মহাত্মা গান্ধী, ভারতের জাতির পিতা
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী! ভারতের জাতির পিতা। যিনি সকলের কাছে মহাত্মা গান্ধী নামেই সমধিক পরিচিত। মহাত্মা শব্দের মানে হল মহান যে আত্মা। তার অসামান্য অবদানের জন্য তাকে মহাত্মা উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তিনি সত্যাগ্রহ আন্দোলনের জন্য জনসাধারণের অতি নিকটে চলে আসেন এবং জনপ্রিয়তা লাভ করেন। সমগ্র বিশ্বে যে সকল জাতি নিজেদের উপর সকল শোষণের অবসান ঘটিয়ে স্বীয় অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে তাদের সকলেরই এক বা একাধিক অগ্রদূতের সুনিপুণ নেতৃত্বের দ্বারা তা অর্জন করেছে।
তেমনি ভারতীয় জাতিও যে আলোকবর্তিকার সাহায্যে ব্রিটিশ শাসন শোষণের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে তিনি হলেন মহাত্মা গান্ধী। মহাত্মা গান্ধী উচ্চবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ ও উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা সত্ত্বেও তার জীবনের সকল আভিজাত্য ও বিলাসিতা পরিত্যাগ করে সাধারণ জনসাধারণের কাতারে নেমে আসেন। শুধু সাধারণের কাতারে এসেই ক্ষান্ত ছিলেন না বরং জনসাধারণের অধিকার আদায়ে সর্বদা সোচ্চার থেকেছেন। সর্বোপরি তিনি ভারতের জনসাধারণের অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ ভারতীয় জাতিকে স্বাধীনতার পথে দাবিত করেছিলেন।
ভারতীয় জাতিকে সত্যাগ্রহ ও স্বদেশী আন্দোলনের প্রতি উদ্বুদ্ধ করার জন্য তিনি নিরলস পরিশ্রম করেছেন। তার পরিবর্তেই ভারতের স্বাধীনতা সূচিত হয়েছিল। তাই ভারত তথা ভারতীয় উপমহাদেশের জনগণ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তাঁকে মনে রাখবে। তাই তাঁর শৈশব, কৈশোর, যৌবন ও মৃত্যু পর্যন্ত বিষয়াবলী সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করার চেষ্টা করা হয়েছে। **মহাত্মা গান্ধীর পরিচয় ও প্রাথমিক জীবন ভারতের স্বাধীনতার অগ্রদূত, প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, সম্মোহনী রাজনীতির পুরোধা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী বা মহাত্মা গান্ধী ১৮৬৯ সালে পোরবন্দরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
তাঁর পিতার নাম ছিল করমচাঁদ গান্ধী। করমচাঁদ গান্ধী ছিলেন প্রবন্ধের দেওয়ান (প্রধান মন্ত্রী)। তার মায়ের নাম ছিল পুতলিবা। পুতলিবা ছিলেন করমচাঁদ গান্ধীর চতুর্থ স্ত্রী। মহাত্মা গান্ধী ছোটবেলা থেকেই ছিলেন অত্যন্ত মাতৃভক্ত একজন মানুষ। অপরদিকে তার মাতা ছিলেন একজন একনিষ্ঠ ধর্মানুরাগী। ফলে ছোটবেলা থকেই মহাত্মা গান্ধী জীবের প্রতি অহিংসা, নিরামিষ ভোজন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও আত্মশুদ্ধির জন্য উপবাস করাকে নিজের মধ্যে রপ্ত করতে শিখেন।
মাত্র ১৩ বছর বয়সে মা-বাবার পছন্দে কাস্তবাই নামে ১৪ বছর বয়সী এক মেয়ের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার এই সহধর্মিণী সকল আন্দোলন সংগ্রামে তাকে সর্বদা সমর্থন দিয়ে যেতেন। তিনি মোট চারজন পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। যদিও মহাত্মা গান্ধী ৩৭ বছর বয়স হতে সকল নারী সংসর্গ পরিত্যাগ করেন। বাল্যকালে তিনি পোরবন্দর ও রাজকোটে পড়ালেখা করেছেন। পরবর্তীতে গুজরাটের ভবনগরের সামালদাস কলেজ থেকে মেট্রিকুলেশন পাস করেন।
এর পর ১৮৮৮ সালে ১৯ বছর বয়সে পরিবারের ইচ্ছায় ব্যারিস্টারি পড়তে ইংল্যান্ডে যান এবং সেখানে ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডনে ভর্তি হন। লন্ডনে রাজকীয় জীবন যাপন করার সুযোগ থাকলেও তা তিনি পরিত্যাগ করে ভারতীয় রীতির সহজ সরল জীবন-যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। তিনি লন্ডনে বসেও তার মায়ের উপদেশ সর্বদা মেনে চলতেন। কথিত আছে যে বিলেত যাবার সময় মহাত্মা গান্ধীর মা তাকে মাংস, মদ ও নারী এই তিনটি বিষয় থেকে বিরত থাকতে শপথ করান এবং বিলেত গিয়েও তার মায়ের শপথ পূরণ করেন। তিনি লন্ডনের যে গুটি কয়েক নিরামিষভোজী দোকান ছিল সেখান হতেই খাবার গ্রহণ করতেন।
বিলেতে থাকাকালেই তিনি হিন্দুধর্ম নিয়ে ব্যাপক পড়াশোনা করেন এবং হিন্দুধর্ম বিষয়ে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। এর বাহিরে তিনি ইসলাম ধর্ম, খ্রিস্টানধর্ম ও বৌদ্ধধর্মে বিষদ জ্ঞান অর্জন করেন। **দক্ষিণ আফ্রিকায় মহাত্মা গান্ধী বিলেত থেকে ফিরে তিনি কিছুদিনের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকায় যান। সেখানে ভারতীয়দের উপর বর্ণবৈষম্যের নামে যে অন্যায় অবিচার চলছিল তা দেখে তিনি খুব মর্মাহত হন। ফলে তিনি আরও বেশ-কিছুদিন সেখানে অবস্থান করার সিদ্ধান্ত নেন এবং নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হন। তৎকালীন সময়ে সেখানে ভারতীয়দের কোন ভোটাধিকার ছিল না এবং সকল ক্ষেত্রেই তারা শ্বেতাঙ্গদের চাইতে নিচুস্তরের হিসেবে বিবেচিত হত।
ফলে ১৯৯৪ সালে গান্ধী সেখানে নাটাল ইন্ডিয়ান কংগ্রেস গঠন করেন। এর মাধ্যমে সেখানে ভারতীয়দেরকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়। ১৯৯৭ সালে তাঁর ভারতের সংক্ষিপ্ত সফরকালে শ্বেতাঙ্গ মব তাকে হত্যার চেষ্টা করে । কিন্তু তিনি তাদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপই নেন নি । কারণ তিনি মনে করতেন ব্যক্তিগত অপরাধের জন্য কোন গোষ্ঠীকে দোষারোপ করা ঠিক নয়।
১৯০৬ সালে ট্রান্সভাল কর্তৃপক্ষ এশিয়াটিক রেজিট্রেশন অ্যাক্ট প্রকাশ করলে তিনি তার প্রতিবাদ জানান এবং জনসাধারণকেও এ আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত করেন। তখন তিনি জনগণদের নিয়ে অহিংস আন্দোলন বা সত্যাগ্রহ আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং মোটামুটি সফলও হন। এর মাধ্যমেই গান্ধীর আদর্শ ও সত্যাগ্রহ আন্দোলন ব্যাপকতা লাভ করে।
**মহাত্মা গান্ধীর রাজনৈতিক জীবন দক্ষিণ আফ্রিকা থেকেই মহাত্মা গান্ধীর রাজনৈতিক জীবন শুরু হলেও তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে তিনি ভারতে ফিরে এলে। তিনি ভারতে এসে সরাসরি কংগ্রেসের ব্যানারে রাজনীতি শুরু করেন। ১৯১৮ সালে মহাত্মা গান্ধী জমিদারদের বিরুদ্ধে চম্পারন ও খেদা নামে আন্দোলন শুরু করে। সে সময় জমিদাররা তাদের মিলিশিয়া দিয়ে কৃষকদের উপর অত্যাচার চালাত, কৃষকদের উপর অন্যায়ভাবে করারোপ করা হত ফলে কৃষকরা দিনে দিনে দরিদ্র হতে থাকে এবং তাদের উপর অন্যায়-জুলুম বেড়েই চলছিল।
এই পরিস্থিতিতে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে কৃষকদের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। কৃষকদের পক্ষে যখন কথা বলার মত কেউ ছিল না তখন মহাত্মা গান্ধী তাদের পাশে এসে দাঁড়ান এবং গড়ে তোলেন চম্পারন ও খেদা আন্দোলন। আর গান্ধীর এই আন্দোলন ছিল অহিংস আন্দোলন ফলে ইংরেজদের ইশারায় জমিদাররা বাধ্য হয়ে সকল অবৈধ কর বাতিল করে এবং কৃষকদের ভর্তুকি দেয়াসহ দুর্ভিক্ষের অবসান না হওয়া পর্যন্ত কর উত্তোলন বন্ধ রাখতে বাধ্য করে। এই আন্দোলনের মাধ্যমে গান্ধী সাধারণ কৃষক-প্রজাদের নিকট অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেন।
**মহাত্মা গান্ধীর রাজনৈতিক জীবন ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগে হত্যাকাণ্ড হলে মহাত্মা গান্ধী তার তীব্র সমালোচনা করেন। একদিকে যেমন ব্রিটিশদের অন্যায় হত্যাকাণ্ডের প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করেন। অপরদিকে একইভাবে ভারতীয়দের হিংসাত্মক প্রতিশোধ পরায়ণ নীতিরও সমালোচনা করেন। তিনি নিজেদের স্বায়ত্তশাসন ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের দিকে গুরুত্ব দিয়ে স্বরাজ আন্দোলন গড়ে তোলেন।
১৯২১ সালে তিনি কংগ্রেসের নির্বাহী হিসেবে নির্বাচিত হন এবং স্বরাজ আন্দোলন কে সামনে রেখে আন্দোলন পরিচালনা ও দলকে সুসংগঠিত করার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যান। তার সময়ে কংগ্রেস পার্টি অভিজাতদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে সাধারণ জনসাধারণের পার্টিতে পরিণত হয়। মহাত্মা গান্ধী র অন্যতম রাজনৈতিক অবদান হল স্বদেশী আন্দোলন গড়ে তোলা।
তিনি স্বদেশী আন্দোলন গড়ে তোলার মাধ্যমে ভারতীয়দের কে বিদেশী বস্ত্র ও পণ্য বর্জন করার জন্য আহবান করেন। তিনি নিজেও বিলেতি পণ্য বর্জন করে খাদির চাকা ঘুরিয়ে বস্ত্র তৈরি করে তা পরিধান করতেন এবং ভারতীয় মহিলাদের কে খাদির চাকা ঘুরানো তে সম্পৃক্ত করেন। ১৯২২ সালে গান্ধীর নেতৃত্বেই অসহযোগ আন্দোলন গড়ে উঠে। প্রথমে এই আন্দোলন অহিংস থাকলে তা সহিংস রূপ লাভ করে। ফলে গান্ধীর বিরুদ্ধে আদালত ছয় বছরের কারাদণ্ড ঘোষণা করেন। যদিও পরবর্তীতে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। তাছাড়াও তিনি স্বরাজ আন্দোলন ও লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন পরিচালনা করেন।
১৯৩০ সালে ইংরেজরা লবণের উপর অতিরিক্ত করারোপের প্রতিবাদে তিনি সোচ্চার হন। তিনি ১৯৩০ সালের ১২ই মার্চ থেকে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত একটানা হেটে ৪০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে এলাহাবাদ থেকে ডান্ডিতে পৌঁছান এবং সেখানে যান নিজে লবণ তৈরির জন্য। তার সাথে হাজার হাজার ভারতীয় লবণ তৈরির এই প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করেন। তিনি কংগ্রেসের প্রতিনিধিত্ব করে লন্ডনের গোল টেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন। সর্বোপরি ইংরেজরা ভারত স্বাধীনতা আইন পাস করার পেছনে গান্ধীর নিয়ম তান্ত্রিক আন্দোলন ও ব্রিটিশদের সাথে অহিংস-নীতি নিয়ে অগ্রসর হওয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হিসেবে অবদান রেখেছে।
**যেভাবে হত্যা করা হয় মহাত্মা গান্ধী কে ১৯৪৮ সালের ৩০শে জানুয়ারি নাথুরাম গডসে নামক এক উগ্রবাদী হিন্দু মহাত্মা গান্ধী কে নতুন দিল্লীর বিরলা ভবনে গুলি করে হত্যা করে। যে মহাত্মা গান্ধী অহিংসা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার জন্য সমগ্র বিশ্বে বিখ্যাত ছিল সেই মহাত্মা গান্ধী ই তার নিজ দেশে অহিংসার স্বীকার হয়ে নিহত হন। মহাত্মা গান্ধী কে হত্যার কারণ হিসেবে নাথুরাম উল্লেখ করেন যে গান্ধীর কারণেই হিন্দুদের পুণ্যভূমি দ্বিখণ্ডিত হয়েছে এবং তিনি আরও অভিযোগ করেন যে গান্ধীর কারণেই মুসলিম অধিক শক্তি সঞ্চয় করতে পেরেছিল। নাথুরাম উগ্রবাদী হলেও তিনি অশিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিত ছিলেন না। তিনি ছিলেন উচ্চ শিক্ষিত হিন্দু ধর্মের একজন বিজ্ঞ পণ্ডিত।
তিনি গান্ধীর সত্যাগ্রহন ও রাষ্ট্রভাষা হিন্দির বিরোধিতার সেন্টিমেন্ট ও গোঁড়া হিন্দুত্ব-বাদী নীতি দিয়ে হিন্দুদের মধ্যে বৃহৎ একটি শ্রেণীর সমর্থন আদায় করেন। ফলে তিনি মহাত্মা গান্ধীর মত একজন বিখ্যাত ব্যক্তিকে হত্যা করেও অনুতাপ করেন নি । পাশাপাশি গোঁড়া হিন্দুদের নিকটও ছিলেন সমান জনপ্রিয়। ১৯৪৯ সালে ভারতের আদালত নাথুরামকে ফাঁসির আদেশ দেয়, ঐ-বছরই ১৮ই নভেম্বর নাথুরামের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। মৃত্যুর পরেও যেসব ব্যক্তি তাদের কর্ম দিয়ে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন মহাত্মা গান্ধী তাদের মধ্যে অন্যতম।
তিনি অহিংসা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার শক্তি দিয়ে অধিকার আদায়ের স্বপ্ন দেখতেন এবং সর্বদা নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষের পক্ষে দাবী আদায়ে সোচ্চার ছিলেন। ভারতীয়দের মধ্যে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী চেতনা গড়ে তোলার জন্য স্বদেশী আন্দোলন গড়ে তোলেন যা পরবর্তীতে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিকাশে এবং ইংরেজদের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে নিজেদের অধিকার আদায়ে ঐক্যবদ্ধ হতে সাহায্য করে।
মহাত্মা গান্ধী ই ভারতীয়দের স্বাধীনতা লাভের স্বপ্ন দেখায় যা ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা আইন পাশের মাধ্যমে বাস্তব রূপ লাভ করে। তাই বলা যায় যে ভারতীয় ইতিহাসে যেসকল সূর্যসন্তান জন্মগ্রহণ করেন মহাত্মা গান্ধীর অবস্থান তাদের মধ্যে সর্বাগ্রে। তাই মহাত্মা গান্ধীকে ভারতীয় জাতীর পিতা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। "
No comments