Adsterra

ভ্লাদিমির পুতিন : গোয়েন্দা কর্মকর্তা থেকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হয়ে ওঠার গল্প

 
ভ্লাদিমির পুতিন: গোয়েন্দা কর্মকর্তা থেকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হয়ে ওঠার গল্প, ঢাকা ভয়েস, Dhaka Voice, Today Trending News, Today Viral News, Hot News

একটা সময় ছিল যখন সমগ্র বিশ্ব দুই ভাগে বিভক্ত । একভাগে ছিল সমাজতন্ত্র অপর ভাগে ছিল পুঁজিবাদ। সমাজতন্ত্রের নেতৃত্বে ছিল সোভিয়েত রাশিয়া এবং পুঁজিবাদের নেতৃত্বে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা। এই পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের মধ্যে দীর্ঘদিন প্রতিযোগিতার পর পুঁজিবাদ জয় লাভ করে অপরদিকে সমাজতন্ত্রের পতন ঘটে। এরই সাথে সাথে বিশ্বে একক শক্তি হিসেবে মার্কিনীদের উত্থান হয়। অপরদিকে সোভিয়েত রাশিয়ার ক্ষমতা লোপ পায়। কিন্তু রাশিয়া তার হারানো শক্তি ও ঐতিহ্য ফিরে পেতে মরিয়া ছিল সর্বদা। এর অংশ হিসেবে একজন দক্ষ শাসকও খুঁজছিল তারা। এই পরিস্থিতিতেই উত্থান হয় ভ্লাদিমির পুতিন এর। যার মধ্যে রাশিয়ার মানুষ স্বপ্ন দেখতে শুরু করে তারা তাদের হারানো গৌরব ফিরে পাবে। যদিও শুরুর দিকে তাদের এই স্বপ্নকে বাস্তবতা বিবর্জিত কল্পনা হিসেবে অনেকেই মনে করেছেন। কিন্তু বর্তমানে পুতিন তার কর্ম দিয়ে এই স্বপ্নকে অনেকটাই বাস্তবতার কাছে নিয়ে এসেছে। তবে পুতিনের আজকের এই অবস্থানে আসার পিছনের গল্পটা কখনো সহজ-সরল ছিল না। পুতিনের জীবন ও রাশিয়ার নানা দিক নিয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করা হয়েছে এই নিবন্ধে।

ভ্লাদিমির পুতিন বর্তমান বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট। তিনি ১৯৫২ সালে লেলিনগ্রাদে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন বাধ্যতামূলকভাবে নিয়োজিত একজন নৌবাহিনীর সদস্য ও তার মাতা ছিলেন একজন কারখানা শ্রমিক। তার দাদা ছিলেন পেশায় একজন বাবুর্চি। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত চঞ্চল প্রকৃতির। ধরাবাঁধা পড়াশুনায় তার মনোযোগ ছিল কম। তিনি কঠিন পরিবেশে সেন্ট পিটার্সবার্গে যার লেলিনগ্রাদের অপর নাম এইখানে বেড়ে উঠেন।

১৯৬০ সালে ভ্লাদিমির পুতিনের শিক্ষাজীবনের সূচনা হয়। তিনি লেলিনগ্রাদের একটি প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হন। সেখানে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করার পর ১৯৬৮ সালে কারিগরী ইন্সটিটিউটের অধীনে একটি হাই স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৭০ সালে সেখান থেকে তিনি পাশ করে বের হন।

কিন্তু স্কুল জীবন শেষ করার পূর্ব থেকেই তার একমাত্র ব্রত ছিল সোভিয়েত রাশিয়ার তৎকালীন বিখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি তে যোগদান করা। সেসময় থেকেই তিনি জানতেন যে গোয়েন্দা সংস্থায় তাকে যোগ করতে হলে অবশ্যই রাশিয়ান সেনাবাহিনী অথবা আইন বিভাগের ছাত্র হতে হবে।তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে করেই হোক তাকে আইন বিভাগে পড়তেই হবে অর্থাৎ তখন থেকে তার শিক্ষা জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় আইন বিভাগে ভর্তি হওয়া।

পুতিনের অদম্য ইচ্ছা শক্তি ও প্রচেষ্টার ফলে ১৯৭০ সালে রাশিয়ার বিখ্যাত লেলিনগ্রাদ স্টেট ইউনিভার্সিটিতে আইন বিভাগে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। তার বিভাগে ১০০ ছাত্রের মধ্যে মাত্র যে ১০ জন ছাত্র তাদের স্কুল সমাপ্ত করার পর পরই ঐ বিভাগে ভর্তির সুযোগ পেয়েছিল পুতিন ছিলেন তাদের মধ্যে একজন। ১৯৭৫ সালে তিনি কৃতিত্বের সাথে আইন বিভাগ থেকে পাশ করে বের হন। ১৯৮০ সালের গোঁড়ার দিকে তিনি তার স্বপ্নের দেখা পান অর্থাৎ গোয়েন্দা বাহিনী তে যোগদান করেন।শুরু হয় তার জীবনের চ্যালেঞ্জিং পথ চলা।

গোয়েন্দা বাহিনীতে যোগদানের পর প্রথমে তার পদায়ন হয় জাতীয় গোয়েন্দা বাহিনীতে। সেখানে তিনি সহকারী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।সেখানে কিছুদিন কাজ করার পর তিনি কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স শাখায় বদলি হন। সেখানে পাঁচ মাসের মত কাজ করার পর তাকে অপারেশন ও পুনঃপ্রশিক্ষন কোর্সে পাঠানো হয়। সেখানে প্রশিক্ষণ শেষে তিনি আবার কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স শাখায় ফিরে আসেন। কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স এ দ্বিতীয় মেয়াদে কাজ করার সময়ে তিনি ফরেন ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তাঁকে বিশেষ প্রশিক্ষণের জন্য মস্কোতে পাঠানো হয়। সেখানে এক বছর কাটানোর পর তিনি লেলিনগ্রাদে ফিরে যান, সেখানকার প্রধান কেজিবি শাখায় তিনি প্রায় সাড়ে চার বছর কাজ করেন। তারপর তিনি মস্কোতে ফিরে আসেন সেখানে তিনি কেজিবি ১নং স্কুলে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। জার্মানিতে যাবার সকল প্রশিক্ষণ সেখানেই সমাপ্ত হয়। এই প্রশিক্ষণ শেষে তিনি গোয়েন্দা বৃত্তির জন্য জার্মানিতে গমন করেন। সেখান থেকে তিনি সকল তথ্য কেন্দ্রীয় কেজিবি সদরে প্রেরণ করতেনতাছাড়া জার্মানিতে নিযুক্ত সকল কেজিবি সদস্যদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করতেন। এসব কাজ তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করে থাকতেন।

১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ এই পাঁচ বছর পুতিন রাশিয়ান এজেন্ট হিসেবে পূর্ব জার্মানিতে কাজ করেন। জার্মানিতে কাজ করাকালীন তিনি পদন্নোতি পেয়ে প্রথমে লেফটেন্যান্ট কর্নেল এবং পরে আবারও পদন্নোতি পেয়ে বিভাগীয় প্রধানের প্রধান সহকারী হন। ১৯৮৯ সালে জার্মান রিপাবলিকে কাজ করা রাশিয়ান এজেন্টদের জন্য প্রদেয় মেডেল ও সম্মাননায় ভূষিত হন 'ন্যাশনাল পিপলস আর্মি' এর প্রতি তাঁর নিঃস্বার্থ সেবার পুরস্কার হিসেবে

১৯৯৭ সালে ভ্লাদিমির পুতিন রাষ্ট্রপতির অফিস সহকারী চিফ অব স্টাফ এবং প্রধান নিয়ন্ত্রিত দপ্তরের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৯৮ সালে তিনি পদোন্নতি পেয়ে রাষ্ট্রপতির প্রশাসনিক দপ্তরের চিফ অব স্টাফ কাজ শুরু করেন। তার কিছুদিন পরেই তিনি ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিসের পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৯৯ সালে আসে পুতিনের জীবনের মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা। সেসময়কার রাষ্ট্রপতি তাকে রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দান করেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অল্পকাল অতিবাহিত করার পর রাষ্ট্রপতি ইয়েলতসিন পুতিনের মধ্যে রাশিয়ার অস্তমিত সূর্যের পূনর্দয় ঘটানোর ক্ষমতা দেখতে পান। সেইজন্যই ২০০০ সালের শুরুর দিকে ইয়েলতসিন পুতিনকে আপদ-কালীন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দিয়ে তিনি পদত্যাগ করেন।

২০০০ সালের মার্চ মাসে পুতিন প্রথমবারের মত রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হন।নির্বাচিত হওয়ার পর পর তার সামনে নানা চ্যালেঞ্জ এসে দেখা দেয় কারণ স্নায়ুযুদ্ধের পর সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের রাশিয়া সামাজিক,রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রায় সব দিক হতে খুব খারাপ অবস্থায় চলে যায়। বেকারত্ব চরম আকার ধারণ করে, সাধারণ মানুষের জীবন যাত্রার মান অত্যন্ত শোচনীয় পর্যায়ে নেমে যায়। এই অবস্থা থেকে রাশিয়াকে টেনে তোলা মোটেই সহজসাধ্য কাজ ছিল না। একদিকে রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ চাপ অপরদিকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয়। পুতিন জানতেন তিনি এসব কিছু করতে ব্যর্থ হলে তার জনপ্রিয়তা চরম-মাত্রায় হ্রাস পাবে। যার দরুন তাকে ক্ষমতা থেকেও সড়ে দাঁড়াতে হতে পারে এসব চাপ সত্ত্বেও তার রাশিয়াকে পুনরায় বিশ্বশক্তির কাতারে নিয়ে যাওয়া ও রাশিয়ার সামগ্রিক উন্নয়নের অদম্য ইচ্ছা থেকেই তিনি নিষ্ঠার সাথে কাজ করা শুরু করেন। তার একাগ্র কর্তব্যনিষ্ঠা ও তীক্ষ্ণ মেধার জোরে রাশিয়ার আসন্ন পতন থেকে অনেকটা টেনে তোলেন যার স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি আবার ২০০৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে দ্বিতীয়বারের মত রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। দ্বিতীয় মেয়াদ সফলতার সাথে শেষ করার পর ২০০৮ সালের মে মাসে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি তৃতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রপতি না হওয়ার পিছনে কারণ হল রাশিয়ার কোন রাষ্ট্রপতি টানা দুই মেয়াদের বেশি সময় শাসন করার কোন বিধান নাই।

কিন্তু ক্ষমতা আঁকড়ে ধরতে পুতিন তার বন্ধুদের কাজে লাগায়। কখনো প্রধানমন্ত্রী কখনো প্রেসিডেন্ট হিসেবে রাষ্ট্রনেতার দায়িত্ব পালন করেন পুতিন। সংবিধান রক্ষা করে ক্ষমতা হস্তগত করেন তিনি। সম্বোধন ঠিক রাখতে নিজের ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব দিয়ে নিজে হয় প্রধানমন্ত্রী। যদিও সব ক্ষমতা পুতিনের হাতে ছিল। ক্ষমতা আরো স্থায়ী করতে তার বন্ধু প্রেসিডেন্টকে দিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের মেয়াদকাল চার থেকে বাড়িয়ে ছয় বছর করে। যা ২০১২ সাল থেকে কার্যকর হয়। ঠিক সেই বছরে তৃতীয় দফায় আবারো প্রেসিডেন্ট হয়ে ফিরে আসেন পুতিন। ২০১৮ সালে তিনি চতুর্থ দফার প্রেসিডেন্ট হয়। ২০২৪ সালে এর মেয়াদ শেষ হলেও সংবিধান সংস্কার করে আরো দুই মেয়াদের ২০৩৬ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় থাকার পথ অনেক প্রায় পাকাপোক্ত করেন তিনি।

ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও ঐতিহ্যগত কারণে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখেন পুতিন। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন কে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় কুরাজনৈতিক বিপর্যয় বলে তিনি। তখন থেকেই তিনি রাশিয়াকে কেন্দ্রীয় আনতে মরিয়া। সামরিক শক্তিসহ বিভিন্ন কারণে হয়েছে মার্কিন আলোচনা কেন্দ্র বিন্দু। ইউক্রেন অধিকৃত ক্রিমিয়া দখল কিংবা মার্কিন নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করার মত অভিযোগ রয়েছে পুতিনের বিরুদ্ধে। এখন পুতিন এর প্রভাবশালী রাষ্ট্রনেতার নাম। সিরিয়া ইস্যুতেও দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন পুতিন। বিশ্ব থেকে রাশিয়াকে একঘরে করে দেয়ার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে পশ্চিমা বিশ্ব। কিন্তু তাতে পাত্তা দিচ্ছে না পুতিন। রাশিয়া সার্বভৌমত্ব রক্ষার বিষয়ে কড়া বার্তা দিয়েছে পুতিন। তিনি বলেছেন ন্যাটো কিংবা পশ্চিমা কোনো দেশকে তার ত্রিসীমানায় ঘাটি গারতে দিবে না মস্কো ।পশ্চিমা বিশ্বসহ পুরো বিশ্বের হুমকি ধামকি উপেক্ষা করে ইউক্রেনের সামরিক অভিযান শুরু করে পুতিন।

বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রনেতা পুতিনের যুদ্ধের মনোভাব যুক্তরাষ্ট্রই তৈরি করেছে বলে মনে করেন রুশ মার্কিন সাংবাদিক।২০১৮ সালে এক ইউনিভার্সিটিতে যুক্তরাষ্ট্র - রাশিয়ার সম্পর্ক শীর্ষ একটি আলোচনা সভায় তার ব্যাখ্যা দেন তিনি।বিশ্ব রাজনীতিতে পুতিন যে জায়গা করে নিয়েছে তার পেছনেও সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও পশ্চিমাদের একক আধিপত্যের মনোভাবকে অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, অভিযান সফল হলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা ও ধীরে ধীরে শক্তি হারাতে থাকবে। আর পরাক্রমশালী হয়ে উঠতে পারে রাশিয়া তথা রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।

চাইলে আপনিও হতে পারেন ঢাকা ভয়েজ পরিবারের অংশ। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা কিংবা মতামত বা সৃৃজনশীল লেখা পাঠিয়ে দিন আমাদের ঠিকানায়। নাম সহ প্রকাশ করতে চাইলে লেখার নিচে নিজের নাম, পরিচয়টাও উল্লেখ করে দিন। ঢাকা ভয়েজে প্রকাশিত হবে আপনার লেখা। মেইল : dhahkavoice.news24@gmail.com 

follow our Facebook page DHAKA Voice

follow our Twitter account Dhaka Voice 

No comments

Powered by Blogger.