Adsterra

ড্যান কগিন || মুক্তিযুদ্ধে বিদেশির অবদান

ড্যান কগিন, মুক্তিযুদ্ধে বিদেশির অবদান, ঢাকা ভয়েস, Dhaka Voice, today top news, today trending news, hot news, update news, somoy news


প্রখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক ড্যান কগিন ১৯৫৪ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত কাজ করেছেন এপি (এসোসিয়েটেড প্রেস) এবং টাইম ম্যাগাজিনেড্যান কগিনের সাংবাদিক হয়ে ওঠার পর্ব, আলাবামায় কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মার্টিন লুথার কিং এর পদযাত্রায় রিপোর্ট প্রদান করে তিনি প্রথম দাগ কাটেন সংবাদ মাধ্যমের বৃত্তেতারপর এশিয়ায় শুরু হয় তাঁর পদচারণা- ভিয়েতনাম যুদ্ধের অভিজ্ঞতায় পোড় খেয়ে তিনি উপনীত হন বাংলাদেশে, একাত্তরে২৫ মার্চ ১৯৭১ এর সেই ভয়াল কালো রাতে ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলের জানালা দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্মম হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেছিলেন ড্যান কগিনঅন্যান্য বিদেশি সাংবাদিকদের মতো তাকেও সে হোটেল ছেড়ে যেতে হয় একদিন পরস্বাধীনতার চল্লিশ বছর পূর্তির আয়োজনে মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি বন্ধুদের কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করেছে বাংলাদেশ সরকারতাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয় বাংলাদেশেতাঁর লিখিত সেই অসামান্য রিপোর্ট বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দলিলমুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা এই মার্কিন সাংবাদিককে বাংলাদেশমুক্তিযুদ্ধ মৈত্রি সম্মাননা’(মরণোত্তর) প্রদান করা হয়

    আমন্ত্রণ পাবার পর তাঁকে মনে উকি দিয়েছিল অনেক ঘটনা, নাম, কথাঢাকার সেই হোটেলে আরেকবার প্রাতরাশ সারাতে চেয়েছিলেন, অসংখ্য পুরোনো বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে কথা হবে, আড্ডা হবে, এমন আশাও তাঁর ছিলসেসব বন্ধুর সবার নাম মনে ছিল নাকারও কারও নাম স্মৃতি খুঁড়ে উদ্ধার করেছিলেনখুব ইচ্ছা ছিল কুষ্টিয়া যাবেনএকাত্তরের এপ্রিলে কুষ্টিয়ায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে বাঙ্গালি সেনাসদস্যদের সরাসরি লড়াই হয়তাঁর পাঠানো সে যুদ্ধের বিবরণ, দি ব্যাটেল অব কুষ্টিয়া, টাইম ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছিল ১৯ এপ্রিলতিনিই প্রথম বিদেশি সংবাদদাতা, যার সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা ছিলএকাত্তরে আরও অসংখ্য প্রতিবেদন তিনি পাঠিয়েছেন, কিন্তু কুষ্টিয়ার স্মৃতি তাঁর মনে গাথা ছিলযে কদিন কুষ্টিয়ায় ছিলেন, অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, কারও কারও সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বও হয়েছিলতাদের কেউ কি এখনো বেচে আছেন? খুব ইচ্ছা ছিল তাদের খুজে বের করা, মুখোমুখি বসে আরও একবার কথা বলাকিন্তু ড্যানের ঢাকা যাওয়া হয়নি শেষ পর্যন্তমস্তিষ্কের প্রবল রক্তক্ষরণ, সেখান থেকে পক্ষাঘাতপ্রায় দুই মাস হাসপাতালে জীবন্মৃত অবস্থায় থাকার পর ২০১২ সালের জানুয়ারি ২২ তারিখে নিউইয়র্কের এলমাস্ট হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ড্যান কগিন

    কলম আর ক্যামেরা হাতে নিজের জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে নিরীহ বাংলাদেশিদের পাশে ছিলেন তিনিএকসময় উপমহাদেশের সবগুলো দেশে থেকে সাংবাদিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি, কখনো টাইম ম্যাগাজিনের হয়ে, কখনো বা এপির হয়েফলে এই অঞ্চলের ইতিহাস ও তাঁর রাজনৈতিক বৈরিতা খুব ভালোই জানতেন ড্যান কগিন১৯৬৫ থেকে ১৯৭২ এই সাত বছর ড্যান টাইম ম্যাগাজিনের বৈদেশিক প্রতিনিধি হিসেবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নানা দেশে চষে বেড়ান১৯৬৯ সালে প্রথমবারের মতো ঢাকায় আসেন আইয়ুব-বিরোধী গণ-অভ্যুত্থানের ওপর রিপোর্ট করতেসে সময় বঙ্গবন্ধু ও মাওলানা ভাসানীসহ অসংখ্য বাঙ্গালি নেতার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল১৮ এপ্রিল ১৯৬৯ সালে মাওলানা ভাসানীর ওপর প্রকাশিত হয় তাঁর স্মরণীয় প্রতিবেদন, প্রফেট অব ভায়োলেন্সবাংলাদেশ বিচ্ছিন্নতার পথে এগুচ্ছে, সামরিক সরকারের পক্ষে সম্ভব হবেনা এদেশকে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে পদানত করে রাখা, ড্যানের সেই প্রতিবেদন থেকে এ কথা বুঝতে কষ্ট হয়না, বাঙ্গালির আকাশে সূর্য অত্যাসন্ন

   ২৫ মার্চের কালো রাত ড্যান দেখেছিলেনতিনি জানতেন, এদেশের মানুষ মুক্তির যে স্বাদ পেয়েছে, কোনো মূল্যেই তা বিকোবে নাসত্যি সত্যি মুক্তিযুদ্ধ কীভাবে জনযুদ্ধে বদলে যাচ্ছে তা দেখার জন্য সীমান্ত টপকে লুকিয়ে প্রবেশ করেছিলেন কুষ্টিয়া৮০ হাজার পাকিস্তানি সেনার গ্যারিসন পূর্ববাংলা, সেখানে একমাত্র বিদেশি সাংবাদিক হিসেবে চলাফেরার মস্ত ঝুকি রয়েছে, এ কথা তিনি জানতেনকিন্তু এক সময়ের মার্কিন নৌ-সেনা, ভিয়েতনাম ও ইন্দো-চীনের পোড় খাওয়া ওয়ার করেসপনডেন্ট এত সহজে ভয় পাওয়ার লোক ননএপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে তিনি হেটে পুরো শহর ঘুরে দেখেনমুক্তিবাহিনী তখন সদ্য সংঘটিত হচ্ছেসে বাহিনীর সদস্যদের খুজে বের করে তাদের সঙ্গে কথা বলেন, তাদের অপারেশন প্রত্যক্ষ করেনতাঁর কাছ থেকে দেখা ও শোনা সে ঘটনার বিবরণ, যা টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় ১৯ এপ্রিল, সম্ভবত মুক্তিবাহিনীর ওপর প্রথম সরেজমিন প্রতিবেদন২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর বাঙ্গালি সামরিক ও আধা সামরিক সদস্যদের হাতে যে অঞ্চলগুলো সর্বপ্রথম মুক্ত হয়, কুষ্টিয়া তাঁর মধ্যে অন্যতমবাঙ্গালি যোদ্ধাদের সঙ্গে সম্মুখ সময়ে ৩১ মার্চ বালুচ রেজিমেন্টের ডেলটা কোম্পানির অধিকাংশ সেনা সদস্য নিহত, নয়তো গ্রেপ্তার হয়সে বিদ্রোহের নাটকীয় বিবরণ ধরা পড়েছে ড্যান কগিনের প্রতিবেদনে

     মে মাসের গোড়ার দিকে প্রথম মার্কিন সাংবাদিক হিসেবে অনুমতি নিয়েই তিনি ঢাকায় আসেনসেনা অধিকর্তারা হয়তো ভেবেছিলেন, তাদের খবরদারিতে থাকা বিদেশি সাংবাদিকের চোখে ধুলো দেওয়া কঠিন হবেনাকিন্তু সুচতুর সাংবাদিক ড্যান কগিন৩ মে তাঁর প্রকাশিত প্রতিবেদনে ড্যান ঢাকাকে বললেন, ‘এ সিটি অব দি ডেড২৫-২৬ মার্চের নিষ্ঠুর সেনা হামলা, যার ফলে কার্যত নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিককে কচুকাটা করা হয়েছেতাঁর এক মাস পরও এই শহরে মৃত্যুর চিহ্ন সর্বত্রঢাকার বিভিন্ন বাড়ির ছাদে তিনি পাকিস্তানি পতাকা দেখেছিলেন, অফিসের দেয়ালে জিন্নাহর ছবিঅবরুদ্ধ ঢাকা বেচে থাকার জন্য আপস করে চলছে বটে, তবে এর গভীরে বিদ্যমান রোষ ও প্রতিরোধ স্পৃহা বুঝে নিতে পারঙ্গম ছিলেন ড্যান কগিনলিখেছেন- ‘আর্দ্র এক নিস্তব্ধতার মধ্যে প্রত্যেক বাড়ির ছাদে উড়ছে পাকিস্তানের সাদা-সবুজ পতাকাএই পতাকা সৈনিকদের দূরে রাখবেআরেক রক্ষাকবচ হিসেবে বিশেষভাবে প্রদর্শণ করা হচ্ছে রাষ্ট্রের প্রয়াত প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, এমনকি বর্তমান প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের ছবিতবে ভুল বোঝার কোনো অবকাশ নেই যে, পূর্ব পাকিস্তানিরা ঢাকায় সেনা দখলদারিকে বিবেচনা করে আত্মসমর্পণ নয়, সামরিক পশ্চাদপসারণ হিসেবেআমরা কিছুই ভুলব না, কোনো কিছুই ক্ষমা করব না, বললেন একজন বাঙ্গালিযখন জানতে পারলেন আমি একজন সাংবাদিক তখন শহরবাসী অনেকে আমাকে নিয়ে দেখালেন গণকবর, সিঁড়ির নিচে সেই স্থান যেখানে দুজন অধ্যাপককে হত্যা করা হয় এবং দেখালেন নৃশংসতার আরও কতক স্থান

     অক্টোবরের ২৫ তারিখে নয়াদিল্লি থেকে পাঠানো এক প্রতিবেদনে ড্যান মুক্তিযুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতির একটি খতিয়ান তুলে ধরেনপ্রায় এক কোটি উদ্বাস্তু, কমপক্ষে ১০ লাখ নিহতকরাচিতে একজন সামরিক কর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে ড্যান লিখেছেন, জেনারেলরাই স্বীকার করেছে, না হলেও এক লাখ লোক নিহত হয়েছেপাকিস্তানি অবরোধের বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর হামলা ক্রমেই বাড়ছে, বর্ষাকাল শেষ হলেই প্রতিরোধের মাত্রা বহু গুণ বেড়ে যাবে, এই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন ড্যানযুদ্ধের শেষ মাথায় গোপনে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছিলেন তিনিটাইমের প্রতিবেদনে তাঁর জীবন্ত বিবরণ রয়েছেড্যান কগিন বলেনমুক্তিবাহিনীর এক ক্যাপ্টেন আমাকে জানালেন, তাঁরা ভিয়েতকংদের মতো তিন স্তরে আক্রমণ চালাচ্ছেনসাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা সেরে তাঁরা এখনচোরাগোপ্তাহামলা ও দ্রুত পলায়নের নীতি অনুসরণ করছেনএরপর হবে সার্বিক হামলা

    ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের নাটকীয় বিবরণ সংবলিত ড্যানের একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন ছাপা হয় টাইম ম্যাগাজিনের ডিসেম্বরের প্রচ্ছদ কাহিনীতেপ্রিয় আবদুল্লাহ, আমরা এখন এখানেতোমাদের খেলা শেষআমার পরামর্শ হলো, তোমরা আত্মসমর্পণ করোএরপর তোমাদের ভালো-মন্দ দেখার দায়িত্ব আমারপাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজির কাছে পাঠানো ভারতীয় জেনারেল নাগরার এই গোপন বার্তা দিয়ে শুরু সে প্রতিবেদনমুক্তিযুদ্ধের শেষ দিনগুলোর শ্বাসরুদ্ধকর অভিজ্ঞতার সে বিবরণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এক অবিস্মরণীয় দলিল

   গত শতকের ষাট এবং সত্তরের দশক ছিল প্রিন্ট জার্নালিজ বা সংবাদপত্র ও সাময়িকীর সোনালি সময়ব্রিটেন ও আমেরিকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকা বিশ্বব্যাপি প্রচার না পেলেও তাদের ছিল বিশ্বজনীন প্রভাববিলেতের দৈনিক টাইমস, গার্ডিয়ান, অবজারভার, টেলিগ্রাফের পাশাপাশি ছিল সাপ্তাহিক ট্যাবলয়েড মেল কিংবা সান, সেই সঙ্গে ছিল গাম্ভীর্যপূর্ণ নিউ স্টেট্ম্যান, আর ছিল তথ্যপূর্ণ সাময়িকী দ্যা ইকোনমিস্টআমেরিকা থেকে নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, বোস্টন গ্লোব কিংবা আরও কিছু দৈনিকের পাশাপাশি ছিল গ্লোসি ম্যাগাজিন টাইম, নিউজউইক এবং ছিল বড় আকারের সচিত্র ম্যাগাজিন লাইফ কিংবা পোস্টদৈনিকের প্রচার বিশ্বজনীন না হলেও সাপ্তাহিকীগুলোর ছিল বিশ্বব্যাপী প্রচার ও প্রভাবসাংবাদিকতার রীতি ও মান নির্ধারণ করে দিত এসব দৈনিক ও সাপ্তাহিক এবং পৃথিবীজুড়ে নানা দেশে ছড়িয়ে ছিল তাদের সংবাদদাতা

   ডেইলি টেলিগ্রাফ সবাইকে টেক্কা দিয়েছিল ২৫ মার্চের গণহত্যাযজ্ঞের প্রত্যক্ষদর্শী বিবরণ ও ছবি ছাপিয়েএর আগে নিউজউইক তাদের প্রচ্ছদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সংবলিত রিপোর্ট ছেপেছিলপোয়েট অব পলিটিকসশিরোনামে- সেও এক ইতিহাসটাইম সাময়িকীর সংবাদদাতা ড্যান কগিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে পেরেছিলেন, পাকিস্তানি সামরিক নেতৃত্বের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ ছিলকিন্তু ২৫ মার্চের পরপরই কোনো স্কুপ নিউজ তৈরিতে অপারগ হলেনবিদেশি সাংবাদিকদের প্রায় বস্তাবন্দি করে বিমানে ব্যংকক পাঠানো হলোতবুও তাঁরা অনেকেই দ্রুত ফিরে এসছিলেন দিল্লি কিংবা কলকাতায়, রাজধানী থেকে কিংবা সীমান্ত অঞ্চল ঘুরে নানাভাবে সংবাদ সংগ্রহে সচেষত হতেএ যাত্রায় সবাইকে টেক্কা দেন ড্যান কগিন, তিনি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে চলে আসেন কুষ্টিয়ায় এবং প্রেরণ করে রিপোর্ট ব্যাটল অব কুষ্টিয়াকুষ্টিয়া এবং সীমান্ত-সংলগ্ন চুয়াডাঙ্গায় এসেছিলেন আরও কেউ কেউ, সংবাদ পাঠিয়েছেন নিজ নিজ পত্রিকা অথবা টেলিভিশনেতবে ড্যান কগিনের কুষ্টিয়া সংক্রান্ত রিপোর্ট ছিল বাঙ্গালির প্রতিরোধ রচনার জোরালো ও সবিস্তর ভাষ্য, যা বিশ্বকে জানান দিয়েছিল বাঙ্গালি কেবল পড়ে পড়ে মার খাচ্ছে না, প্রত্যাঘাতও করেছেকুষ্টিয়া কারাগারে বন্দি দীর্ঘদেহী পাক-সৈন্যদের ছবি হকচকিয়ে দিয়েছিল পাক-শাসকদের, যুদ্ধ যে একতরফা হচ্ছে না এটা ছিল তাঁর বড় স্বাক্ষর, যা অস্বীকার করার কোনো উপায় তাদের ছিল না

    ৩ মে ১৯৭১ টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিতদি সিটি অব ডেড’- মৃত্যুপুরী ঢাকা- এই রিপোর্টের শুরুতে পত্রিকার পক্ষ থেকে লেখা হয়েছিলঃ ২৫ মার্চ রাতে ট্যাংকবহর নিয়ে ঢাকা এবং অন্য শহরগুলোতে আক্রমণ শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তানি আর্মি বিদেশি সাংবাদিকদের বহিষ্কার করে সব সাংবাদিকদের ওপর কার্যত সার্বিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেবহিষ্কৃতদের মধ্যে ছিলেন টাইমের সংবাদদাতা ড্যান কগিনসম্প্রতি তিনি ভারত থেকে মোটরসাইকে, ট্রাক, বাস ও সাইকেল করে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ফিরেছিলেন ঢাকায়, যুদ্ধ শুরুর পর তিনিই প্রথম মার্কিন সাংবাদিক যিনি ঢাকা শহর পরিদর্শন করলেন

     সামরিক বাহিনীর বর্বর হত্যাভিযানে বিমূঢ় ও স্তব্ধ ঢাকা শহর ড্যান কগিনের পূর্ব-পরিচিত, আর তাই অবরুদ্ধ ঢাকার জনজীবনের বর্ণনা দানে তিনি পারঙ্গমতাঁর পরিচয় রেখেছিলেনতিনি লিখেছেনঃ ঢাকা  সব সময় কিছুটা যেনো নিরস শহর, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল এবং কয়েক ডজন চীনা রেস্তোরার বাইরে আনন্দের জোগান রয়েছে সামান্যই, অন্যদিকে আবার নগরীর ১৫ লাখ অধিবাসীর খুব কম সংখ্যকই এসব আনন্দের স্বাদ নিতে পারেনএখন অনেক দিক থেকে ঢাকা হয়ে উঠেছে মৃত্যুপুরীট্যাংক, কামান ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে মূলত বেসামরিক নাগরিকের ওপর সেনাবাহিনীর অভিযানের এক মাস পর, ৩৪ ঘন্টার সেই যথেচ্ছ হত্যালীলা শেষে, ঢাকা এখনও স্তম্ভিত ও কম্পিত, শহরের অবশিষ্ট জনগণ সেনা নিয়ন্ত্রণে যাপন করছে সন্ত্রস্ত জীবনঅবরুদ্ধ ঢাকা বেচে থাকার জন্য আপস করে চলছে বটে, তবে এর গভীরে বিদ্যমান রোষ ও প্রতিরোধ স্পৃহা বুঝে নিতে পারগ ছিলেন ড্যান কগিন

     একাত্তরে ড্যান কগিন ছিলেন তাঁর কর্মজীবনের মধ্যগগণেতিনি সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের, ডিসেম্বরে প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত জুলফিকার আলী ভুট্টো ত্বরিত এক সাক্ষাৎ দিয়েছিলেন ড্যান কগিনকে এবং তাকেই প্রথম জানিয়েছিলেন যে তিনি শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে চলেছেনবঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে ড্যান কগিনের ছিল বিশেষ অন্তরঙ্গতাকর্মসূত্রে নানাভাবে তাঁরা উভয়ে ছিলেন পরস্পরের পরিচিত সেটা অনুমান করা কষ্টকর নয়১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন ড্যান কগিনকে, টাইম সাময়িকীর ১৯ জানুয়ারি ১৯৭২ দীর্ঘ প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল- কারাগার থেকে ক্ষমতায় মুজিবের পথযাত্রাএর আগে ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ প্রত্যক্ষ করেছেন ড্যান কগিন, টাইম সাময়িকীতে সম্মিলিত প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে ডেস্কে, ড্যান কগিনসহ আরও অনেকের রিপোর্ট মিলিয়ে

    ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ টাইম সাময়িকীতে প্রকাশ পেয়েছিল দেড় পৃষ্ঠাব্যাপী অসাধারণ রিপোর্ট ইস্ট পাকিস্তানঃ ইভেন দ্যা স্কাইজ উইপ-(পূর্ব পাকিস্তানঃ এমনকি আকাশও কাদছে) পূর্বাঞ্চলীয় যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে এই রিপোর্টে তিন দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনার বিশ্লেষণ দাখিল করা হয়েছেনয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদের প্রতিক্রিয়া দিয়ে রিপোর্টের শুরু, রয়েছে উদ্বাস্তু পরিস্থিতির বিবরণ, আরও আছে পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তর থেকে ড্যান কগিন প্রেরিত রিপোর্টপাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ ততদিনে বিদেশি সংবাদদাতাদের প্রবেশাধিকার দিতে শুরু করেছিল এবং সেই সূত্রেই ইসলামাবাদ-ঢাকা যাতায়াত করেছিলেন কগিনপ্রতিবেদনের শিরোনাম তাঁর রিপোর্ট থেকেই নেওয়ারিপোর্টের একাংশ সরাসরি ড্যান কগিনের বরাতে উদ্বৃত হয়েছে, অপরাংসগে তাঁর প্রতিবেদন থেকে নেওয়া হলেও উৎস উল্লেখিত হয়নিসে যাত্রায় দীর্ঘ প্রতিবেদন পাঠিয়েছিলেন কগিন, কেননা তিনি ঢাকায় এসে ক্যান্টনমেন্টে সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে যেমন দেখা করেছিলেন তেমনি কর্তৃপক্ষের নজর এড়িয়ে গিয়েছিলেন গোপালগঞ্জের মুক্ত এলাকায়, মুক্তিবাহিনীর কর্মকান্ডের সবিস্তার পরিচয়-গ্রহণ করেছেন, ফিরেছেন আরিচা হয়ে ঢাকায়, যে-পথ তাঁর পূর্ব-পরিচিত

    টাইমের এই প্রতিবেদনে লেখা হয়েছেঃ ইসলামাবাদ যদিও মিলিটারি কমান্ডের প্রতি নিপীড়ন-নীতি শিথির করার আদেশ জারি করেছে তারপরও দিনে প্রায় ৩০,০০০ উদ্বাস্তু ভারতে প্রবেশ করছে, জানাচ্ছে গ্রাম দগ্ধ হওয়া, অধিবাসী হত্যা, সুপরিচিত মানুষদের তুলে নিয়ে যাওয়া এবং তাদের আর না-ফেরার কাহিনীএইসব অতি ভয়ংকর ঘটনা একটি ৫৩৬ জন বাঙ্গালি তরুণী সম্পর্কিত, তাদের মধ্যে কেউ বা কেবল অষ্টাদশী যুদ্ধের প্রথম দিন থেকে যাদের আটক রাখা হয়েছে ঢাকার ক্যান্টনমেন্টেঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং আবাসিক গৃহ থেকে তুলে এনে সামরিক যৌনাগারে ঠেলে দেয়া মেয়েরা সবাই তিন থেকে পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বাসামরিক স্থাপনায় আটক মেয়েদের গর্ভপাত ঘটানোর জন্য আর্মি বাঙ্গালি স্ত্রীরো বিশারদ নিয়োগ করেছে বলে জানা যায়তবে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আটকদের গর্ভপাতের জন্য ইতিমধ্যে অনেক বিলম্ব ঘটে গেছেমিলিটারিরা কয়েকজন করে মেয়েদের মুক্তি দিতে শুরু করেছে, তাঁরা ঔরসে তখনও বহন করেছেন সৈনিকদের সন্তান

    এই রোমহর্ষক বর্ণনার পরপর দশ লক্ষ মৃত উপ-শিরোনামে প্রকাশ পেয়েছে আরেক বৃত্তান্তয, যা উৎস উল্লেখ ব্যতীত ড্যান কগিন প্রেরিত বার্তা থেকে নেয়া হয়েছেরিপোর্টে লেখা হয়েছেঃ সাত মাসের গৃহযুদ্ধে কত মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে সেটা কেউ জানেনাতবে করাচিতে, ইয়াহিয়ার সামরিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একজন স্বীকার করেন, জেনারেলরা বলেন এই সংখ্যা হবে অন্তত ১০ লক্ষবাঙালি লিবারেশন আর্মি, মুক্তিবাহিনীর কোনো নাশকতামূলক তৎপরতার কারণে কাছের গ্রামে শাস্তিমূলক অভিযান পরিচালনা দৈনন্দিন ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে

   ড্যা কগিনের সাংবাদিকতা, বিশেষভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতা মেলে ধরতে তাঁর অনন্য ভূমিকা ও ভিন্নতর সাংবাদিকতা বিষয়ে অনেক কথা বলার থাকেসাংবাদিকতার এথিক্স বা নৈতিকতা, সাংবাদিকের নিরপেক্ষতা ও নিঃস্পৃহতা, সম্পাদকের দায়িত্ব ইত্যাদি বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখানে বিবেচনার দাবিদার

No comments

Powered by Blogger.