উষ্ণতায় নান্দনিক পাহাড়ি ‘বুরগি’
কার্তিকের আকাশে এখন শীতের আগমনি বার্তা। শহর পেরিয়ে গ্রামে গেলেই দেখা মিলবে মৃদু কুয়াশা আর ভোরের শিশিরের। মাঘের সন্ন্যাসী আসতে আর যেন তর সইছে না। ঘুমকাতুরে শীতের সকালে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাপা পিঠার দেশি স্বাদ মনপ্রাণ জুড়াতে ভারি উপাদেয়। তার সঙ্গে তো খেজুরের টাটকা রস আছেই। এত সুখের ভিড়ে শীত নিবারণের প্রস্তুতিও আগে থেকেই নেওয়া উচিত।
শীত এলে কাঁথা-কম্বলের চাহিদা বেড়ে যায়। তবে বিদেশি কম্বলের ভিড়ে দেশি কিছু পেলে মন্দ কী! পাহাড়িদের তৈরি ‘বুরগি’ হতে পারে এই শীতে আপনার উষ্ণতার ঘনিষ্ঠ সঙ্গী। চাকমাদের ঐতিহ্যবাহী এই বুরগি শীতে আরামদায়ক। বুরগি হলো চাকমাদের শীতের চাদর। তাঁতে বোনা এই চাদর উল ও সুতার দুই ধরনেরই হয়ে থাকে। তীব্র শীতে বুরগি কেবল উষ্ণতাই দেয় না, বরং সূক্ষ্ম বুনন আর কারুকাজ এই শীতবস্ত্রকে বিশেষত্ব দিয়েছে। পাহাড়ি শীতবস্ত্র বুরগি মূলত টিকে আছে নারীদের শ্রমে আর মেধায়।
শীত সামনে রেখে প্রতি বছরই বুরগি বানানোর ধুম পড়ে বান্দরবান জেলার শহরতলির বমপল্লিগুলোতে। পর্যটনের এই মৌসুমে বাড়তি আয়ের আশায় অনেকটাই ব্যস্ত থাকেন পাহাড়ি নারীরা।
বান্দরবান-চিম্বুক সড়কের ফারুকপাড়ায় গেলে ঘরে ঘরে দেখা মিলবে কোমর তাঁতে বুরগির বুনন। কারিগরদের সিংহভাগই নারী। প্রতিবছর নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত বান্দরবানে আসা পর্যটকদের মধ্যে বুরগির বেশ চাহিদা থাকে। তবে সুতার দাম বেড়ে যাওয়ায় বুরগি বুননে এখন খুব একটা লাভ হয় না বলে জানিয়েছেন কারিগররা। তাদের মতে, একটি বুরগি বানাতে প্রায় দেড় কেজি সুতার প্রয়োজন। বুননে সময় লাগে পাঁচ থেকে সাত দিন। কিন্তু বাজারে এখন প্রতি কেজি সুতার দামই ৩২০ থেকে ৩৫০ টাকা।
বুরগি বুনে পাহাড়ি নারীরা যেমন তাদের ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছেন, তেমনি তা বিক্রি করে পরিবারেও আসছে সচ্ছলতা। একসময় পাহাড়িদের ঘরে ঘরে বুরগির প্রচলন থাকলেও এখন আগের অবস্থা নেই। মূলত পর্যটক আর শৌখিন মানুষই বুরগির ক্রেতা। কোমর তাঁতে বোনা নারীদের পরনের পোশাক পিনন-হাদির চাহিদা থাকে কেবল পাহাড়ি নারীদের কাছে। পিনন-হাদির মতো শীতবস্ত্র বুরগি তেমন বিক্রি হতো না। পর্যটন বাড়ায় বুরগির চাহিদা তৈরি হয়েছে নতুন করে।
ফারুকপাড়ার মতো লাইমিপাড়া, গ্যেেসমানিপাড়াসহ কয়েকটি বমপল্লিতেও গিয়ে দেখা যায় একই ধরনের চিত্র। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর জেলায় পর্যটক কমতে শুরু করে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও এখনো পর্যটক আশানুরূপ বাড়েনি। তবু বিক্রির আশায় এরই মধ্যে আশপাশের পল্লি ঘুরে বুরগি, শীতের চাদর, মাফলার সংগ্রহ করা শুরু করেছেন তাঁতিরা। জানা গেছে বুরগি মানভেদে ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। চাদর বিক্রি হয় ২৫০ থেকে ৫০০ টাকা। এ ছাড়া ১৫০ থেকে ২০০ টাকায় মাফলার বিক্রি হয়ে থাকে। উষ্ণতা দেওয়ার পাশাপাশি সূক্ষ্ম বুনন আর কারুকাজের জন্য পর্যটকদের পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যেও চাহিদা রয়েছে বুরগির। জুমের ধান কাটা শেষ হলে পুরোদমে বুরগি, মাফলার ও চাদর তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন বম নারীরা।
No comments