অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তাও বাড়ছে
দেশে চলছে অর্থনৈতিক সংকট। এর মধ্যে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। হরতাল-অবরোধও শুরু হয়েছে। এতে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ আরো বাড়বে। হুহু করে বাড়ছে ভোগ্যপণ্যসহ যাবতীয় পণ্যের দাম। ব্যবসায়ীরা অজুহাত হিসেবে দেখাচ্ছেনে হরতাল-অবরোধকে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি দৃষ্টে মনে হচ্ছে, বাজার আরো জটিল আকার ধারণ করবে।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে এমনিতেই দেশের অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থা। ডলারের সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে, রিজার্ভ কমছে, নিত্যপণ্যের দামও অসহনীয় মাত্রায়। এমন অবস্থায় আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোর হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি দেশের অর্থনীতির জন্য অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। বিরোধী দলগুলো সড়ক, রেল ও নৌপথে তিন দিনের অবরোধের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।
রাজনীতির নামে অসহিষ্ণু কর্মসূচি চলতে থাকলে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে বাধ্য হবেন ব্যবসায়ীরা। এতে বেতন-ভাতা দেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হবে। মানুষের আয়-রোজগার কমে যাবে। যানবাহন চলাচল করতে না পারলে বাজারে নিত্যপণ্যের সরবরাহ কমে যাবে। জিনিসপত্রের দাম আরো বাড়বে। মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেবে। অর্থনীতিতে দেখা দেবে অনিশ্চয়তা। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। স্থিতিশীল পরিবেশ না থাকলে বিনিয়োগকারীরা নিজেদের নিরাপদ মনে করবেন না। বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করবেন না, যার ফলে নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি হবে না। ব্যবসা-বাণিজ্য ঠিকমতো না চললে প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মীদের ঠিকমতো বেতন-ভাতা দিতে পারবে না। ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মী ছাঁটাই করতে বাধ্য হবে। বেকারত্ব বাড়বে। রাজনীতি মূল্যবোধের ভিত্তিতে করতে হয়, সেটি যদি রাজনীতিবিদেরা করতে না পারেন, তাহলে আর কিছু করার থাকে না। জনগণ ও অর্থনীতিকে জিম্মি করে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার অধিকার কারো নেই। রাজনীতিবিদদের পরস্পরবিরোধী মনোভাবের খেসারত সাধারণ মানুষকে দিতে হয়। সংঘাত এড়িয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে এগিয়ে আসতে চায় না। চিন্তার বিষয় হলো, স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও আমরা একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক পরিবেশ অর্জন করতে পারলাম না।
হরতাল-অবরোধ মানুষের কষ্ট আরো বাড়াবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাজারে নিত্যপণ্যের দাম দীর্ঘদিন ধরেই বেশি। হরতাল-অবরোধে মানুষের কষ্ট আরো বাড়বে। বাজারে সরবরাহব্যবস্থা বিঘ্নিত হবে। অসাধু ব্যবসায়ীরা একে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করাবেন। এর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা প্রয়োজন। তাদের মধ্যে সমঝোতাই পারে এ ধরনের পরিস্থিতি এড়িয়ে যেতে। পরিস্থিতি যেন স্বাভাবিক থাকে, সেটা রাজনৈতিক দলগুলোকে নিশ্চিত করতে হবে।
বাজেটের আগে থেকেই দেশে নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীনভাবে বেড়ে চলেছে। এমন পরিস্থিতিতে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে আলু, পেঁয়াজ, চিনি, সয়াবিন তেল ও ডিমের দাম বেঁধে দেয় সরকার, যা এখনো কার্যকর হয়নি। বরং আরো কিছু পণ্যের দাম ৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। সরকারের বেঁধে দেওয়া দাম বাজারে এখনো কার্যকর না হওয়ার পেছনে সরবরাহের ঘাটতিই দায়ী। সরবরাহ যদি ঠিক থাকত, তাহলে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম কমে যেত। নিত্যপণ্যের দাম না কমার জন্য ভোক্তা অধিকার বা প্রতিযোগিতা কমিশন কেউই দায়ী নয়। সরবরাহ সন্তোষজনক হলেই সরকারের বেঁধে দেওয়া দাম কার্যকর করা যেত।
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায় এমনিতেই বায়াররা তাদের ক্রয়াদেশ কমিয়ে দিচ্ছে। হরতাল-অবরোধের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে সময়মতো পণ্য বন্দরে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে যেমন বাধা সৃষ্টি হবে, পাশাপাশি পণ্যের জাহাজীকরণ বাধাগ্রস্ত হবে। এতে রপ্তানির লিড টাইম বেড়ে যাবে। এই সুযোগে বায়াররা তাদের ক্রয়াদেশ আরো কমিয়ে দেবে, আগের দেওয়া ক্রয়াদেশ নিশ্চিত করতে দেরি করবে। রাজনৈতিক এসব কর্মসূচি কারো উপকার বয়ে আনে না—এটা সরকার, বিরোধী দলসহ সবাইকে অনুধাবন করতে হবে। দেশের স্বার্থে, অর্থনীতির স্বার্থে এসব কর্মসূচি ত্যাগ করতে হবে।
অর্থনৈতিক সংকট এড়াতে যে কোনো সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা খুবই জরুরি। এখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেভাবে অস্থিতিশীলতার দিকে যাচ্ছে, এতে নানাভাবে অর্থনীতিতে আঘাত আসবে। আমরা আমদানি ও রপ্তানি, অর্থাত্ বৈশ্বিক বাণিজ্যের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। আর আমদানি ও রপ্তানি পণ্য উত্পাদনস্থল থেকে বন্দরে বা বন্দর থেকে উত্পাদনস্থলে পরিবহনের মাধ্যমে আনা-নেওয়া করা হয়। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে এই ক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর ফলে উত্পাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সেটি হলে প্রভাব পড়বে কর্মসংস্থানের ওপর। নতুন কর্মসংস্থান হবে না, এতে কর্মসংস্থান আরো কমবে, যার প্রভাবে বেড়ে যেতে পারে বেকারের সংখ্যা। সব মিলে সার্বিক পরিস্থিতি অর্থনীতির জন্য সুখকর নয়, যা অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। সংকট সমাধানের পথ বের করতে হবে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হলে সামনের দিনগুলো কেমন যাবে, তা নিয়ে তৈরি হবে অনিশ্চয়তা। আর অনিশ্চয়তা থাকলে ব্যবসায়ীরা ভবিষ্যত্ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়বেন। ব্যবসায়ীরা মনে করেন আমার টাকা ফেরত আসবে কি না, পণ্য বাজারজাত হবে কি না, শিল্প চালাতে পারব কি না—এসব বিষয় নিয়ে তারা ভাবতে শুরু করবেন। আরো ভাববেন, বিনিয়োগ করলে কোনো ধরনের ঝুঁকিতে পড়তে পারেন।
এই অনিশ্চয়তা অভ্যন্তীরণ ব্যবসায়ীদের উদ্বেগের জায়গা তৈরি করবে। আর দ্বিতীয় হচ্ছে বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে। বিদেশিরা রাজনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ দেখলে বিনিয়োগ করবেন না। এমনিতে আমাদের বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কম আসছে। পরিস্থিতি খারাপের দিকে গেলে এখানে আরো চাপ পড়বে। এমনিতে আন্তর্জাতিক সংস্থা মুডির হিসাবে বাংলাদেশের ঋণমান কমেছে। বিভিন্ন কারণে এখনো অনিশ্চয়তা আছে দেশে। মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে আছে অনেক কিছু। যে কোনো সময় একটি বা দুটি খাতে আঘাত এলেই পণ্য আমদানি ও রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, বিদেশি বিনিয়োগ পরিস্থিতি ঠিক করতে হবে। তবে এখন দেশের অর্থনীতি বেশি চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে।
লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কো. লি.
চাইলে আপনিও হতে পারেন ঢাকা ভয়েজ পরিবারের অংশ। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা কিংবা মতামত বা সৃৃজনশীল লেখা পাঠিয়ে দিন আমাদের ঠিকানায়। নাম সহ প্রকাশ করতে চাইলে লেখার নিচে নিজের নাম, পরিচয়টাও উল্লেখ করে দিন। ঢাকা ভয়েজে প্রকাশিত হবে আপনার লেখা। মেইল : dhahkavoice.news24@gmail.com
No comments