ঔষধশিল্পের সম্ভাবনা ও করণীয়
ঔষধশিল্পের সম্ভাবনা ও করণীয়
বাংলাদেশের ঔষধশিল্পের বয়স প্রায় আট দশক। দেশে ১৯৮২ সালে ড্রাগ অর্ডিন্যান্স জারি হইবার পর প্রথম বারের মতো ঔষধ বা ফার্মাসিউটিক্যালসকে ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এখন ইহা একটি বিপুল সম্ভাবনাময় ও বিকাশমান শিল্প। গার্মেন্টস ও চামড়াশিল্পের মতো ঔষধশিল্পের সম্ভাবনাকেও আমাদের কাজে লাগানো উচিত। বর্তমানে বিশ্বে ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঔষধের বাজার রহিয়াছে। একবিংশ শতাব্দীতে আসিয়া বিশ্বে এ শিল্প ব্যাপক প্রসার ও অগ্রগতি লাভ করিতেছে। তাই ভারত ও চীনের পাশাপাশি বাংলাদেশও এ সুযোগ কাজে লাগাইয়া উন্নতির শিখরে উন্নীত হইতে পারে। ইহার জন্য প্রয়োজন ঔষধশিল্প খাতকে পর্যাপ্ত গুরুত্ব দিয়া বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতাগুলি দূর করা।
আশার খবর হইল, ঔষধশিল্পে বর্তমানে আমরা প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করিয়াছি। চাহিদার প্রায় ৯৮ শতাংশ ঔষধ এখন দেশেই উত্পাদিত হইতেছে। শুধু তাহাই নহে, ঔষধ রপ্তানিতেও আমরা ক্রমান্বয়ে সাফল্য অর্জন করিয়া চলিয়াছি। গত অর্থবত্সরে (২০২২-২৩) আমরা ঔষধ রপ্তানি করিয়া আয় করিয়াছি ২ হাজার ২২ কোটি টাকারও অধিক। বিশ্বে করোনা মহামারি ও যুদ্ধবিগ্রহ সত্ত্বেও এই শিল্পে আমাদের রপ্তানি বৃদ্ধি আশাব্যঞ্জক। বিশ্বের অন্তত ১৫৭টি দেশে আমাদের ঔষধ রপ্তানি করা হইতেছে। ইহার মধ্যে এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা, উত্তর আমেরিকা, আফ্রিকা, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন দেশ রহিয়াছে। সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ ও নীতি এই ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ হইয়াছে। বর্তমানে সারা দেশে ২৯৫টি অ্যালোপ্যাথিক ঔষধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান তৈরি করিতেছে প্রায় ৪৬ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকার ঔষধ ও ঔষধের কাঁচামাল। ইহা ছাড়া ২৮৪টি ইউনানি, ২০৫টি আয়ুর্বেদিক, ৭১টি হোমিওপ্যাথিক ও ৩১টি হার্বাল ঔষধ উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠান প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার ঔষধ উত্পাদন করিতেছে। বেক্সিমকো, স্কয়ার, ইনসেপ্টা, রেনাটা, একমি, অ্যারিস্টোফার্মা, এসকেএফ, জেনারেল, বিকন, অরিয়ন প্রভৃতি কোম্পানি ঔষধ উত্পাদন ও রপ্তানিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করিতেছে।
তবে ঔষধশিল্পকে আরো আগাইয়া লইতে ইহার প্রতিবন্ধকতাগুলি দূর করা জরুরি। এই শিল্পের প্রধান সমস্যা কাঁচামালের ঘাটতি। ঔষধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলির সংগঠন বাংলাদেশ ঔষধশিল্প সমিতির মতে, বাংলাদেশে যেই সকল ঔষধ তৈরি হইতেছে তাহার প্রায় ৮০ শতাংশ কাঁচামাল আমদানি করিতে হইতেছে। এই আমদানিনির্ভরতা কীভাবে কমানো যায় তাহা লইয়া বিস্তর চিন্তাভাবনা করিতে হইবে। নিজেরা যতদিন ঔষধের উপাদান এপিআই তথা অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যালস ইনগ্রেডিয়েন্টস তৈরি করিতে পারিব না, ততদিন প্রত্যাশামাফিক রপ্তানিও বাড়িবে না। ইহার পাশাপাশা রপ্তানিসংক্রান্ত প্রক্রিয়াগুলি আরো সহজতর করিতে হইবে। এই সংক্রান্ত পণ্যের ক্লিনিক্যাল গবেষণার জন্য আমাদের কোনো সংস্থা নাই। এই ক্ষেত্রে আমরা এখনো প্রতিবেশী ভারতের উপর নির্ভরশীল। ২০২৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হইলে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী তখন পেটেন্টকৃত ঔষধ উত্পাদনে ছাড়সুবিধা পাওয়া যাইবে না। এই সকল সীমাবদ্ধতার কথাও চিন্তা করিতে হইবে। সরকার এই শিল্পের উন্নয়নে একটি এপিআই পার্ক তৈরি করিয়াছে। এই পার্কে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে কারখানা স্থাপন করিয়াছে; কিন্তু গ্যাসের অভাবে কারখানাগুলি চালু করা যাইতেছে না। আবার বাংলাদেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক অনুমোদিত সরকারি মান যাচাইকারী ল্যাবরেটরিও নাই বলিয়া জানা যায়।
এখন উপরিউক্ত প্রতিবন্ধকতাগুলি মোকাবিলার প্রতি দৃষ্টিপাত করিলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের ঔষধের বাজার আরো বাড়িবে নিঃসন্দেহে। এই শিল্পকে উন্নতি সাধনে গবেষণার পরিধি আরো বাড়াইতে হইবে। কেননা যেই সকল দেশের গবেষণা যত উন্নত, সেই সকল দেশে শিল্পের প্রসার তত অধিক। বিশ্বের উন্নত দেশগুলি প্রতি বছর গড়ে ১৩৫ বিলিয়ন ডলার গবেষণা খাতে ব্যয় করিয়া থাকে। তাহা ছাড়া বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের ঔষধ রপ্তানির ক্ষেত্রে কিছু আইনি ও নীতিগত বাধা রহিয়াছে। রহিয়াছে দক্ষ মানবসম্পদের অভাব। এই সকল বাধাও দূর করিতে এখন সচেষ্ট হইতে হইবে।
No comments