Adsterra

রাশিয়া কি ইসরাইল ও ইউক্রেন যুদ্ধ পর্যবেক্ষণ করছে?

 


রাশিয়া যাকে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ হিসেবে ধরে নিয়ে ইউক্রেনে হামলা করে বসে, বিশ্বব্যাপী ক্ষমতার ভারসাম্যের (ব্যালেন্স অব পাওয়ার) ওপর শুরু থেকেই তার একটা গভীর প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর অন্যান্য অঞ্চলেও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়তে দেখে আসছি আমরা। আন্তর্জাতিক অগ্রাধিকারগুলোও হাঁটছে ভিন্ন পথ ধরে। সর্বশেষ হামাস-ইসরাইল সংঘাতের সূত্র ধরে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার উত্তেজনার উত্তাপ আছড়ে পড়ছে এই অঞ্চলের ভৌগোলিক সীমানার বাইরে, বহু দূর অবধি।


ইসরাইলে ‘আল-আকসা ফ্লাড’ নামে হামাসের হামলার পর যুদ্ধকবলিত ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন তেল আবিবের প্রতি। বস্তুত, এর মধ্য দিয়ে তিনি নিশ্চিত করতে চেয়েছেন ‘আত্মরক্ষার অধিকার’। ইসরাইলের প্রতি ইউক্রেনের সমর্থন জানানোর ঘটনা অবাক করেছে অনেককেই। বিষয়টা আশ্চর্যজনক এ কারণে, যুদ্ধরত কিয়েভকে ড্রোন বা ক্ষেপণাস্ত্র দিতে অস্বীকার করে আসছিল ইসরাইল। যেই জেলেনস্কিকে আয়রন ডোম সিস্টেম সরবরাহে ‘না’ বলেছিলেন বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু, খোদ তাকেই জেলেনেস্কির সমর্থন করে বসাটা অবাক করার মতোই ঘটনা বইকি। তাছাড়া মস্কোর বিরুদ্ধে আরোপিত পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাকেও খুব একটা পাত্তা দেয়নি তেল আবিব।


ইসরাইলের প্রতি জেলেনস্কির সমর্থন জানানোর বড় কারণ হলো, গাজায় উত্তেজনা বাড়লে একধরনের অনিশ্চিত পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে কিয়েভকে। বিশেষ করে ইসরাইল যদি কোনোভাবে বড় ধরনের স্থল সামরিক অভিযান শুরু করে, সেক্ষেত্রে ওয়াশিংটন তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে স্বভাবতই। এর ফলে কিয়েভের প্রতি পশ্চিমা সমর্থন আরো দুর্বল হয়ে উঠবে। অর্থাত্, ইউক্রেন-সংকট থেকে আন্তর্জাতিক মনোযোগ যেন সরে না যায়, সেজন্যই ইসরাইলের পক্ষে কথা বলতে একপ্রকার বাধ্য হয়েছেন জেলেনস্কি। মধ্যপ্রাচ্য সংকট থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে কীভাবে সরিয়ে রাখা যায়, সেই চিন্তাও ছিল ইউক্রেন প্রেসিডেন্টের মাথার মধ্যে।


সন্দেহ নেই, দুই ফ্রন্টের সংঘাত সামলাতে ওয়াশিংটন বর্তমানে বেশ ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। দুই ফ্রন্টের মধ্যে কাকে বেশি সময়-সুযোগ দেওয়া হবে, তার হিসাব নিয়েও ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে স্টেট ডিপার্টমেন্টকে। ইউক্রেন নাকি ইসরাইল—কাকে বেশি সমর্থন দিলে রাশিয়াকে চাপে রাখা যাবে বেশি করে, সে বিষয় মাথায় রেখেই কৌশল সাজাচ্ছে মার্কিন মিত্ররা। তবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, ইসরাইলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র যত বেশি মনোযোগী হয়ে পড়বে, তত বেশি লাভ হবে মস্কোর। ইসরাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে সামরিক, রাজনৈতিক, মিডিয়া, কূটনীতি—সব ক্ষেত্রে কিয়েভ গুরুত্ব হারাবে, যা বড় ধরনের সুবিধা এনে দেবে মস্কোর জন্য। 


ঘটনা আছে আরেক জায়গায়। ইউক্রেন যুদ্ধ বা হামাস-ইসরাইল সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হলে তা বিশেষ সুবিধা এনে দেবে বেইজিংকেও। চীনের কাজ সহজ হয়ে উঠবে। তাইওয়ান ঘিরে যদি তলে তলে কোনো সামরিক দৃশ্যকল্প বাস্তবায়নের অভিলাষ পোষণ করে থাকে চীন, তবে সেই পথে অগ্র্রসর হওয়ার যুক্তি খুঁজে পাবেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। এই দাবির পক্ষে বহু কথা বলা যায়। মাত্র একটা যুক্তি দিলেই বিষয়টা পরিষ্কার হবে :শুধু ওয়াশিংটন কেন, একই সময়ে একাধিক ফ্রন্টে যুদ্ধ সামলানো যে কোনো শক্তির জন্যই কঠিন। একসঙ্গে একাধিক যুদ্ধের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা অত সোজা নয়।


মনে রাখতে হবে, রাশিয়ার প্রাথমিক লক্ষ্য হলো পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থাকে ক্রমশ দুর্বল করে তোলা। আলোচনা আছে, এ কাজে পেছনে বসে মস্কোকে রসদ জোগাচ্ছে বেইজিং ও তেহরানের মতো মিত্র। এটা সম্ভবত কোনো সম্মিলিত প্রজেক্ট! এই প্রজেক্টের আসল উদ্দেশ্য এমন হতে পারে, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় আরব-ইসরাইল দ্বন্দ্বের অবসানের উদ্যোগ গ্রহণের পটভূমিতে সংঘাত-সংঘর্ষকে সেই পর্যায়ে নিয়ে দাঁড় করানো, যেখান থেকে বিশ্বের প্রধান সামরিক শক্তি হিসেবে ওয়াশিংটনের শক্তিমত্তার প্রকৃত ওজন সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া যাবে। একই সময়ে দুটি পৃথক যুদ্ধে দুই মিত্র ইসরাইল ও ইউক্রেনকে কীভাবে সমর্থন দিয়ে যাবে পশ্চিমা বিশ্ব, সে বিষয়ও পরিষ্কার হবে।


ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত স্বল্প ও মাঝারি মেয়াদে হলেও তা ইউক্রেন ফ্রন্টে সুবিধা বয়ে আনবে রাশিয়ার জন্য। দীর্ঘ মেয়াদে এটা রাশিয়ার স্বার্থের জন্য সামঞ্জস্যপূর্ণ না-ও হতে পারে, বিশেষ করে যদি ইরান এই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে মস্কোকে কোনো একটা পক্ষে অবস্থান নিতে হবে প্রকাশ্যে, যা আপাতত এড়াতে চাইছেন পুতিন। হামাস-ইসরাইল যুদ্ধ যদি আরো বেশি তীব্র হয়ে ওঠে, তাহলে সিরিয়ায় রাশিয়ার উপস্থিতির স্থিতিশীলতা বিবেচনায় ইরান-ইসরাইল সরাসরি সংঘর্ষ শুরু হতে সময় নেবে না এক মুহূর্তও! ঘটনা এতটুকুতেই থেমে থাকবে না। ইউক্রেনেও বাড়বে রুশ অভিযান, যা নিশ্চয় চাইবে না পশ্চিমা জোট।


আমরা লক্ষ করে আসছি, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই কিয়েভকে ধরাশায়ী করে যুদ্ধে জয় লাভ করা যাবে—এমন চিন্তা থেকেই মূলত ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের পথে পা বাড়ান পুতিন। তবে সফলতার মুখ দেখেনি পুতিনের সেই পরিকল্পনা। কোনো সন্দেহ নেই, ইউক্রেনের প্রতি পশ্চিমা বিশ্বের ব্যাপক সমর্থন এবং রুশ আক্রমণ প্রতিহত করার ক্ষেত্রে গোয়েন্দা সমন্বয় রুশ বাহিনীকে রুখে দিতে বড় ধরনের সুবিধা এনে দিয়েছে কিয়েভের জন্য। শুধু তাই নয়, পশ্চিমা অস্ত্রশস্ত্রের ওপর ভর করেই এখন পর্যন্ত যুদ্ধের ময়দানে টিকে আছে ইউক্রেন। এসবের পাশাপাশি মার্কিন তথা পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা কিয়েভকে জুগিয়েছে বাড়তি মনোবল। রাশিয়ার বিরুদ্ধে আমরা একা লড়ছি না, ইউক্রেনের এরূপ মনোভাব পোষণের পেছনেও একমাত্র শক্তি হচ্ছে পশ্চিমা শক্তি। কথা এখানেই শেষ নয়। যে মিথ্যা গোয়েন্দা তথ্য ও প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তড়িঘড়ি করে যুদ্ধের মাঠে নেমে পড়েন পুতিন, তাতেও সম্ভবত হাত ছিল কারো না কারো!


একটা বিষয়ে বিশেষভাবে দৃষ্টি দেওয়া জরুরি। রুশ বাহিনী ইউক্রেনের অবকাঠামো খাত ব্যাপকভাবে ধ্বংস করে দিতে সফল হয়েছে বটে, কিন্তু  ইউক্রেনের সরকারকে উত্খাত করার ব্যাপারে পুতিনের তরফ থেকে সে ধরনের প্রচেষ্টা প্রত্যক্ষ করা যায়নি। এ কথা সত্য, রাশিয়াকে কোণঠাসা করে রাখার পেছনে ইউক্রেনের আসল উদ্দেশ্য হলো মস্কোকে একেবারে ক্লান্ত করে ফেলা। সামরিক ও বৈষয়িক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি পুতিনকে রাজনৈতিকভাবে একঘরে করে রাখা। তবে এ কাজে সহায়তা করতে কিয়েভ তথা পশ্চিমাদের যে ঘাম ছুটে যাচ্ছে, এমন কথা বলতেই হয়।


ইউক্রেনের মতোই বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে যুদ্ধের ময়দান আঁকড়ে পড়ে আছে পুতিন বাহিনীও। রুশ প্রেসিডেন্টও হাঁটছেন বিশেষ কৌশল ধরে। ইউক্রেনের প্রতি পশ্চিমা সমর্থন তলানিতে নামার অপেক্ষা করছেন তিনি। পুতিন সম্ভবত কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে টার্গেটে রেখে এগোচ্ছেন। অর্থনৈতিক সংকট, বিশ্বব্যাপী খাদ্যসংকটের ক্রমাগত বৃদ্ধি এবং ইউরোপীয়দের মধ্যে কূটনৈতিক বিভাজন—ইউক্রেনকে একেবারে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে ফেলতে এসবের দিকেই তাকিয়ে আছেন পুতিন। সংকট যত বাড়বে, ইউক্রেন তথা পশ্চিমা পক্ষের অবস্থা তত প্রকটতর হতে থাকবে বলেই পুতিনের ধারণা। এ ধরনের কৌশল অবশ্য কাজেও দেয় বেশ!


অর্থাত্, ইউক্রেন যুদ্ধের বর্তমান বাস্তবতা হলো, একে অপরকে নিঃশেষ করে দেওয়ার জন্য উভয় পক্ষই বাজি ধরছে ‘সঠিক সময়ের ওপর’। তবে অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, কোনো পক্ষই কামিয়াব হবে না। বরং, চলমান ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেই দানা বাঁধবে নতুন যুদ্ধ, মাথাচাড়া দেবে নতুন নতুন সংঘাত।


ওপরের বাস্তবতার আলোকে বিশ্লেষকেরা বলছেন, ‘নতুন বিশ্বব্যবস্থা (নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার)’ গড়ে উঠবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে। সেক্ষেত্রে ভূরাজনীতির হিসাবেও ঘটবে আমূল পরিবর্তন। রাশিয়া ও পশ্চিমা জোটের মধ্যকার চলমান বিবাদ-দ্বন্দ্বের ফলাফল যাই হোক না কেন, পশ্চিমা পক্ষ যে বেশ চাপের সম্মুখীন, তা এক প্রকার নিশ্চিত। আজকের দিনের হিসাব হলো, ইউক্রেনই মার্কিন তথা পশ্চিমা শক্তির একমাত্র ফ্রন্ট নয়, বরং অনেকগুলো ফন্টের মধ্যে একটা। সুতরাং, প্রশ্ন তোলা যায়, নতুন যে বিশ্বব্যবস্থা দেখব আমরা, সেখানে কি সত্যিকার অর্থেই নতুন কিছু পরিলক্ষিত হবে? নাকি বিশ্ববাসীকে নিষ্ক্রিয় সাক্ষীর কাতারে দাঁড় করিয়ে রেখে একেকটা রাষ্ট্র পরিণত হতে থাকবে বিকলাঙ্গ ভূখণ্ডে?



চাইলে আপনিও হতে পারেন ঢাকা ভয়েজ পরিবারের অংশ। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা কিংবা মতামত বা সৃৃজনশীল লেখা পাঠিয়ে দিন আমাদের ঠিকানায়। নাম সহ প্রকাশ করতে চাইলে লেখার নিচে নিজের নাম, পরিচয়টাও উল্লেখ করে দিন। ঢাকা ভয়েজে প্রকাশিত হবে আপনার লেখা। মেইল : dhahkavoice.news24@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.