সবজির দাম বাড়ার নেপথ্যে ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজি
ক্রেতাদের প্রত্যাশা থাকে শীত মৌসুমে কম দামে সবজি পাওয়া যাবে। মাছ-মাংসের চেয়েও এ সময় পছন্দের সবজি কেনায় আগ্রহ থাকে বেশি। কিন্তু এবার এমন আশায় ‘গুড়ে বালি’। ভরা মৌসুমেও সবজিতে হাত দেওয়া কঠিন। বিশেষ করে টমেটো, বেগুন, শিম, ফুলকপি, বাঁধাকপির দাম বেশ চড়া। গত বছরের তুলনায় কোনো কোনোটির দর বেড়েছে প্রায় চার গুণ।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় কৃষকরা আগের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করছেন। তাছাড়া চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম। পরিবহন খরচও বেশি। দাম বাড়ার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী পথে পথে ও বাজারে সরকারদলীয় লোক ও পুলিশের চাঁদাবাজি। এই প্রক্রিয়া বন্ধ করা উচিত। তবে সরকারের সংশ্লিষ্টরা দায়ী করছেন মধ্যস্বত্বভোগীদের।
গতকাল ঢাকার শান্তিনগর, হাতিরপুল ও কারওয়ান বাজারে দেখা গেছে, শিমের কেজি ৮০ থেকে ১০০, পাকা টমেটো ৮০ থেকে ১০০, বেগুন ৭০ থেকে ৮০, মুলা ৩৫ থেকে ৪০ টাকা এবং ফুলকপি ও বাঁধাকপি প্রতি পিস ৪০ থেকে ৫০ টাকা। অথচ এসব সবজির উৎপাদন খরচ ৭ থেকে ১০ টাকা। এর সঙ্গে অন্যান্য খরচ ও মুনাফা যোগ করলেও ভোক্তা পর্যায়ে সবজির কেজি খুচরায় গড়ে ৩০ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। বছর দুয়েক আগেও সবজির দর ক্রেতার নাগালে ছিল।
কৃষিপণ্যের দৈনিক বাজারদর নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। সংস্থাটির তথ্যমতে, গত বছরের এ সময় প্রতি কেজি শিম ২০ থেকে ৫০, টমেটো ৪০ থেকে ৪৫ এবং বেগুন ২৫ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিটি ফুলকপি ২০ থেকে ২৫ এবং বাঁধাকপি ২৫ থেকে ৩৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এ হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে সর্বোচ্চ চার গুণ বেড়েছে শিমের দাম। বেগুনের ক্ষেত্রে বেড়েছে দুই থেকে আড়াই গুণ।
উৎপাদন খরচ সর্বোচ্চ ১০ টাকা
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী প্রতি কেজি শিমের উৎপাদন খরচ ৬ টাকা ৮৮ পয়সা, টমেটো ৯ টাকা ৬৯ পয়সা, বেগুন ১০ টাকা ২৬ পয়সা এবং প্রতিটি ফুলকপি ও বাঁধাকপির উৎপাদন খরচ প্রায়
১০ টাকা। শিমের ক্ষেত্রে উৎপাদন খরচ ৭ টাকার সঙ্গে পরিবহন, রাস্তায় বিভিন্ন স্থানে চাঁদা, আড়তের কমিশনসহ কেজিতে ৫ থেকে ৬ টাকা খরচ হয়। সর্বোচ্চ ৬ টাকা খরচ যোগ করলে কেজিতে মূল খরচ দাঁড়ায় ১৩ টাকা।
‘কৃষি বিপণন বিধিমালা, ২০২১’ অনুযায়ী, সব ধরনের শাকসবজি উৎপাদক পর্যায়ে ৪০ শতাংশ, পাইকারিতে ২৫ শতাংশ ও খুচরায় ৩০ শতাংশ লাভ করা যাবে। তিন স্তরে দামের ওপর এই হারে মুনাফা যোগ করলে খুচরা পর্যায়ে আসতে প্রতি কেজি শিমের সর্বোচ্চ দর হওয়ার কথা ২৯ টাকা ৫৭ পয়সা। কিন্তু উৎপাদক থেকে শুরু করে খুচরা পর্যন্ত ব্যবসায়ীরা যে যার মতো দর বাড়াচ্ছেন।
গত বছর এ সময় দাম কত ছিল
গত বছরের এ সময় ঢাকায় সবজির দর কেমন ছিল তা জানতে ১০ থেকে ১২ জন পাইকারি ও খুচরা সবজি ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলেছে সমকাল। তারা বলেছেন, ভরা মৌসুমে সবজির বাজারে এমন অগ্নিমূল্যে শুধু ক্রেতা নন, বিক্রেতারাও বিস্মিত। তাদের ভাষ্য, অন্য বছরগুলোর এ সময় পাইকারিতে শিমের কেজি কেনা পড়ত ১৫ থেকে ১৬ টাকা। খরচ ও লাভ যোগ করে বিক্রি করা যেত ২০ থেকে ২৫ টাকায়। অথচ এখন পাইকারিতে কিনতে ২৫ টাকার বেশি খরচ পড়ে যায়। টমেটো কেনা যেত পাইকারিতে কেজি ১৫ থেকে ২০ টাকা দরে। খুচরায় বিক্রি হতো ২৫ থেকে ৩০ টাকা। পাইকারিতে মুলা ৬ থেকে ৭ টাকায় কিনে খুচরায় ১৫ থেকে ২০ টাকায় বিক্রি করা যেত। অথচ এখন পাইকারিতে কিনতেই ২৫ টাকার বেশি খরচ পড়ে যায়।
কারওয়ান বাজারের খুচরা সবজি বিক্রেতা দুলাল হোসেন বলেন, ‘জীবনে কোনোদিনই শীত মৌসুমে শিমের কেজি ৮০-৯০ টাকায় বেচিনি। গত বছর এ সময় কেজি ছিল ২৫ থেকে ৩০ টাকা। এমনও না যে শিমের অভাব আছে। মাইনষেরে কী কমু আমার নিজেরও খারাপ লাগে দাম বলতে।’
আড়তে যেভাবে দাম বাড়ে
দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্যাপারীরা ট্রাকে করে সবজি নিয়ে আসেন কারওয়ান বাজার, যাত্রাবাড়ী ও মিরপুর এলাকায়। তারা সাধারণত মণ হিসাবে বিক্রি করেন। রাতে সবজি আনার পর তারা পুরো মার্কেটে খোঁজখরব নেওয়া শুরু করেন কয়টা ট্রাক এসেছে, কী পরিমাণ এসেছে। যখনই দেখেন পরিমাণে কিছুটা কম এসেছে এবং পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীর ভিড় বাড়ছে, তখনই দাম বাড়াতে শুরু করেন। এমনও দেখা যায়, শুরুতে কেজি ২০ টাকা দরে বিক্রি করলেও শেষ দিকে তা ২৫ টাকায় ওঠে। বিপরীত ঘটনাও ঘটে। কখনও দেখা যায়, শুরুতে বেশি দরে বিক্রি হলেও ক্রেতা সংকটে ব্যাপারীরা দর কমিয়ে দেন। এ কারণে একই সবজি খুচরা বিক্রেতাদের কাছেও ভিন্ন ভিন্ন দর দেখা যায়।
দাম বাড়ানোর কারণ চাঁদাবাজি
পাইকারিতে দর বাড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন ধাপে চাঁদার পরিমাণও বেড়েছে। এটিও দাম বাড়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। হাতিরপুলের খুচরা সবজি বিক্রেতা ইসমাইল হোসেন সমকালকে বলেন, ফুটপাতে ব্যবসা করলে দোকান ভাড়া ছাড়া দৈনিক কমপক্ষে ৫০০ টাকা খরচ আছে। এর মধ্যে পুলিশকে দিতে হয় ২০০ টাকা। বাকিটা ওয়ার্ড কমিশনার, সরকারদলীয় স্থানীয় নেতা ও ময়লার বিল বাবদ খরচ হয়।
কারওয়ান বাজারের ফুটপাতে সবজি বিক্রি করেন মহিউদ্দিন সরকার। সমকালকে তিনি বলেন, মাসে ৫ হাজার টাকা ভাড়া ছাড়াও প্রতিদিন পুলিশকে চাঁদা দিতে হয় ১০০ টাকা। স্থানীয় চাঁদা ১০০ টাকা, একটি লাইট ভাড়া ৬০ টাকা। এ ছাড়া গত সপ্তাহ থেকে সিটি করপোরেশনের নামে নেওয়া হচ্ছে ৫০ টাকা করে। অন্যান্য খরচ আছে ৫০ টাকার মতো। সব মিলিয়ে একটা দোকানে মাসে গুনতে হয় ১৫ হাজার ৮০০ টাকা। অর্থাৎ দৈনিক ৫২৭ টাকা খরচ আছে। এর সঙ্গে নিজের খরচ, মজুরি ও লাভ হিসাব করতে হয়। এসব কিছুই তুলতে হয় সবজি বিক্রি থেকে।
বাংলাদেশ কাঁচামাল আড়তদার মালিক সমিতির সভাপতি ইমরান মাস্টার বলেন, এখন মোকামেই দাম বেশি। চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। সেই হারে উৎপাদন বাড়ছে না। তা ছাড়া রাস্তাঘাটের উন্নয়ন হওয়ায় অনেক কৃষক এখন সরাসরি বিভিন্ন জেলা থেকে সবজি ঢাকায় এনে বিক্রি করছেন। উৎপাদন এলাকায় বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। এতে কৃষকরা ভালো মুনাফা পাচ্ছেন। তারা বেশি লাভ পেলে উৎপাদন বাড়বে।
তিনি বলেন, প্রতি কেজি শিমের পরিবহন, পথে বিভিন্ন চাঁদা ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে ৫ টাকার মতো বাড়তি খরচ হয়। ব্যাপারীরা আড়তে পাইকারি বিক্রি করার সময় কেজিতে এক টাকা দিতে হয় কমিশন। এসব হিসাব করলেও খুচরায় দর বেশি হয়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের উৎপাদনের তথ্য ঠিক নয়। সার, বীজ, কীটনাশকসহ উৎপাদন খরচ অনেক বেড়েছে বলে জানান এই আড়তদার।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তর যা বলছে
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের বাজার সংযোগ বিভাগের সহকারী পরিচালক প্রণব কুমার সাহা বলেন, উৎপাদন খরচের যে তথ্য এখন ব্যবহার হচ্ছে, সেটি গত বছরের। এ বছরের তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি। কৃষি বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা কৃষকের সঙ্গে উঠান বৈঠক করে উৎপাদন ব্যয় নির্ধারণ করবেন। তাতে হয়তো গত বছরের তুলনায় সামান্য এদিক-সেদিক হবে। বেশি ফারাক হবে না। তিনি বলেন, মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে দাম বেশি বাড়ে। এটি নিয়ন্ত্রণে নতুন করে একটা অ্যাপ তৈরি হচ্ছে। এর মাধ্যমে কৃষিপণ্যের উৎপাদন, কোন পর্যায়ে কী দর হতে পারে, উৎপাদন কী পরিমাণে হয়েছে– এসব তথ্য থাকবে।
চাইলে আপনিও হতে পারেন ঢাকা ভয়েজ পরিবারের অংশ। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা কিংবা মতামত বা সৃৃজনশীল লেখা পাঠিয়ে দিন আমাদের ঠিকানায়। নাম সহ প্রকাশ করতে চাইলে লেখার নিচে নিজের নাম, পরিচয়টাও উল্লেখ করে দিন। ঢাকা ভয়েজে প্রকাশিত হবে আপনার লেখা। মেইল : dhahkavoice.news24@gmail.com
No comments