Adsterra

নারী আন্দোলনের অবিচ্ছেদ্য নাম সুফিয়া কামাল

নারী আন্দোলনের অবিচ্ছেদ্য নাম সুফিয়া কামাল, অমানবিক, অগণতান্ত্রিক, অবৈজ্ঞানিক, ভাষা আন্দোলন, ছায়ানট, কবি, সাহিত্যিক, সমাজ সংস্কারক, ঢাকা ভয়েজ,  dhaka


বিংশ শতাব্দীতে যাঁরা আলোর পথ দেখিয়েছেন, কবি সুফিয়া কামাল তাঁদের মধ্যে অন্যতম। আমৃত্যু তিনি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অমানবিক, অগণতান্ত্রিক ও অবৈজ্ঞানিক প্রথা ভাঙ্গার আন্দোলন করে গেছেন। পাশাপাশি নিজের অনুসারীদের শিখিয়ে গেছেন যে, যুক্তিসংগত মানবিক দাবিতে সোচ্চার হয়ে তাতে অটল ও অনমনীয় থাকা প্রয়োজন।


সুফিয়া কামাল ১৯১১ সালের ২০শে জুন বরিশালের শায়েস্তাবাদের নবাব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। সে কালে পরিবারের ছেলেদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও, মেয়েদের জন্য ছিল না। তাই মায়ের কাছে বাংলা শেখার পর মামার বিশাল লাইব্রেরী হয়ে গেল তাঁর পাঠশালা। সেখানে বসেই তিনি নতুন সমাজ নির্মাণের পাঠ নেন। যেখানে নিজেই তিনি নিজের শিক্ষক ছিলেন। নিজেই পড়েন, শেখেন, আবার লেখেন। শৈশবে তাঁর ছিল এক আশ্চর্যরকমের লেখা লেখা খেলা। তাঁর বয়সী মেয়েরা যখন পুতুল বা হাড়ি পাতিল নিয়ে খেলছে, তিনি তখন খেলেন ছড়া লেখা, গদ্য-পদ্য লেখার খেলা। পরে সে কথা লেখেন ছোটদের কবিতায় 'আমাদের যুগে আমরা যখন খেলছি পুতুল খেলা, তোমরা এখন সেই বয়সে লেখা পড়া নিয়ে কর মেলা'।


সেই  পুতুল খেলার যুগে পুতুল না খেলে লেখাপড়া নিয়ে খেলতে খেলতে তিনি হয়ে গেলেন একজন সত্যিকারের লেখক। যিনি লেখার জন্য স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল ইসলামের আশীর্বাদে ধন্য হয়েছিলেন। কবিগুরুর মানবতাবাদী দর্শন এবং নজরুলের সাম্যবাদী আদর্শ তাঁর লেখায় প্রভাব ফেলে। একবার কলকাতায় বেড়াতে গিয়ে পরিচয় হয় নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার সঙ্গে। বুঝতে পারেন নারীকে মানুষ হতে হলে নিজের পায়েই দাঁড়াতে হবে। এই দাঁড়াতে পারাটাই গৌরবের ও মর্যাদার। 

সুফিয়া কামালের মা ছিলেন তাঁর সকল কাজের প্রেরণা। একদিন শিশু কন্যাসহ মাকে নিয়ে কলকাতায় পাড়ি দেন। জীবিকার জন্য চাকরি নিলেন কলকাতা কর্পোরেশনের এক স্কুলে। জীবনের এই পর্যায়ে আসতে তাঁকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। তাঁর চাকরির বিষয়ে শায়েস্তাবাদের নবাব মামার প্রবল আপত্তি ছিল। কিন্তু অভিজাত মামার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই তিনি কলকাতার অনিশ্চিত জীবনকে বরণ করে নেন।


জীবনের এক পর্যায়ে সুফিয়া কামাল মাতৃমঙ্গল ও শিশুমঙ্গল কর্মসূচীতে এবং স্বদেশী নেতাদের সঙ্গে চরকায় সূতা কাটার কাজে যুক্ত হন। কলকাতায় বেগম রোকেয়ার গড়া আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলামের সদস্য হয়ে বস্তিতে ঘুরে ঘুরে মানুষের জন্য কাজ করেন। তিনি বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র ও শিশু শিক্ষা কেন্দ্র পরিচালনা করেন। যুক্ত ছিলেন অল ইন্ডিয়া উইমেনস এসোসিয়েশনের সঙ্গে। পাশাপাশি নারীদের ভোটাধিকার, স্বাধীনতা ও স্বদেশী আন্দোলনের জন্য কাজ করে যান তিনি।


দেশভাগের পর ঢাকায় এসে সে সময়কার কবি, সাহিত্যিক, সমাজ সংস্কারক ও প্রগতিশীল রাজনীতিবিদদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলেন সুফিয়া কামাল। তবে নিজেকে  রাজনীতির সঙ্গে না জড়িয়ে গভীর দেশপ্রেম থেকে কাজ করে যেতে থাকেন। ভাষা আন্দোলন, ছায়ানট প্রতিষ্ঠা, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে যুক্ত হয়ে তিনি সকল প্রগতিশীল আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেন।


১৯৭০ সালে নারী–পুরুষের সমতাভিত্তিক সমাজ রাষ্ট্র বিনির্মাণের লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন মহিলা পরিষদ। স্বাধীন বাংলাদেশে দেখেন পাক হানাদার ও তাদের দোসরদের দ্বারা লাঞ্ছিত নারীদের পরিবারও গ্রহণ করছে না। যুদ্ধে আহত পুরুষেরা পাচ্ছেন বীরের মর্যাদা, আর তারই বিপরীতে নারীরা পাচ্ছেন ঘৃণা। ঠাঁই পাচ্ছেন না নিজ পরিবারে। এই সকরুণ চিত্র ও মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা থেকে তিনি মহিলা পরিষদে নারীর পুনর্বাসন কর্মসূচী হাতে নেন। এই কর্মসূচী পালনকালে দেখেন অপরাধীরা প্রচলিত আইনের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। তখন আইন সংস্কার আন্দোলনের প্রয়োজন দেখা দেয়। ১৯৭২ সালে জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের বিধান রাখা হলে, সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ বঙ্গবন্ধুর সরকারের কাছে আসন সংখ্যা বৃদ্ধি ও সরাসরি নির্বাচনের দাবি জানায়।


সুফিয়া কামাল নিজে অনেক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আবার অনেক সংগঠনের প্রধান ব্যক্তিও ছিলেন তিনি। কিন্তু তার মধ্যে মহিলা পরিষদ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকের। কারণ এ সংগঠনটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী একটি নারী সংগঠন। এই সংগঠনের মাধ্যমে তিনি পৃথিবীব্যাপী নারীর প্রতি বৈষম্যের মূলোৎপাটনে করে মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শক্তিশালী নারী আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বেই সারা দেশে নারী আন্দোলন বিকশিত হয়। সেই মহিলা পরিষদের ধ্বজা আমৃত্যু বহন করে গেছেন অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও মানবিক চেতনার ধারক সুফিয়া কামাল। তাই নারী আন্দোলনের এক অবিচ্ছেদ্য নাম সুফিয়া কামাল। এই মহীয়সী নারী ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর মারা যান।  


No comments

Powered by Blogger.