Adsterra

ঢাকা শহরের ‘রিকশা ও রিকশাচিত্র’র ইউনেস্কো স্বীকৃতি লাভ

 


ঢাকা শহরের ‘রিকশা ও রিকশাচিত্র’র ইউনেস্কো স্বীকৃতি লাভ, ঢাকা ভয়েস, Dhaka Voice, ৫ম বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, Today Trending News, Today Viral News

বাংলাদেশের ৫ম বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেল ঢাকা শহরের ‘রিকশা ও রিকশাচিত্র’। গতকাল (৬ ডিসেম্বর) বতসোয়ানার উত্তর-পূর্ব চোবে ডিস্ট্রিক এর কাসান শহরে ১৮তম ইউনেস্কোর বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যর আন্তঃসরকারী কমিটির অধিবেশনে বাংলাদেশ সময় দুপুর ২:৫৪ মিনিটে এই ঘোষণা করা হয়। ইউনেস্কোর বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিভাগ কর্তৃক সর্বশেষ ২০১৭ সালে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটি বুনন কৌশল-এর স্বীকৃতির পর দীর্ঘ ৫ বছর পর এ অর্জন।


মূলত বিশ্বের বিভিন্ন অধরা বা স্পর্শতীত আর্ট (intangible art) বা কৌশলকে সুরক্ষার জন্য এ শিল্পকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। সারা বিশ্বের বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সুরক্ষার জন্য ইউনেস্কোর ২০০৩ সালে কনভেনশন উপর ভিত্তি করে প্রতিবছর বিভিন্ন দেশের বিশ্ব তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। প্রতিবছর ৪-৯ ডিসেম্বর ইউনেস্কোর বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যর আন্তঃসরকারী কমিটির চূডান্ত সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ বছর সভাটিতে বাংলদেশের প্রতিনিধি হয়ে অংশগ্রহণ করেন ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত খন্দকার মোহাম্মদ তালহা ও প্রথম সচিব ওয়ালিদ বিন কাশেম।


গত বছর নভেম্বর মাসের শেষদিকে ‘Rickshaws and Rickshaw Painting in Dhaka’ ঢাকা শহরের রিকশা ও রিকশাচিত্র উপর একটি চূড়ান্ত মনোনয়ন ফাইল ইউনেস্কোর ইনটেনজিবল কালচারার হেরিটেজ বিভাগে প্রেরণ করা হয়। ইউনেস্কোর নিয়মানুযায়ী রাষ্টীয় পক্ষ হিসেবে সংষ্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হয়ে বাংলা একাডেমি এ ফাইল অগ্রায়িত করা হয়েছিল। যদিও এর শুরুটা হয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে। ২০১৮ সালের ইউনেস্কোর আন্তঃসরকারী কমিটির ১৩তম অধিবেশনের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে রিকশা ও রিকশাচিত্রের ফাইলটি সংশোধন ও তথ্য হালনাগাদ করার উদ্দেশ্যে ফিরিয়ে আনা হয় এবং পরবর্তীতে বেশ কয়েক দফা সংশোধনের পর চলতি বছরের প্রথমে এ উপাদানটি ইউনেস্কোর ২০০৩ কনভেনশন-এর আর্টিকেল ১২-এর অত্যাবশকীয় শর্তানুযায়ী বাংলাদেশের বিমূর্ত সংস্কৃতির অনলাইনভিত্তিক জাতীয় ইনভেন্টরিতে অন্তর্ভুক্ত করে সংশোধিত সংস্করণ চূড়ান্তভাবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতির জন্য প্রেরণ করা হয়। এ স্বীকৃতির মধ্যে দিয়ে রিকশা চিত্রের দেশ হিসেবে আরেকবার বিশ্বমঞ্চে উজ্জ্বল হলো বাংলাদেশের নাম। ঢাকা শহরের রিকশা ও রিকশাচিত্র ঐতিহ্যগত কারুশিল্প উৎপাদনে জ্ঞানও দক্ষতা বা Traditional craftsmanship ক্যাটাগরিতে চলমান বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যর হিসেবে এই স্বীকৃতি মিলেছে। ইউনেস্কো থেকে প্রতিবছর ৫টি ক্যাটাগরিতে বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যর উপরবিশ্বের ঐতিহ্যরঅংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে— মৌখিক ঐতিহ্য বা ওরাল ট্রেডিশনাল অ্যান্ড এক্সপ্রেশনস (oral tradition and expressions), পরিবেশনা শিল্প বা পারফরমিং আর্টস (performing arts), সামাজিক অনুশীলন, আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব অনুষ্ঠান বা সোসাল প্র্যাকট্রিস (social practice), রিচুয়ালস অ্যান্ড ফেসটিভস ইভেন্ট (ritual and festive event), প্রকৃতি এবং মহাবিশ্ব সম্পর্কিত জ্ঞান ও অনুশীলন বা নলেজ অ্যান্ড প্র্যাকটিস কনর্সানিং ন্যাচার অ্যান্ড ইউনির্ভাস (knowledge and practice concerning nature and universe) এবং ঐতিহ্যগত কারুশিল্প উৎপাদন করার জ্ঞান ও দক্ষতা বা ট্র্যাডিশনাল ক্রাফটম্যানশিপ (traditional craftsmanship)। এগুলো সাধারণত আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত।


বাংলাদেশে রয়েছে এ সকল বিমূর্ত সাংস্কৃতিক উপাদানের হাজারো ভান্ডার। দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যর সুরক্ষার বাধ্যবাধকতা এবং প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে, তাই বাংলাদেশ বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য (আইসিএইচ)-এর সুরক্ষার জন্য ইউনেস্কোর ২০০৩ কনভেনশন স্বাক্ষর করেছে। ইতিমধ্যে আমাদের বাউল গান (২০০৮), ঐতিহ্যবাহী জামদানি বুনন শিল্প (২০১৩), পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা (২০১৬), সিলেট অঞ্চলের শীতলপাটি বুনন শিল্প (২০১৭) এবং সর্বশেষ যুক্ত হলো ঢাকা শহরের রিকশা ও রিকশাচিত্র ইউনেস্কোর বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যর প্রতিনিধিত্বমূলক (Representative List of the Intangible Cultural Heritage of Humanity) তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবার স্বীকৃতি অর্জন করেছে।


এ রিকশাচিত্র বাংলার শহুরে লোকচিত্রকলার অন্যতম শৌখিন শিল্পকলা। রিকশাকে সুসজ্জিত করে তোলার উদ্দেশ্যে রিকশাচিত্র বা পেইন্টিং করা হয়ে থাকে। রিকশার প্রায় প্রতিটি অংশই আর্কষণীয় ও রঙিন করে তোলার জন্য চিত্রায়িত করে তোলা হয়। এর মধ্যে ব্যাক প্লেট বা পেছনের আয়তাকার টিনেরপাত/বোর্ড থেকে শুরু করে গদি বা সিট, সিটের পাশের অংশ, পেছনের অংশ, পট্টি, হুড, হুডের উপরের অংশ, চালকের বসার সিট, স্টিংয়ারিং-এর সামনের অংশ ইত্যাদি সব অংশ জুড়ে বিভিন্ন চিত্রকর্ম ও ঝালর, ঘন্টা, ফুলদানি নানাবিধ সামগ্রী দিয়ে আকর্ষণীয় করে তোলা হয়। তাই ইউনেস্কোর ঐতিহ্যর তালিকায় রিকশাসহ রিকশাচিত্র শিল্প স্থান পেয়েছে।


বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরকে বলা হয় রিকশার শহর। বর্তমানে রিকশা হচ্ছে বাংলাদেশের অন্যতম সহজলভ্য যাত্রী প্রিয় বাহন। শহরময় রিকশাগুলো চলমান জীবন্ত চিত্রপ্রদর্শনীর মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। রিকশা পেইন্টাররা তাদের নিজস্ব শিল্পশৈলী, উপস্থাপন রীতি ও স্বকীয় স্টাইলে একটি সম্পূর্ণ রিকশাকে রঙিন করে তোলে। এই শিল্প অপ্রতিষ্ঠানিক শিল্পীদের মাধ্যমে বিকাশিত হয়েছে। রিকশা পেইন্টের মাধ্যমে চিত্রকররা তাদের ভালো লাগা বিভিন্ন বিষয়গুলো তুলে ধরেন। রিকশা পেইন্টিং-এর বহুল ব্যবহৃত চিত্র গুলো হচ্ছে বোরাক, স্বাস্থ্যবান গাভী, মোনাজাতরত শিশু, পশু-পাখি, ফুল-লতাপাতা, বিভিন্ন নায়ক-নায়িকা, সিনেমার দৃশ্য, এছাড়াও বিভিন্ন বিখ্যাত স্থাপত্য যেমন তাজমহল, সংসদভবনসহ নানা সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়বার্তা ও রিকশাআর্টের অংশ। এ শিল্পকর্মটি তার নিজম্ব শিল্পশৈলী, স্বকীয়তা ও বিষয়বস্তুর কারণে ইতিমধ্যে দেশি-বিদেশী শিল্প প্রেমীদের কাছে সমাদৃত হয়েছে। সাধারণত গুরু-শিষ্যের মাধ্যমে রিকশাচিত্রায়ন বিদ্যা প্রসারিত হয়ে থাকে। এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াই হচ্ছে লিভিং হেরিটেজ (living heritage) বা চলমান ঐতিহ্য। এসব চলমান ঐতিহ্যকে বিশ্ব ঐতিহ্যর তালিকায় সুযোগ রয়েছে যা যেকোনো প্রতিষ্ঠান থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে রাষ্ট্রপক্ষ হয়ে। তবে এ মনোনয়ন ফাইলটি বা প্রস্তাবটি ৩১ মার্চের মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে প্রেরণ করতে হবে। বাংলাদেশের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে এ মনোনয়ন ফাইল প্রেরণ করা হয়ে থাকে। ইউনেস্কো কর্তৃক নির্ধারিত বিমূর্ত সাংষ্কৃতিক ঐতিহ্য ফর্মে যেকোনো চলমান ঐতিহ্যর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সম্মতিক্রমে প্রয়োজনীয় তথ্য সহকারে আবেদন করতে পারে। এছাড়াও আর্জেন্ট সেইফগার্ডিং (urgent safeguarding) বা জরুরী সুরক্ষার জন্য পৃথক ফর্ম রয়েছে যা বিলুপ্তপ্রায় বিমূর্ত সাংষ্কৃতিক ঐতিহ্যর জন্য প্রযোজ্য। বাংলাদেশের পাঁচটি বিমূর্ত সাংষ্কৃতিক ঐতিহ্যই চলমান ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।


ইউনেস্কোর ২০০৩-এর কনভেনশনের আর্টিকেল ১১ ও ১২ অনুযায়ী বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগত উপাদগুলোর সুরক্ষা করা ও এর তালিকা তৈরি করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। তাই এদেশের বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উপাদানগুলো চিহ্নিত করে সুরক্ষা ও সচেতনতা সৃষ্টির ব্যবস্থা করার উদ্দেশ্যে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতা এবং বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের উদ্যোগে ‘heritagehub.gov.bd’ নামে একটি অনলাইনভিত্তিক জাতীয় ইনভেন্টরি ও একটি মোবাইল এ্যাপ তৈরি করা হয়েছে। এতে ঘরে বসেই নিজ জেলার বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে জাতীয় ইরভেন্টরির অর্ন্তভুক্ত করে তা সুরক্ষার একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে। যেটি ইউনেস্কোর স্বীকৃতির জন্য অত্যাবশকীয় শর্তসমূহের একটি। বিগত অনেক মনোনয়ন ফাইল শুধুমাত্র একটি হালনাগাদকরণ জাতীয় ইনভেন্টরির অনুপস্থিতির কারণে মনোনয়ন পেতে ব্যর্থ হয়েছিল।


ইউনেস্কোর বিমূর্ত সাংষ্কৃতিক ঐতিহ্য বিভাগ থেকে স্বীকৃতির ফলে নতুন করে রিকশা ও রিকশাচিত্র শিল্প সুরক্ষার পথ প্রসারিত হলো। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের এ স্বীকৃতির ফলে রিকশাচিত্রকররা উৎসাহের সাথে কাজ করে যাবে এবং এ শিল্পকে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে কাছে ছড়িয়ে দিবে। সারাবিশ্বে রিকশাচিত্র বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং হিসেবে কাজ করবে। পাশাপাশি সরকারী ও বেসরকারী স্তরে বিভিন্ন পদক্ষেপ ও নীতিমালা গ্রহণের উদ্যোগী হলে এ শিল্পসহ বাংলাদেশের অন্যান্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যর সঠিকভাবে সুরক্ষার পথ সুগম হবে।

চাইলে আপনিও হতে পারেন ঢাকা ভয়েজ পরিবারের অংশ। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা কিংবা মতামত বা সৃৃজনশীল লেখা পাঠিয়ে দিন আমাদের ঠিকানায়। নাম সহ প্রকাশ করতে চাইলে লেখার নিচে নিজের নাম, পরিচয়টাও উল্লেখ করে দিন। ঢাকা ভয়েজে প্রকাশিত হবে আপনার লেখা। মেইল : dhahkavoice.news24@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.