শেখ হাসিনা একাই কি শেষ ভরসা
প্রতিবার জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশ জটিল রাজনৈতিক সংকটে পড়ে। এবারও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অবস্থার পুনরাবৃত্তি ঘটতে যাচ্ছে। বিএনপি এবং যুগপৎ আন্দোলনকারী কিছু রাজনৈতিক দল নির্বাচন বয়কট করেছে। লাগাতার অবরোধ ও হরতালের ডাক দিচ্ছে। কিছু বাস ও অন্য যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে। তবে হরতাল বা অবরোধের তেমন কোনো প্রভাব জনজীবনে পড়ছে না। দূরপাল্লার বাস-ট্রাক চলাচল করছে না। এর বাইরে সবকিছু স্বাভাবিক রয়েছে। নির্বাচনের আমেজ ও উত্তেজনা সেভাবে সৃষ্টি করা সম্ভব হচ্ছে না। মূলতই বর্জনকারীদের অগ্নিসংযোগ, পেট্রলবোমা, ককটেল ইত্যাদিতে জনজীবনে কিছুটা ছেদ পড়ছে।
এবারও নির্বাচনে অতীতের পুনরাবৃত্তি ঘটতে যাচ্ছে, সেই আশঙ্কা রাজনীতিসচেতন মহলে আগে থেকেই ছিল। কারণ যুগপৎ আন্দোলনকারীদের প্রধান দাবি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে। অথচ নির্বাচনের প্রধান শর্ত হওয়া উচিত ভোটাররা যেন নির্বিঘ্নে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে—সেই পরিবেশ নিশ্চিত করা। সেই দাবি বাদ দিয়ে যখন সরকারপ্রধানকে পদত্যাগ করতে হবে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পুনরুজ্জীবন ঘটাতে হবে, নির্বাচন কমিশন বাতিল করে নতুনভাবে গঠন করতে হবে—এমন সব দাবি উত্থাপিত হতে থাকে, তখন সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিষয়গুলো চাপা পড়ে যায়। তা ছাড়া আন্দোলনকারীদের দাবি পূরণ করতে হলে সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে। সংবিধানে সাংঘর্ষিক কোনো ধারা অন্তর্ভুক্ত করা যায় না, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক বলে উচ্চ আদালতে রায় দেওয়া আছে। সুতরাং আবার সংবিধানে সেটিকে ফিরিয়ে আনা যায় না। বিরোধীদের তাতে যদি আপত্তি থাকে, তাহলে তারা উচ্চ আদালতের কাছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে মতামত জানতে চাইতে পারত। কিন্তু তারা তা করেনি। এর পরও যুগপৎ আন্দোলনকারীরা দাবিগুলো নিয়ে অনড় ছিল। ২৮ অক্টোবর সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা থেকেই মহাসমাবেশের নামে ‘মহাযাত্রার’ আয়োজন করা হয়েছিল। সেটি ব্যর্থ হওয়ার পর থেকেই হরতাল, অবরোধ, নির্বাচন বর্জন, অগ্নিসংযোগ এবং ভীতিকর অবস্থা তৈরির চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
নির্বাচন কমিশন এরই মধ্যে তফসিল ঘোষণা করেছে। ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। যুগপৎ আন্দোলনকারীরা নির্বাচন বর্জনের পাশাপাশি নির্বাচনকে প্রতিহত করারও হুমকি দিয়েছে। ফলে ২০১৩-১৪-এর মতো না হলেও শঙ্কামুক্ত নির্বাচনী পরিবেশ বাধাপ্রাপ্ত হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ গণতন্ত্রের ইতিহাসে আবারও একটি সন্ধিক্ষণে পড়তে যাচ্ছে। এটি অনেকের কাম্য না হলেও দেশের পরস্পরবিরোধী মতাদর্শের যে রাজনীতি ১৯৭৫-এর পর থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে দাঁড়িয়ে গেছে, তার একটি বড় ধরনের অভিঘাত হিসেবেই অনিবার্যভাবে সংঘাত ঘটবে—এমনটি উপেক্ষা করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে অসাম্প্রদায়িকতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরোধ যত দিন অব্যাহত থাকবে, তত দিন আমরা ধ্রুপদি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রাজনীতি খুব একটা আশা করতে পারব না। ’৭৫-এর পর থেকে সাম্প্রদায়িকতাচ্ছন্ন রাজনীতি অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে এক বিন্দুও স্বাভাবিকভাবে রাজনীতি করতে দিতে চায়নি। সে কারণেই রাজনীতির বিরোধগুলো সাংঘর্ষিক এমনকি অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে সমূলে উৎপাটনেরও নজির বারবার ঘটতে দেখা গেছে। দুঃখজনক অভিজ্ঞতা হলো, আওয়ামী লীগ টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে দেশে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ব্যাপকভাবে ঘটাতে সক্ষম হলেও রাজনীতিতে অসাম্প্রদায়িকতার বিকাশ ঘটাতে ততটা মনোযোগ না দেওয়ার কারণেই দলীয় প্রধান শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুতি কিংবা হত্যার ষড়যন্ত্রের মুখে বারবার পড়তে হয়। জটিল এই রাজনৈতিক বাস্তবতা নিরসনে আওয়ামী লীগ এবং অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে সম্মিলিতভাবেই উদ্যোগ নিতে হবে, কাজ করতে হবে। নতুবা পদে পদে রাজনীতির এই পরস্পরবিরোধী সংঘাত, সংঘর্ষ ও দ্বন্দ্বের মুখে আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজকে আরও দীর্ঘকাল থাকতে হবে। এই বাস্তবতায় আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচন এবং পরবর্তী বাংলাদেশ বিনির্মাণের যাত্রাকে যদি বিবেচনায় আনা হয়, তাহলে এখন থেকেই জাতীয় ইতিহাসের পশ্চাৎপদ অনুষঙ্গগুলো অতিক্রম করার বিজ্ঞানসম্মত আরেকটি দিনবদলের সনদ গ্রহণ করতে হবে।
আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনা ৪২ বছর দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সরকারেও এনেছেন। আন্তর্জাতিকভাবেও তিনি এই মুহূর্তে বিশেষভাবে একজন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে পরিচিত। তাঁর নেতৃত্বেই বাংলাদেশ বদলে যাওয়া রাষ্ট্রের পরিচিতি পেয়েছে। পরিবর্তনগুলো ঘটেছে অর্থনীতি, দেশের অবকাঠামো ও সমাজজীবনের নানা শ্রেণি-পেশার অভূতপূর্ব উন্নয়নের মাধ্যমে। যে আওয়ামী লীগকে একসময় নেতৃত্বশূন্য করা হয়েছিল, রাজনীতি ও ক্ষমতায় আসার পথ রুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল, সেই আওয়ামী লীগকে তিনি রাষ্ট্রক্ষমতায় এনেছেন নানা অপশক্তির প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে। তাঁকে প্রতিনিয়ত দেশের অভ্যন্তরে লড়াই করতে হচ্ছে সেই সব শক্তির বিরুদ্ধে, যারা অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তিকে রাষ্ট্রীয় জীবনে দেখতে চায় না। বাংলাদেশের রাজনীতির বিরোধটা সেখানেই ঘুরপাক খাচ্ছে। সুতরাং, এই মুহূর্তে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার যে নীলনকশা প্রতিপক্ষ তৈরি করেছে, সেটি ভাঙতে হবে। সে কারণেই যুগপৎ আন্দোলনকারীরা এত দিন যে প্রচারটি করে এসেছে যে সংবিধান অনুযায়ী ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হতে পারে না, সেই অভিযোগও মিথ্যা প্রমাণ করতে হবে আগামী নির্বাচনকে সুন্দরভাবে সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে।
পৃথিবীর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো পারলে আমরা কেন পারব না—এই চ্যালেঞ্জ নিয়েই ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে ত্রুটিমুক্ত করার জন্য নির্বাচন কমিশন ও সব অংশীজন যেন একাকার হয়ে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে পারে, সেই ব্যবস্থাতেই সরকারকে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে হবে। এর জন্য দলকেও তৃণমূল পর্যন্ত যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে হবে। দলের নেতা-কর্মীদের প্রতি কেন্দ্রে ভোটার আনার দিকে বেশি মনোযোগী হওয়ার নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন। কেন্দ্রে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সামান্যতম সংশ্লিষ্টতাও যেন না থাকে। পোলিং এজেন্ট থেকে শুরু করে সবাই সুষ্ঠু নির্বাচনকে শিরোধার্য হিসেবে যেন প্রতিপালন করে থাকে। কোনো অবস্থাতেই অংশগ্রহণকারী প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্রার্থী বা নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলায় যেন না জড়ান। অন্য দলের প্রার্থী, নেতা-কর্মী, পোলিং এজেন্ট যেন অভিযোগ করতে না পারেন, সে ব্যাপারেও দল থেকে কড়া নির্দেশনা থাকা জরুরি।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি আওয়ামী লীগের জন্য এবার বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন রয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন, তা হচ্ছে প্রার্থী মনোনয়নে প্রতিটি আসনের বৈশিষ্ট্যকে বিবেচনায় নেওয়া। প্রার্থীকে অবশ্যই ব্যক্তিগত ভাবমূর্তিসম্পন্ন হতে হবে। অসাম্প্রদায়িক, জনকল্যাণকামী, দুর্নীতিমুক্ত ও দক্ষ রাজনৈতিক নেতা হিসেবে সুনাম রয়েছে—এমন প্রার্থীরাই যেন মনোনয়নপ্রাপ্তিতে প্রাধিকার পেয়ে থাকেন। সরকার গঠনের সুযোগ পেলে যেন একটি দক্ষ মন্ত্রিসভা গঠন করা যায়, সেদিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। আগামী দিনের দায়িত্ব পালনে সক্ষম ব্যক্তিদেরই বাছাই করতে হবে।
অতীতে অনেক সংসদ সদস্য ঢাকায় থাকাটাকেই তাঁদের নিয়মিতকরণ করেছিলেন। এলাকার সঙ্গে কালেভদ্রে যোগাযোগ রাখা কিংবা স্থানীয় পর্যায়ে নিজের কিছু ‘খয়েরখাঁ’ ব্যক্তিকে দায়িত্ব দিয়ে ঢাকায় নিজেরা অন্য কাজ কিংবা জীবন নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন। যাঁরা স্থানীয় পর্যায়ে দল ও জনবিচ্ছিন্ন হয়েছেন, যাঁদের আচার-আচরণ মানুষকে কাছে টানে না, সেই সব আবেদনকারীকে নিশ্চয়ই এবার বিবেচনায় নেওয়া হবে না। সবাই আশা করছেন শেখ হাসিনা আগামী মেয়াদে সরকার গঠন করতে পারলে দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, গণতন্ত্র, আইন, বিচার, সুশাসন ইত্যাদির উন্নয়ন ঘটাবেন কাঙ্ক্ষিত মানে। শেখ হাসিনাকে ছাড়া এই মুহূর্তে দ্বিতীয় কাউকে এই সব পরিবর্তনের জন্য ভাবাই যাচ্ছে না। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি এখন জরুরি হয়ে পড়েছে দুর্নীতিমুক্ত এবং শিক্ষা, গবেষণা, সংস্কৃতি আর অসাম্প্রদায়িকতার চর্চায় সমাজ ও রাষ্ট্রকে বিকশিত করা। এর জন্য শেখ হাসিনার হাত শক্তিশালী হতেই হবে। ৩০০ আসনে সে রকম প্রার্থীরাই মনোনয়ন পাবেন, যাঁরা আগামীর বাংলাদেশ গঠনে যোগ্যতার প্রমাণ দিতে সক্ষম।
দেশের অভ্যন্তরে দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, সুশাসনের ঘাটতি যেমন রয়েছে, একইভাবে শিক্ষা, সংস্কৃতিতে অনেক প্রয়োজনীয় কাজ পিছিয়ে গেছে। আমাদের খুব কাছেই চতুর্থ শিল্পবিপ্লব কড়া নাড়ছে। ১৭ কোটি মানুষকে তৈরি করতে হবে। আন্তর্জাতিকভাবেও আমরা নানা মেরুর ক্ষমতাবলয়ের চাপে রয়েছি। এই সবকিছু অতিক্রম করার কাজটি শুধু একা শেখ হাসিনা করবেন—এমনটি ভাবা উচিত নয়। দলকে সুসংগঠিত করার কোনো বিকল্প নেই। আগামী নির্বাচনই শেষ নয়। আওয়ামী লীগকে ভবিষ্যতের জন্যও প্রস্তুতি নিতে হবে। এবং তা এখনই নিতে হবে।
- মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী, অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট
চাইলে আপনিও হতে পারেন ঢাকা ভয়েজ পরিবারের অংশ। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা কিংবা মতামত বা সৃৃজনশীল লেখা পাঠিয়ে দিন আমাদের ঠিকানায়। নাম সহ প্রকাশ করতে চাইলে লেখার নিচে নিজের নাম, পরিচয়টাও উল্লেখ করে দিন। ঢাকা ভয়েজে প্রকাশিত হবে আপনার লেখা। মেইল : dhahkavoice.news24@gmail.com
No comments