হাসিও যখন মহামারি
বসন্ত, কলেরা কিংবা হালের করোনার মহামারির সাথে আমরা অনেকেই পরিচিত। কিন্তু একবার হাসিও ধারণ করেছিল মহামারীর আকার। হাসতে হাসতে অসুস্থ হয়ে পড়তো মানুষ। ১৯৬২ সালে পাঞ্জানিয়ার কয়েকটি গ্রামের ছড়িয়ে পড়ে হাসির মহামারি। হাসিও যে একটি অসুখ হতে পারে এর আগে হয়তো কারো ধারণাই ছিল না।
ঘটনার শুরু ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি, লেক ভিক্টরিয়ার পশ্চিম উপকূলে একটি মিশনারি বোর্ডিং স্কুলে প্রথম এই অদ্ভুত অসুখ দেখা যায়। ৩ ছাত্রী বিনা কারণেএকসঙ্গে হাসতে শুরু করে। সম্ভবত কোনো একটি মজার কথায় শুরু হয়েছিল তাদের হাসি। ইচ্ছা হলেও হাসি থামানোর কোন ক্ষমতা তাদের সেদিন ছিল না। প্রসারিত হতে থাকে হাসির থাবা। ঐ তিন জন থেকে অট্টহাসি ছড়িয়ে পড়ে স্কুলের ছাত্রীদের মধ্যেও। ১৫৯ জনের মধ্যে হাসির আক্রমণের শিকার হয় ৯৫ জন। যাদের বয়স ছিল ১২ থেকে ১৮ বছর। উগান্ডা ঘেষা গ্রামে সূত্রপাত হওয়া মহামারি বিশ্বজুড়ে পরিচিত হয় তানগানিয়েকা লাফটার অ্যাপিরেমিক বা তাঞ্জানিয়ার হাসির মহামারি হিসেবে। কয়েক দিন ধরে চলতে থাকে লাফিং অ্যাটাক হাসির আক্রমণ। পাগলের মতো হাসতে হাসতে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছিল স্কুলের শিক্ষার্থীরা। সাময়িকভাবে স্কুল বন্ধ রাখা সিদ্ধান্ত নেয় কতৃপক্ষ। অদ্ভুত বিষয় হলো স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকা কিংবা কর্মচারীরা এই রোগে আক্রান্ত হয়নি। আক্রান্তরা যে ২৪ ঘন্টায় হাসতো ব্যাপারটি কিন্তু তেমন ছিল না। যখন শুরু হতো এই লাফটার অ্যাটাক তখন থামানো যেত না। পাগলের তো হাসির দৌড়ে ভেস্তে যেত নিয়মিত কাজকর্ম। আচমকা জ্ঞান হারানো, শ্বাস কষ্ট, হঠাৎ কেঁদে ওঠে পরক্ষণে আবার ভয়ে আর্তনাদ করা হাসি, মানসিক বৈকল্যের এমন সকল লক্ষণও দেখা দিয়েছিল আক্রান্তদের মাঝে।
কাশাসার অদূরে আসাম্বা নামের আরেক গ্রামের কিশোর-কিশোরীদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে এই রোগ। পাঁচ মাসে আক্রান্ত হয় ২১৭ জন কিশোর-কিশোরী। এই মহামারি আরো ছড়িয়ে পড়লে বন্ধ করে দিতে হয় চৌদ্দটি স্কুল। ধারণা করা হয় মোট আক্রান্তের সংখ্যা হাজারের বেশি ছিল। এভাবে চলতে থাকে ১৮ মাস। তারপর একদিন সুস্থ হয়ে যেত আক্রান্ত ব্যক্তি। এই মহামারিতে কেউ অবশ্য মারা যায়নি।
হাসির এই মহামারী আসলে কি? কেনইবা এর আবির্ভাব ঘটল তাঞ্জানিয়ার। এ সময় যেসব উপসর্গ দেখা দেয় তার অনেক তৈরি হয়েছিল বাহ্যিক নানা চাপে। মানসিক অসুখ বা হতাশা থেকে হাসির রোগের বিস্তার। পরে এমনটি মনে করেছিলেন বিশেষজ্ঞরা অন্য কাউকে হাসতে দেখলে আমাদের হাসি পায়। হাসির এই সংক্রমণ ক্ষমতাও এখানে একটি বড় ভূমিকা রেখেছে। হাসির মহামারী ঘটানোর পেছনে সামাজিক প্রেক্ষাপটের প্রভাব থাকতে পারে।
স্বাধীনতা পরবর্তী তাঞ্জানিয়ার সাংস্কৃতিক পরিবর্তন, অনিশ্চয়তা, অপরিকল্পিত রাষ্ট্র কাঠামো ও উপনিবেশ প্রভাব থেকে বের হবার চেষ্টা সহ উদ্বেগ তৈরি নানাবিধ কারণ ছিল। ভবিষ্যতের কান্ডারী হিসেবে কিশোরীদের উপর হঠাৎ করে অত্যাধিক বেড়ে গিয়েছিল প্রত্যাশা চাপ। চাপে পড়ার কারণে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছিল শিক্ষার্থীরা। মাছহিস্ট্রিয়া এর কারণে ও এমন হয়ে থাকতে পারে।
একই সময় একটি নির্দিষ্ট দল বা জনগোষ্ঠীর গণঅসুস্থতায় আক্রান্ত হওয়ার মত ঘটনা মধ্যযুগ থেকেই ঘটেছে। তাঞ্জানিয়ার হাসির মহামারি ছাড়াও উগান্ডাতে দেখা গেছে রানিংমেনিয়া বা দৌড় পাগলামো। সালেমের উইচ ট্রায়াল, ইউরোপের ড্যান্সিংমেনিয়া সহ কোভিড -১৯ এর সময় টয়লেট পেপার প্যানিক ইতিহাস জুড়ে রয়েছে এমন অসংখ্য মহামারির উদাহরণ। কারণ যেটাই হোক। হাসতে হাসতে খুন হয়ে যাওয়ার মত অসুস্থতার কবলে না পড়াই কাম্য।
No comments