Adsterra

স্যার এডওয়ার্ড হিথ || মুক্তিযুদ্ধে বিদেশির অবদান

ঢাকা ভয়েজ,  dhaka voice;  স্যার এডওয়ার্ড হিথ || মুক্তিযুদ্ধে বিদেশির অবদান

ব্রিটিশ রাজনীতিবীদ স্যার এডওয়ার্ড রিচার্ড জর্জ হিথ ১৯১৬ সালের ৯ই জুলাই কেন্টের ব্রডস্টেয়ারের ৫৪ আলবিয়ন রোডে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ডাক নাম ছিল টেডি। তাঁর পিতা উইলিয়াম জর্জ হিথ এবং মাতা এডিথ অ্যান হিথ। হিথ র‍্যামসগেটের চ্যাটাম হাউজ গ্রামার স্কুলে লেখাপড়া করেন। ১৯৩৫ সালে কাউন্টি বৃত্তি পেয়ে তিনি বালিওল কলেজে ভর্তি হন।

    হিথ ১৯৭০ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি ১৯৬৫ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত কনসারভেটিভ পার্টির নেতা ছিলেন। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার এডওয়ার্ড রিচার্ড জর্জ হিথ সেই ব্যক্তি যিনি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর লন্ডনে গেলে তাঁকে সম্মানের সঙ্গে বরণ করেন। আবার গণহত্যা বন্ধেও তিনি ইয়াহিয়া খানকে চিঠি পাঠান। স্বাধীনতাত চার দশক পর তাঁকে সম্মাননা জানায় বাংলাদেশ।

     ১৯৯৬ সালের এপ্রিল মাসে লিখিতভাবে এই মর্মে তিনি বিবৃতি দিয়েছেন যে, ‘১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনা করেন এবং স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামে নতুন দেশের নাম ঘোষণা করেন।গণতান্ত্রিক বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিশ্ব জুড়ে তাঁর খ্যাতি ও সুনাম ছিল। বিশ্বের দেশে দেশে গণতন্ত্রের স্বার্থে তিনি বহু ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্রের প্রসার ঘটে এবং তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশের সামরিক শাসনের অবসান হয় এবং তদস্থলে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার গঠিত হয়। এমন দেশের ক্ষেত্রে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে স্যার এডওয়ার্ড হিথের প্রচ্ছন্ন ও পরোক্ষ আশীর্বাদ ছিল বলে ঐতিহাসিকগণ স্বীকৃতি দিয়েছেন।


     শেখ মুজিবের সেই ঐতিহাসিক স্বাধীনতাঘোষণা সম্পর্কে স্যার এডওয়ার্ড হিথ উল্লেখ করেন, ‘বাংলাদেশের উক্ত স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল একটি ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধ এবং গণতান্ত্রিক যুদ্ধ। বাঙ্গালী জাতির উক্ত স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল সে সময়ের বিশ্বে সংঘটির অন্যতম মহান ঘটনা। বাংলাদেশে তিনি যখন এসেছিলেন তখন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন বাংলাদেশের জনগণ এবং বাংলাদেশের ভূখণ্ড সম্পর্কে উন্নত বিশ্বের কোনো ধ্যান ধারণা ছিল না। ৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে তোমরা বিশ্বজোড়া খ্যাতি পেলে, বীরের জাতির সম্মান অর্জন করলে এবং তোমরা বিশ্বকে এবং বিশ্ববরেণ্য নেতা উপহার দিলে।যার সম্পর্কে আমাদের হাউজ অব লর্ডসের সম্মানিত সদস্য ফুনার ব্রকওয়ে বলেছেন, “In a sense sheikh Mujib is a greater leader than George Washington, Mahatma Gandhi and De valera Avwgতাঁর মূল্যায়নের সাথে ঐকমত্য পোষণ করি। সেই বাংলাদেশের জন্য ৭১ সালে আমি সামান্যতম ভূমিকা রাখতে পারায় নিজেকে ধন্য মনে করি এবং সৃষ্টিকর্তাকে কৃতজ্ঞতা জানাই। তবে ইতিহাসে সত্য বলে সর্বশেষে আমি পুণ্য মনে এই সত্য উচ্চারণ করতে চাই যে, বাংলাদেশের ওপর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আশীর্বাদের হাত ছিল এবং বাঙ্গালি জাতির শ্রেষ্ঠনেতা বাংলাদেশের স্রষ্টা শেখ মুজিবের প্রাণ রক্ষার জন্য তিনি রক্ষা কবচরূপে বিশ্ব নেতাদের কাছে প্রতিভাত হয়েছিলেন। বলা যায়, বাংলাদেশ ইস্যুতে ও শেখ মুজিবের ন্যায় মানবজাতির একজন শ্রেষ্ঠ নেতার জীবন রক্ষার্থে বিশ্ব নেতারা ও আমি অনেকাংশে তাঁর ওপর নির্ভর করেছিলাম এবং তিনি বিশ্ব নেতাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণে সর্বোত্তম নিদর্শন স্থাপন করে বিশ্বশান্তি রক্ষায়৭১ সালে বিশাল অবদান রেখেছিলেন।


      ৮ জানুয়ারি,১৯৭২লন্ডনে হাড়কাপানো শীতের মাঝে পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের এক মুহূর্তের উষ্ণতা নিয়ে হিথরো বিমানবন্দরে অবতরণ করে পাকিস্তান এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট। এই বিমানে নামছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এভাবেই এক মহানায়কের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে যায় ব্রিটেনের নাম। বঙ্গবন্ধু চাইছিলেন পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে সরাসরি বাংলাদেশেই ফিরবেন। পাকিস্তানের তৎকালীন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আজিজ আহমদ ইরান-তুরষ্ক রুট ধরে বঙ্গবন্ধুকে ঢাকায় ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। রুটটি পছন্দ হয় নি বঙ্গবন্ধুর। তিনি ঢাকায় সরাসরি ফিরতে চান। আজিজ আহমদ জানালেন, ‘এটি সম্ভব নয়। কারণ ভারতের আকাশসীমা তারা ব্যবহার করতে পারবেন না। যেহেতু ভারত হয়ে যেতে পারবেন না তাই অন্য একটি দেশে আপনাকে যেতে হবে।শেষ পর্যন্ত অন্য দেশ হিসেবে ব্রিটেনকে বেছে নেওয়া হয়। এরপর ৮ জানুয়ারি, রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা বজায় রেখে বঙ্গবন্ধুকে লন্ডন পৌঁছে দেয় পাকিস্তান।


     হিথরোয় বিমান অবতরণের এক ঘন্টা আগে ব্রিটেন জানতে পারে, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অল্প সময়ের ব্যবধানেই লন্ডনে এসে পৌছবেন। খবরটি ছড়িয়ে পড়ে, বিবিসির ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে ভোরের খবরে জানায় বঙ্গবন্ধুর লন্ডনে আগমনের খবর। ব্রিটেন সিদ্ধান্ত নেয়, তারা বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা প্রদান করবে, রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বরণ করবে। বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে বরণ করে নেন ফরেন অফিসের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা স্যার ইয়ান সাদারল্যান্ড। তিনি জানান, বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে ব্রিটেনের ক্ল্যারিজেস হোটেলে নিয়ে যাওয়া হবে। হোটেলে পৌছার পর লেবার পার্টির তৎকালীন লিডার হ্যারল্ড উইলসন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। হ্যারল্ড উইলসন হচ্ছেন প্রথম কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে সম্বোধন করেন। বঙ্গবন্ধুর দিকে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে ক্ল্যারিজেস হোটেলে আয়োজন করা হয় এক সংবাদ সম্মেলনের। এটিই ছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধুর প্রথম প্রেস কনফারেন্স। এতে আবেগঘন ভাষায় প্রবল আত্মবিশ্বাসী স্বরে তিনি বললেন, ‘আমি কনডেম সেলে ফাঁসির অপেক্ষায় ছিলাম, বাঁচব কি মরব কিছুই জানতাম না, তবে জানতাম বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই।হোটেলের ভিতরে বক্তব্য দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু, বাইরে তখন হাজারো বাঙ্গালির ভিড়। জয় বাংলাস্লোগানে মুখরিত অভিজাত এলাকা। দলে দলে আসছে মানুষ।


     হাজার হাজার বাঙ্গালী সমবেত প্রিয় বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য। যিনি তাদের দিয়েছেন একটি পতাকা, একটি মানচিত্র। সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে হাসিমুখে হাত নাড়েন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুকে ফিরে পেয়ে বহু প্রবাসী বাঙ্গালির চোখে জল এসেছিল সেদিন। বিকাল ৫টায় বঙ্গবন্ধু ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ১০ নাম্বার ডাউনিং স্ট্রিটে যান। তাঁকে বরণ করে নিলেন কনজারভেটিভ পার্টির লিডার, প্রধানমন্ত্রী এডও্য়ার্ড হিথ জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনাকে আর কি সহযোগিতা করতে পারি, বলুন।তৎক্ষণাৎ বঙ্গবন্ধু উত্তর দিলেন,’ আপনার প্লেনটা চাই, ওটা দিয়ে পারবেন, আমি খুব দ্রুত দেশে ফিরতে চাচ্ছি।এডওয়ার্ড  হিথ ব্যবস্থা করলেন সঙ্গে সঙ্গে। বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু যখন গাড়িতে উঠবেন তখন প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ নিজে এগিয়ে এসে তাঁর জন্য গাড়ির দরজা খুলে দিলেন। দরজা ধরে তিনি ততক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ভিতরে গিয়ে না বসলেন। আর কোনো রাষ্ট্র প্রধানের জন্য, কোনো ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এমন সম্মান দেখাননি কখনো। এ ঘটনা নিয়ে হিথ সমালোচনার স্বীকার হয়েছিলেন কিন্তু তিনি তা পাত্তা দেন নি, বরং উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ আমি যাকে সম্মান করেছি, তিনি হচ্ছেন একটি জাতির মুক্তিদাতা মহান বীর। তাঁকে এই সম্মান প্রদর্শন করতে পেরে বরং আমরাই সম্মানিত হয়েছি।


      ৯ জানুয়ারি, ১৯৭২, ভোর ৬ টা লন্ডন হিথরো বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানালেন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ বিভাগের কর্মকর্তা ইয়ান সাদারল্যান্ড ও লন্ডনে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার আপা বি বি পন্থ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ করিয়ে দেন আপা বি পন্থ। ৩০ মিনিট ধরে চলে ইন্দিরা-মুজিব টেলিফোন আলাপচারিতা। পরে ইন্দিরা গান্ধী আবার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলেন দিল্লিতে আসার আমন্ত্রণ জানান। দিল্লিতে ইন্দিরার সঙ্গে বৈঠকের আগেই তাঁর কাছে খবর পৌঁছানো হলো বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় মিত্রবাহিনী সদস্যের ৩১ মার্চ, ১৯৭২ সালের মধ্যে ভারতে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি চূড়ান্ত করতে হবে।তিনি বলেন, ‘ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর এ বিষয়ে কথা হয়েছে। ভারতীয় মিত্রবাহিনী চলে গেলে বাংলাদেশ ব্রিটিশ সরকারের স্বীকৃতি পেতে আর কোনো বাধা থাকবে না।


    মধ্যপ্রাচ্য থেকে জ্বালানি নিয়ে বিমানটি আবার উড়তে শুরু করে দিল্লির উদ্দেশ্যে। দিল্লিতে শেখ মুজিবকে স্বাগত জানালেন ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং সহ আরও অনেকে। মুজিব-ইন্দিরা বৈঠকে তিন মাসের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনাদের ফিরিয়ে আনার বিষয়টি নিয়ে কথা হয়।


      ২০০৫ সালে ৮৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন এই চিরকুমার রাজনীতিবিদ। হিথ বাংলাদেশের বড় একজন শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। তাঁকে মরণোত্তর মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা জানানো হয়।    

 

No comments

Powered by Blogger.