ভাগলপুরের বাঙালিটোলায় গিয়েছিলেন তিনি। তবে ‘পথের পাঁচালী’ পাঠকের হাতে পৌঁছানো সহজ ছিল না, যদি না উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিভূতিভূষণের দেখা হতো। সবিস্তারে বলি, উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন আইনের ছাত্র। কিন্তু আইনের ছাত্র হলে কী হবে, সাহিত্যের প্রতি ভীষণ ভালো লাগা ছিল তাঁর। কেবল ভালো লাগা ছিল বললে ভুল বলা হবে, তিনি লিখতেনও। ওই সময়ের সব মানসম্পন্ন পত্রিকাতেই তাঁর লেখা বেরিয়েছিল। আর সেই মানুষই কিনা পড়ালেখার পাঠ চুকতেই ওকালতি করার উদ্দেশ্যে পৈতৃক নিবাস ভাগলপুরে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। আর ভাগলপুরে ফিরে কেবল পেশাগত প্র্যাকটিস পর্যন্ত থেমে থাকেননি তিনি। সাহিত্যপ্রেমী মানুষদের নিয়ে আড্ডার আয়োজনও শুরু করেন। প্রায় তাঁদের বসার ঘরে আড্ডা বসত। জ্ঞানী-গুণী, বিদগ্ধ মানুষেরা আড্ডায় যুক্ত হতেন। একদিন ঘুরতে ঘুরতে বিভূতিভূষণও আড্ডায় গিয়ে উপস্থিত হলেন। পরে মনে ধরলে নিয়মিত যেতে শুরু করলেন। কিন্তু কথা বলতেন না, চুপচাপ সবার কথা শুনতেন। বিভূতিভূষণকে চোখে পড়লেও তাঁর সঙ্গে খোলাখুলিভাবে তখনো আলাপ হয়নি উপেন্দ্রনাথের। বিভূতিভূষণ নিয়মিত আড্ডায় অংশ নেন, এ পর্যন্তই। কিন্তু এক ভরা বাদলের দিনে কেউ আড্ডায় উপস্থিত হতে না পারলেও বিভূতিভূষণ গিয়ে উপস্থিত হন। বিভূতির সঙ্গে কথা শুরু করেন উপেন্দ্রনাথ। নানা কথা শেষে এক পর্যায়ে জানতে চান, ‘গল্প, কবিতা কিছু লেখেন?’ বিভূতি লজ্জাবনত স্বরে জবাব দেন, ‘সেভাবে তো কিছু লিখি না, একটা উপন্যাস লিখেছি।’ ‘উপন্যাসের পাণ্ডুলিপিখানা একদিন পড়তে দেন। পড়ে দেখি কেমন লিখেছেন’, বলেন উপেন্দ্রনাথ। বিভূতিভূষণ তত দিনে উপেন্দ্রনাথের জ্ঞান-গরিমায় মুগ্ধ। তাই তো ভয়ে ভয়ে উপন্যাসের পাণ্ডুলিপিটা উপেন্দ্রনাথের কাছে জমা দেন। আবারও শুরু হয় অপেক্ষা। বিভূতিভূষণ আশায় বুক বেঁধে আড্ডায় যান। আশা অন্য কিছু নয়, উপেন্দ্রনাথের মুখে নিজের প্রথম উপন্যাস বিষয়ে দুটি কথা শোনা।
কিন্তু এক দিন, এক সপ্তাহ করে মাস কেটে গেলেও উপেন্দ্রনাথ কিছু জানান না। সাহস করে যে জানতে চাইবেন, সে সাহসও বিভূতিভূষণ করে উঠতে পারেন না। অগত্যা মনে মনে ভেবে নেন, উপন্যাসটি মানসম্মত হয়নি।
কিন্তু হঠাৎ ঝরে পড়া বৃষ্টির মতো একদিন অন্য রকম ঘটনা ঘটে। আড্ডা শেষে উপেন্দ্রনাথ বিভূতিভূষণকে ডেকে তাঁর লেখার ভূয়সী প্রশংসা করেন। সঙ্গে এ-ও জানান যে তিনি কলকাতায় ফিরে যাচ্ছেন। সেখানে গিয়ে একটি পত্রিকা বের করবেন। নামও ঠিক হয়েছে ‘বিচিত্রা’। আর ‘বিচিত্রা’তেই ‘পথের পাঁচালী’ ছাপতে চান তিনি।
উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘বিচিত্রা’তেই কিস্তিতে প্রকাশিত হয় ‘পথের পাঁচালী’। ঝলমল আলোকের টলমল রূপরেখার মতো ‘পথের পাঁচালী’র কয়েক কিস্তি প্রকাশিত হতেই চারদিকে শোরগোল পড়ে যায়। বাংলা সাহিত্যে ধ্রুবতারারূপে অবতীর্ণ হন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
আজ ১২ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪ সালে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন তিনি। কেবল ‘পথের পাঁচালী’ই নয়, তাঁর প্রায় সব লেখাই আগ্রহের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন পাঠকেরা। যাপিত জীবনের জঠরযন্ত্রণা, দুই চোখে দেখা বিচিত্র ঘটনা, অর্জিত অভিজ্ঞতা—সবই মুখ থেকে কাগজে-কলমে স্থানান্তর করে গেছেন তিনি। তাই তো আজও একইভাবে সব শ্রেণির পাঠকের কাছে তিনি সমাদৃত।
No comments