বিশ্বের কোথায় কোথায় ভাসমান বাজার রয়েছে জানেন? বাংলাদেশের ভাসমান পেয়ারা বাজারের নানা কথা
সভ্যতার আঁতুরঘর হল নদী।জল জীবনের সঙ্গে মানুষের জীবন-যাপনের সম্পর্ক বহুপ্রাচীন। নদীকে কেন্দ্র করে জীবিকা নির্বাহ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ। বর্তমান বিশ্বের অনেক দেশের অনেক জায়গা রয়েছে,সেখানে ক্রয়--বিক্রয় সমগ্র প্রক্রিয়ায়ই চলে ভাসমান বাজারে।বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কয়েকটি ভাসমান বাজার বেশ জনপ্রিয় ।এই ভাসমান বাজারের অমোঘ টানেই বহু পর্যটকেরা আসেন ভাসমান বাজার দেখতে। এই মুহূর্তে বিশ্বের কয়েকটি জনপ্রিয় ভাসমান বাজার হল--
- সাদুয়ক ফ্লোটিং মার্কেট, থাইল্যান্ডের রাতচাবুরিতে অবস্থিত
- লোক বেইনতান ভাসমান বাজার,
- ইন্দোনেশিয়ার বানজার, মাসিনতে অবস্থিত
- ডাল লেক ভাসমান বাজার, ভারতের শ্রীনগরে অবস্থিত।
- সোলোমন দ্বীপপুঞ্জের ভাসমান বাজার।
- ভিয়েতনামের জনপ্রিয় ভাসমান বাজার হল ডেল্টা।
- ইনলে লেক ভাসমান বাজার যা মায়নামারের নিয়াউংশওয়ে অবস্থিত।
- পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার পাটুলীতে ভাসমান বাজার বেশ জনপ্রিয়।
বাংলাদেশের ভাসমান পেয়ারা বাজারের নানা কথা
বরিশাল জেলা বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বরিশাল বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। এটি ১৭৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। কীর্তনখোলা নদীর তীরে অবস্থিত এই শহরের পূর্বতন নাম চন্দ্রদ্বীপ। দেশের খাদ্যশষ্য উৎপাদনের একটি মূল উৎস এই বৃহত্তর বরিশাল। একে বাংলার ‘ভেনিস’ বলা হয়। বরিশাল দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি নদীবন্দর। ছোট বেলায় শুনতাম--" যাইতে শাল, আইতে শাল তারই নাম বরিশাল "
শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের বরিশাল জীবনানন্দের স্মৃতিবিজড়িত স্থান। বরিশালের প্রতি এপার বাংলার বাঙালি একটা অমোঘ আকর্ষণ অনুভব করে।
বাংলাদেশের বরিশাল জেলা জুড়েই বেশ কয়েকটি ভাসমান বাজার আছে, তা জানা নেই এপার বাংলার বহু মানুষের। পিরোজপুরের ভাসমান পেয়ারা বাজার সেগুলোর মধ্যে একটি। পেয়ারার মৌসুমে এই ভাসমান বাজারে বেচাকেনা হয়। ভাসমান পেয়ারার বাজারটি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা পিরোজপুরের নেছারাবাদ উপজেলার অন্তর্গত স্বরূপকাঠির কীর্তিপাশা খালের উপর অবস্থিত। সাধারণত পেয়ারার মৌসুম শুরু হয় জুলাই মাসে, চলে টানা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। তাই পাইকারি বাজারের দেখা পেতে হলে সেখানে যেতে হবে জুলাইয়ের শেষ দিকের সময়টাতে।
ভাসমান পেয়ারা বাজার বসে নদী-নালার দেশ বরিশাল এর দক্ষিণাঞ্চলের জেলা ঝালকাঠী ও স্বরূপকাঠীর বিভিন্ন জায়গায়। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো ভিমরুলি,আটঘর ও কুড়িয়ানা বাজার। অনেকে এই ভাসমান বাজার সমূহকে থাইল্যান্ড এর ফ্লোটিং মার্কেট এর সাথে তুলনা করে থাকেন। প্রতিদিন কয়েক হাজার মন পেয়ারা বেচাকেনা হয় এই অঞ্চলে। দূর দুরান্ত থেকে নদিপথে পাইকাররা এসে এখানে পেয়ারা কেনেন। এই এলাকায় রয়েছে অসংখ্য পেয়ারার বাগান। চাষিরা সরাসরি বাগান থেকে পেয়ারা পেড়ে বিভিন্ন অঞ্চলের পাইকারদের কাছে বিক্রি করে। প্রতি বছরের জুলাই,আগষ্ট এর এই মৌসুমে কয়েকশ কোটি টাকার পেয়ারা উৎপাদন ও কেনাবেচা হয়। ভিমরুলি হাট খালের একটি মোহনায় বসে। তিনদিক থেকেই এই খালটি খোলা আর প্রশস্ত। ভিমরুলি গ্রামের আশেপাশে রয়েছে অসংখ্য পেয়ারা বাগান। পেয়ারার মৌসুম শেষ হলে আসে আমড়ার মরসুম। এ অঞ্চলে আমড়ার ফলনও সর্বত্র। আর সবশেষে আসে সুপারি। একটু কম হলেও বছরের অন্যান্য সময়ও ব্যস্ত থাকে এই হাট। ফল ছাড়াও এখানের প্রধান পণ্য বিভিন্ন রকম সবজি। একটি ভাসমান বাজার ভ্রমনের জন্য এখন অনেক পর্যটক- ই ছুটে বেড়ান ভিমরুলি ঘুরতে।বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল পেয়ারার জন্য বিখ্যাত, যা বাংলাদেশে “বাংলার আপেল” নামে পরিচিত। বিশেষ করে ঝালকাঠি সদর উপজেলা এবং পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি ও বানারীপাড়া উপজেলায় কৃষকরা পেয়ারা চাষের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। জীবনের এমন বৈচিত্র্য দেশের অন্য জায়গায় পাওয়া কঠিন।
বাংলাদেশের বরিশাল,ঝালকাঠি, পিরোজপুরের সীমান্তবর্তী এলাকার ২৬ গ্রামের প্রায় ৩১ হাজার একর জমির উপর গড়ে ওঠা পেয়ারা বাগান ও প্রাকৃতিক নৈসর্গে ভরপুর ভাসমান পেয়ারা পার্ক.....পেয়ারা বিক্রির জন্য এখানে গড়ে উঠেছে পর্যটন ক্রেন্দ্র এবং পেয়ারা বাজার। ২০০০০ হাজার মানুষ এই পেয়ারার বাজারের সঙ্গে যুক্ত। এলাকার অর্থনৈতিক মান বেশ নজর কাড়ে।গ্রামীণ অর্থনীতিকে মজবুত করার কাজ করে চলেছে এই ভাসমান পেয়ারার বাজার। এই এলাকায় পেয়ারা বিক্রির জন্য বিখ্যাত ভীমরুলি ভাসমান পেয়ারা মার্কেট।ভীমরুলি গ্রামের আঁকাবাঁকা নদী জুড়ে সপ্তাহের প্রতিদিনই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে বেচা--কেনা।
ভীমরুলি হাট নদীর একটি মোহনায় বসে। তিন দিক থেকে তিনটি খাল এসে মিশেছে এখানে। ভীমরুলির আশপাশের সব গ্রামেই অসংখ্য পেয়ারা বাগান। এসব গ্রামে দৃষ্টিপথে ধরা দেবে সবুজের সমারহ। এসব সবুজের বেশিরভাগ হোগলা, সুপারি, আমড়া আর পেয়ারার বন। এসব বাগান থেকে চাষীরা নৌকায় করে সরাসরি এই বাজারে নিয়ে আসেন। এখানে প্রতিদিন পেয়ারা বোঝাই শত শত নৌকা নিয়ে বিক্রেতারা খুঁজে বেড়ায় ক্রেতা। আর ক্রেতাদের বেশিরভাগই হল পাইকার। বড় ইঞ্জিন নৌকা নিয়ে তারা বাজারে আসেন। ছোট ছোট নৌকা থেকে পেয়ারা কিনে তার ঢাকা শহরে বিক্রি করেন। আকর্ষণীয় দিক হল, ভাসমান বাজারের উত্তর প্রান্তে খালের উপরের থাকা ছোট একটি সেতু। সেখান থেকে বাজারটি খুব ভালো করে দেখা যায়। এখানে আসা সব নৌকাগুলোর আকার আর ডিজাইন প্রায় একই রকম। মনে হবে যেন, একই কারিগরের তৈরি সব নৌকা।
পেয়ারা বাজারে যাওয়ার জন্য দুই দিন সময় হাতে থাকা প্রয়োজন। ঢাকা সদরঘাট থেকে রাতের লঞ্চে যাত্রা হবে সবচেয়ে আরামের। সেজন্য প্রথমে সদরঘাট থেকে উঠতে হবে বরিশালগামী লঞ্চে।এছাড়াও খুলনা শহর থেকে সড়ক পথে বরিশালের পিরোজপুরের ভাসমান পেয়ারার বাজার দেখা অত্যন্ত সহজ।লঞ্চ থেকে নামার পর সিএনজি বা অটোতে করে যেতে হবে বানারীপাড়া লঞ্চ ঘাটে। সেখান থেকে ট্রলার বা নৌকা ভাড়া করে পৌঁছাতে হবে ভিমরুলি নামক স্থানে।'তবে বর্তমানে পদ্মা সেতুর কল্যাণে দুই দিনের যাত্রা শেষ করা যাবে একদিনেই, যা কিছুদিন আগেও প্রতিকূল আবহাওয়া ও নদী পারাপারের বিপদশঙ্কা আর সময়সাপেক্ষতা এত দ্রুত ফেরি পারাপারকে করে তুলেছিল অচিন্ত্যনীয়। এখন মাত্র ৬ থেকে ৮ ঘণ্টার বাস যাত্রায় যাওয়া যাবে পিরোজপুরে। অর্থাৎ, খুব ভোরে খুলনা শহর থেকে যাত্রা করলে দুপুরের মধ্যেই দেখা যাবে বাজারের জমজমাট পরিবেশ। সারাদিন বাজার ঘুরে আবার রাতেই ফিরে আসা যাবে চিরচেনা রাজধানীত ঢাকাতে অথবা খুলনাতে।
বরিশালের মনোমুগ্ধকর ভাসমান বাজার গুলো এক কথায় অনিন্দ্যসুন্দর । জুলাই মাস থেকে পিরোজপুর, বরিশাল ও ঝালকাঠি জেলার পেয়ারা চাষিরা শত শত ছোট-বড় নৌকা নিয়ে হাজির হয় ভাসমান বাজারে। বাগানের সেরা পেয়ারাগুলো দিয়ে ভর্তি থাকে প্রতিটি নৌকা।পেয়ারা বাজার ভ্রমণের শুরুটা করা যেতে পারে সেখানকার পাশের বাগানগুলো থেকে, যেখানে পর্যটকদের জন্য রাখা হয়েছে আপ্যায়ন ব্যবস্থা।
ভিমরুলিতে পৌঁছানোর পর ভাসমান বাজারের দৃশ্যটিই সবচেয়ে বেশি নজর কাড়ে। আঁকাবাঁকা নদী, পেয়ারা ভর্তি নৌকা, খালের দু'ধারের সবুজাভ পরিবেশ সবকিছু একত্রে স্বর্গীয় অনুভূতি দেয়। বছরের আর্দ্র সময়টাতেও চিত্রটি ব্যতিক্রম নয়।কীর্তিপাশা খাল দিয়ে ভাসমান বাজারে প্রবেশের অনুভূতি প্রকাশ করে বরিশালের বাংলাদেশের বন্ধু শুভ হালদারবলেন, 'খাল থেকে ভাসমান বাজারের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য, দুই পাশের সারি সারি গাছ এত মনোমুগ্ধকর রাস্তা সৃষ্টি করেছে যে মনে হয় আমাজন বনে আছি! এই দৃশ্য চর্মচক্ষু দিয়ে দেখতে হলে একটি ছোট নৌকা করে যাওয়া যেতে পারে খালের ভেতরের দিকে। তাহলে ধীরপথে যেতে যেতে উপভোগ করা যাবে বাজারের ব্যস্তময় নির্মল পরিবেশ।'
পিরোজপুরের উত্তরে বরিশাল জেলা ও গোপালগঞ্জ জেলা, দক্ষিণে বরগুনা জেলা, পূর্বে ঝালকাঠি জেলা ও বরগুনা জেলা এবং পশ্চিমে বাগেরহাট জেলা ও সুন্দরবন। পশ্চিমে বলেশ্বর নদী পিরোজপুরকে বাগেরহাটের থেকে আলাদা করেছে। পিরোজপুর জেলা ৭টি উপজেলা, ৭টি থানা, ৪টি পৌরসভা, ৫৪টি ইউনিয়ন ও ৩টি সংসদীয় আসন নিয়ে গঠিত।
দুপুরে খাওয়ার জন্য বাজারের পাশে একটি রেস্টুরেন্টে খেলাম। এছাড়াও কয়েকটি রেস্টুরেন্ট আছে। আর বাজারের কাছে বিশ্রামের জন্য পিরোজপুরে রয়েছে বোর্ডিং হাউজ। তবে চাইলে বরিশালে হোটেলে থেকে পরে পিরোজপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা যাবে। খুলনার বন্ধু অমিত হালদার জানাল,বিগত কয়েক বছরে স্বরূপকাঠির ভিমরুলি গ্রামে পর্যটকদের আনাগোনা বেড়েই চলেছে।এপার বাংলার যারা বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে থাকা অসাধারণ স্থানগুলো ঘুরে দেখতে চায় তাদের জন্য এই ভাসমান বাজার একটি আদর্শ জায়গা। আপনিও যদি কোনো অনিন্দ্য সুন্দর স্থানের দেখা পেতে চান তাহলে ঘুরে আসতে পারেন ভিমরুলি ভাসমান বাজার!
পথনির্দেশ : লঞ্চ যাত্রার জন্য, ঢাকা সদরঘাট থেকে রাত ৮টার সময় বেশ কয়েকটি লঞ্চ আছে। লঞ্চে গেলে বিকাল ৩ টার মধ্যেই পৌঁছানো যাবে বরিশালে। কলকাতা থেকে বন্ধন এক্সপ্রেসে খুলনা।খুলনা শহর থেকে পিরোজপুর।পিরোজপুর থেকে ভাসমান পেয়ারার বাজার।
আর বাস যাত্রার জন্য, গাবতলী বাসস্ট্যান্ড অথবা অনলাইন থেকে টিকেট সংগ্রহ করে টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেস, এমাদ পরিবহন বাসে যাওয়া যাবে পিরোজপুরে। খুলনা থেকে বাগেরহাট হয়ে বাসে পিরোজপুরের বাসস্ট্যান্ড। ওখান থেকে ভাসমান পেয়ারার বাজারের দূরত্ব মাত্র ৫০ কিলোমিটার।
No comments