Adsterra

মণিপুর সংঘাত : কী ঘটছে সেখানে ? কেন ঘটছে ?

ঢাকা ভয়েস, Dhaka Voice, মণিপুর সংঘাত, কী ঘটছে সেখানে, কেন ঘটছে, বীরেন সিং, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, কুকি সম্প্রদায়, মণিপুরের সহিংসতা, মিলিশিয়া

রাজ্যটিতে মে মাসে শুরু হওয়া সহিংসতায় এখন পর্যন্ত প্রায় ১৩০ জন মানুষ নিহত ও ৪০০ জন মানুষ আহত হয়েছে। অবস্থা এতটাই নাগালের বাইরে চলে গিয়েছে যে, সেনাবাহিনী, আধাসামরিক বাহিনী ও পুলিশ সহিংসতা দমন করতে হিমশিম খাচ্ছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অপেক্ষাকৃত ছোট রাজ্য মণিপুরে স্থানীয় কুকি আদিবাসীদের সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই সম্প্রদায়ের চলছে জাতিগত বিরোধ। জমি ও প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ে এই বিরোধ সহিংসতায় রুপ নেওয়ায় অনেকেই চলমান অবস্থাকে গৃহযুদ্ধের সাথে তুলনা করেছেন। 


গত মে মাসে কুকি সম্প্রদায়ের গ্রামে আক্রমণ করে ঘরবারি ধ্বংস করে মেইতেই সম্প্রদায়ের লোকেরা। একইসাথে কুকি সম্প্রদায়ের নারীদের ওপর নির্যাতনও চালানো হয়। এমন সব অভিযোগের মাঝেই চলতি সপ্তাহে ঐ সহিংসতা সম্পর্কিত একটি চাঞ্চল্যকর ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে। ভিডিওতে দেখা যায়, একটি গ্রাম আক্রমণের পর পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে দুই নারীকে বিবস্ত্র অবস্থায় হাঁটতে বাধ্য করছে মেইতেই সম্প্রদায়ের কিছু পুরুষ। মণিপুর বাংলাদেশের পূর্বে ও মায়ানমার সীমান্তে অবস্থিত ভারতের এক পাহাড়ি রাজ্য। এতে প্রায় ৩৩ লাখ মানুষের বসবাস। এই জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকেরও বেশি মেইতেই সম্প্রদায়ের। আর রাজ্যটিতে প্রধান সংখ্যালঘু আদিবাসী হিসেবে কুকি ও নাগা সম্প্রদায়ের মানুষ শতকরা ৪৩ ভাগ। 


রাজ্যটিতে মে মাসে শুরু হওয়া সহিংসতায় এখন পর্যন্ত প্রায় ১৩০ জন মানুষ নিহত ও ৪০০ জন মানুষ আহত হয়েছে। অবস্থা এতটাই নাগালের বাইরে চলে গিয়েছে যে, সেনাবাহিনী, আধাসামরিক বাহিনী ও পুলিশ সহিংসতা দমন করতে হিমশিম খাচ্ছে। প্রায় ৬০ হাজার মানুষ নিজেদের ঘরছাড়া হয়েছে। পুলিশের অস্ত্রাগার লুট করা হয়েছে। শত শত চার্চ, কয়েক ডজন মন্দির ধ্বংস করা হয়েছে। বহু গ্রামে চালানো হয়েছে হামলা।  


মুলত সংখাগরিষ্ঠ মেইতেই সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি লাভের দাবির মধ্যে দিয়ে ঘটনার সুত্রপাত ঘটে। এতে করে তারা কোটাসহ বেশ কিছু বাড়তি সুবিধা লাভ করবে। অন্যদিকে মেইতেই সম্প্রদায়ের এ দাবির জোরালো বিরোধিতা করছে কুকি সম্প্রদায়। 

কেননা কুকি সম্প্রদায়ের যুক্তি হচ্ছে, ইতোমধ্যে রাজ্যটির সরকারে ও সমাজে একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করেছে মেইতেই সম্প্রদায়। এমতবস্থায় তাদেরকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিলে তারা আরও বেশি শক্ত অবস্থান তৈরি করবে। এমনকি তখন সংখালঘু কুকি সম্প্রদায়ের এলাকার মেইতেই সম্প্রদায়ের লোকেরা জমি কিনতে পারবেন কিংবা বসতি স্থাপন করতে পারবেন।     


কিন্তু এসব শঙ্কা ছাড়াও সহিংসতার পেছনে আরও অগণিত অন্তর্নিহিত কারণ রয়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। কুকি সম্প্রদায়ের অভিযোগ, মেইতেই সম্প্রদায়ের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার নামে আড়ালে কুকি সম্প্রদায়কে দমনের চেষ্টা করছে।  অন্যদিকে মিয়ানমার থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশ মণিপুর রাজ্যের উত্তেজনা যেন আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ভূমি ব্যবহারের উপরও চাপ সৃষ্টি হয়েছে। যার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে বেকারত্ব। আর এই বেকারত্বের কারণে যুবকদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ মিলিশিয়া বাহিনীতে যোগ দিচ্ছে। রাজ্যটিতে মেইতেই, কুকি ও নাগা সম্প্রদায়ের আলাদা আলাদা মিলিশিয়া বাহিনী গড়ে উঠেছে। বাহিনীগুলো ধর্মভিত্তিক ভিন্নতা ও মাতৃভূমির দাবিতে একে অপরের সাথে যুদ্ধ করছে। এমনকি এই তিন গোষ্ঠীর প্রত্যেকেই আবার ভারতের নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে সংঘাতে জড়িয়েছে।  


তবে মে মাসের সহিংসতা শুধু মেইতেই ও কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যেই সংগঠিত হয়েছিল। এ বিষয়ে দ্য ফ্রন্টিয়ার মণিপুরের এডিটর ধীরেন এ সাদোকপাম বলেন, "এবার সংঘর্ষের মূলে রয়েছে জাতিগত কারণ, ধর্ম নয়।"  


মেইতেই সম্প্রদায় মণিপুর, মিয়ানমার ও আশেপাশের অঞ্চলে বসবাস করেন। এদের বেশিরভাগই হিন্দু। তবে কেউ কেউ আবার সানামাহি ধর্মের অনুসারী।  


মেইতেই সম্প্রদায়ের মানুষেরা বেশিরভাগই রাজ্যটির মূল শহর ইম্ফল উপত্যকায় বসবাস করে। অন্যদিকে কুকি সম্প্রদায়ের বসবাস আশেপাশের পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে। 

সম্প্রতি ছড়িয়ে পরা ভিডিওটি ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের উদাহরণ। এটি সংঘাতকে আরও উসকে দেবে, যা একের পর এক প্রতিশোধপরায়ণ আক্রমণের ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে।  


স্থানীয় গণমাধ্যমে তথ্য অনুযায়ী, মুলত কুকি মিলিশিয়া কর্তৃক একজন মেইতেই নারীকে ধর্ষণের 'মিথ্যা' তথ্য ছড়িয়ে পরায় ঘটনার সুত্রপাত ঘটে। এতে করে উত্তেজিত মেইতেই জনতা কুকি জনগোষ্ঠীর ওপর একের পর এক হামলা করতে থাকে ও নারীদের ওপর নির্যাতন চালায়।   


পুরো ভারতজুড়ে মে মাসের মণিপুরের সহিংসতা আলোড়ন তৈরি করলেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এতদিন বিষয়টি নিয়ে একেবারে নিশ্চুপ ছিল। তবে চলতি সপ্তাহে কুকি দুই নারীকে নির্যাতনের ভিডিওটি প্রকাশিত হলে তীব্র চাপের মুখে মোদি মুখ খুলতে বাধ্য হয়।  


প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, "ঘটনাটি ভারতের জন্য লজ্জার। দোষীদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। মণিপুরের দুই মেয়ের সাথে যা হয়েছে সেটা ক্ষমার অযোগ্য।" 


তবে এত দেরিতে মণিপুর ইস্যু নিয়ে জনসম্মুখে কথা বলায় অনেকেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সমালোচনা করেছেন। এদিকে পরিস্থিতি সামাল দিতে ভারত সরকার ৪০ হাজার সৈন্য, আধাসামরিক বাহিনী ও পুলিশ নিয়োগ করেছে। তবে সহিংসতা যেন থামছেই না; বরং বহু গ্রামবাসী নিজেদের ঘরছাড়া হচ্ছে।  


মণিপুরে মেইতেই সম্প্রদায়ের নেতা বীরেন সিং এর নেতৃত্বের ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। জনসংখ্যায় দিক দিয়ে ৫৩ ভাগ হলেও স্থানীয় পার্লামেন্টের ৬০ টি আসনের মধ্যে ৪০ টি আসনই মেইতেই সম্প্রদায়ের দখলে।   


কুকি সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয় যে, পপি চাষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার নামে মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং কুকি এলাকাগুলোকে টার্গেট করছে। অন্যদিকে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয় যে, কুকি বিদ্রোহী দল উক্ত অঞ্চলে উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে।

No comments

Powered by Blogger.