প্যারিস, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর শহর
প্যারিস আলোকিত এক শহরের নাম। ফ্রান্সের প্যারিস পৃথিবীর সমস্ত শহরের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর, রোমান্টিক ও মার্জিত হিসেবে জনপ্রিয়।
শিল্প-সাহিত্যে সমৃদ্ধ আর ঐতিহ্যের এক সুবিশাল ভাণ্ডার নিয়ে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস। চোখ ধাঁধানো আর হাজার বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যমন্ডিত এই শহর যেন অর্ধেক বাস্তব আর অর্ধেক কল্পনা মিশ্রিত। ইতিহাস-চেতনা, সৌন্দর্যবোধ, শিল্প-সাহিত্য আর জীবনদর্শন যেন প্যারিসের গলি-ঘুপচিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। আর তাই ইউরোপের কথা মনে আসলেই প্যারিস শহরের কথাও মনে আসবে। আর তাই হয়তো মানুষ বলে – 'স্বপ্নের এক শহরের নাম প্যারিস'।
পশ্চিম ইউরোপের রাষ্ট্রে অবস্থিত ফ্রান্স। প্যারিস ফ্রান্সের সবচেয়ে বৃহত্তম আর রাজধানী শহর। উত্তর ফ্রান্সের ইল-দ্য-ফ্রঁস অঞ্চলের প্রাণকেন্দ্রে সেন নদীর তীরে অবস্থিত।এই শহরের আয়তন ১০৫ বর্গ কিলোমিটার। পুরো ফ্রান্সের জনসংখ্যার প্রায় ১৮ শতাংশের বাস এই শহরে। যার কারণে প্যারিস ইউরোপীয় ইউনিয়নে জনসংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে বড় শহর। আর এই কারণেই বোধহয় শুধু ফ্রান্স না, পুরো পশ্চিম ইউরোপের ইতিহাস, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের ফ্রান্সের বাণিজ্য এবং সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে প্যারিস প্রতিষ্ঠিত। এছাড়াও, ইউরোপের অন্যতম সেরা বাণ্যিজিক নগরী হিসেবেও খ্যাত প্যারিস। দেশের সকল বড় বড় প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বিশ্বের অনেক বড় সংস্থা এবং প্রতিষ্ঠানেরই সদরদপ্তর এই প্যারিসে অবস্থিত।
প্যারিসের মুদ্রার না ফ্রেঞ্চ
বর্তমানের প্যারিসে প্ররথম ঘনবসতির প্রমাণ পাওয়া যায় ৭৬০০ খ্রিষ্টপূর্বে। তবে, খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর শেষের দিকে ল’এল দেলা সিটা এবং সেন নদীর উর্বর তীরভূমির আশেপাশের অঞ্চল জুড়ে জনবসতি গড়ে উঠেছিল বলে জানা যায়। কেল্টিকদের মতান্তরে গ্যালিকদের একটা ছোট্ট উপজাতি এখানে এসে নিজেদের আবাসস্থল বানিয়েছিল। পেশায় তারা ছিল মৎস্যজীবী। গোত্র অনুসারে তাদের নাম ছিল পারসিয়া। পারসিয়ারা আবার বেলজিক উপজাতিদের অন্তর্ভূক্ত; যারা আবার জার্মান গোত্রের বংশোদ্ভূত। এই পারসিয়াদের উপনিবেশকে লুটেশিয়া নামেও অভিহিত করা হতো।
রোমানরা যখন এই অঞ্চলে পা রেখেছিল ততদিনে পারসিয়ারা অনেক সংগঠিত আর ধনী জাতিতে পরিণত হয়েছিল। এমনকি তাদের তৈরি নিজস্ব স্বর্ণমুদ্রাও ছিল। জুলিয়াস সিজার তার গ্রন্থ কমেন্টারিতে এই পারসিয়াদের সম্পর্কে লিখেছিলেন, এই পারসিয়াদের আত্মসম্মানবোধ এতটাই ছিল যে তারা রোমানদের কাছে পরাজয় স্বীকার করার চাইতে নিজেদের বাড়িঘর আর দুর্গগুলোকে আগুনে পুড়ে দেয়াটাকেই সমীচীন বলে মনে করেছিল। খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী থেকে লুটেশিয়া রোমান শহর হিসেবে বেড়ে উঠে এবং সেন নদীর বাম তীরে জনবসতি বিস্তার করতে শুরু করে। এই জন্যই এই অঞ্চলের বেশীরভাগ স্থাপত্যশৈলীতেই রোমানদের ছাঁচ বেশ ভালোভাবেই প্রত্যক্ষ করা যায়।
খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর শুরু থেকেই বারবার ভিন্ন জাতির আক্রমণের শিকার হয় লুটেশিয়া। এরই সুবাদে নদীর বাম দিকের শহরটি ধ্বংস হয়ে যায় খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে। সেখানরা বাসিন্দারা বাধ্য হয় দ্বীপে আশ্রয় নিতে আর সেখানেই তারা জনবসতি গড়তে শুরু করে। সেই দ্বীপের চারপাশে তাদের সুরক্ষার জন্যে একটা ঘন প্রাচীর গড়ে তোলা হয়। পরবর্তীতে জুলিয়াস সিজারের অধীনে চতুর্থ শতাব্দীর দিকে লুটেশিয়া পারসিয়া জাতির নামানুসারে পারসি নামকরণ পায়; যা কালের বিবর্তনে প্যারিস রূপলাভ করে।
মূলত খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী থেকেই এই জায়গার নাম প্যারিস হয়েছে বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। তখন প্যারিস জুড়ে খ্রিষ্টান ধর্ম প্রসিদ্ধি লাভ করে এবং গীর্জা নির্মাণ শুরু হয়। এই সময়কালে আটিলা দ্য হান এবং তার সেনাবাহিনী কর্তৃক বেশ কয়েকবার হুমকি পায় এই শহর। জনশ্রুতি আছে যে, সেইন্ট জেনেভির দূরদর্শিতা সম্পন্ন হস্তক্ষেপের কারণে উক্ত আক্রমণগুলো প্রতিহত করা সম্ভব হয়েছিল।
৫ম শতাব্দীর শেষ দিকে সালিয়ান ফ্রাঙ্কসের প্রথম রাজা ক্লোভিস গলদের কাছ থেকে প্যারিস ছিনিয়ে নেয় এবং তাদের সাম্রাজ্যের রাজধানী নির্বাচিত করে প্যারিসকে। ৫৮৪ সাল অবধি চিল্পেরিকের রাজত্বের শেষকাল অবধি প্যারিস রাজধানীর সম্মান পেলেও, পরবর্তীতে মেরোভিনজিয়ানসা রাজধানীর মুকুট অন্যত্র সরিয়ে নেয়। তবে ৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে হিউ ক্যাপেটের সিংহাসন নির্বাচিত হওয়ার পরে ক্যাপেটিয়ান রাজধানী হিসেবে প্যারিস আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে।
ফিলিপ দ্বিতীয় এর রাজত্বকালে ১২০০ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসের ব্যাপক উন্নতি হয়। রাস্তাগুলোকে প্রশস্ত করা হয়, শহরের প্রাচীর বর্ধিত করা হয় এবং প্যারিসের সার্বিক উন্নতি সাধন করা হয়। চৌদ্দ শতকের শুরুটা ব্ল্যাক ডেথ মানে প্লেগের মহামারী দিয়ে শুরু হলেও পরপর তিনটা বিদ্রোহের সূচনা হয় – প্রথমটা ১৩৫৮ সালে বণিকদের ১৩৮২ সালে করের জন্যে মাইলোট বিদ্রোহ এবং ১৪১৩ সালে ক্যাবোচিয়ান বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহগুলো শতবর্ষী যুদ্ধের অংশ বলেও গণ্য করা হয়।
শতবর্ষী যুদ্ধে প্যারিসের অনেক ক্ষতি হয় এবং জোয়ান অব আর্ক ইংরেজদের হাত থেকে প্যারিসকে মুক্ত করতে ব্যর্থ হয়। রাজা ফ্রান্সিসের সময়কালে ব্রিটিশদের থেকে মুক্ত হয়ে প্যারিসের আরো উন্নয়ন হয়। পশ্চিমা ইউরোপের সবচেয়ে বৃহৎ শহরে পরিণত হয় প্যারিস। পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে ফ্রান্সেও রেনেসাঁর ছোঁয়া লাগে। নগর আবারো নতুন রূপে সাজতে থাকে আর নতুন চিন্তাধারায় গড়তে থাকে দেশ। এরই ধারাবাহিকতায় ফরাসী বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটে। পরবর্তীতে নেপোলিয়ন বেনোপোর্ট ফ্রান্সের অধিনায়ক হিসেবে ক্ষমতায় এসে প্যারিসের চাকচিক্য আরো বাড়ায়। নেপোলিয়ন যাওয়ার পরও প্যারিসে বেশ ক’বছর দারুণ অরাজকতা বিরাজমান ছিল। আঠারো শতকের শেষের দিকে ফ্রান্সে আইফেল টাওয়ারের কাজ শুরু হলে বিশ্বের বুকে ফ্রান্স তথা প্যারিস শহরের একটা প্রতীক স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা পায়।
প্রথম আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্যারিসের তেমন একটা ক্ষতি হয়নি। যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্যারিস জার্মানদের অধীনে ছিল যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে। বিংশ শতাব্দীতে এসে বিশ্ব যত আধুনিকতার ছোঁয়ায় পূর্ণ হতে থাকলো প্যারিসও যেন ততটাই সমৃদ্ধ হতে থাকলো। শিল্প সাহিত্য থেকে শুরু করে জ্ঞান আর ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণতা লাভ করলো প্যারিস। আর ধীরে ধীরে ইউরোপের অন্যতম সেরা শহরই নয় বরং বিশ্বের এক গুরুত্বপূর্ণ শহরের তালিকায় প্যারিসের নাম উঠে এসেছে।
আলোর শহর,ভালোবাসার শহর প্যারিসের অপরূপ সৌন্দর্যের প্রেমে পড়েছেন বহু চিত্রশিল্পী, লেখক, কবি সুরকার ও ভাস্কর। এখানে প্রতিবছর তিন কোটির বেশি পর্যটক বেড়াতে আসেন। এটি পৃথিবীর পর্যটনকেন্দ্রিক শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম।
প্যারিসের প্রতীক ‘আইফেল টাওয়ার’ থেকে একপলক ফেললেই চোখে পড়বে রূপকথার মোনালিসার ‘ল্যুভর মিউজিয়াম’, ফ্রেঞ্চ স্থাপত্যকলার অনন্য নিদর্শন ‘নটর ডেম ক্যাথেড্রাল’, নেপোলিয়নের বিজয়োল্লাস খচিত তোরণ ‘আর্ক ডে ট্র্যেম্ফে’ সহ আর অনেক ঐতিহাসিক গুরুত্ববাহী স্থান। তবে দর্শক যে ব্যাপারটি দেখে সবচেয়ে অবাক হবেন সেটি হলো একটি “স্ট্যাচু অফ লিবার্টি”। প্যারিসের বুক চিরে বয়ে চলা সিন নদীতে তৈরী করা কৃত্রিম দ্বীপে এটি স্থাপন করা হয়েছে ১৮৮৯ সালে। পুরো ফ্রান্স জুড়ে স্ট্যাচু অফ লিবার্টির প্রায় ৯টি রেপ্লিকা আছে। মূলত একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে এসে প্যারিসে থাকা এই সবকয়টি ঐতিহাসিক স্থান পরিণত হয়েছে বিশ্বের শীর্ষ পর্যটক গন্তব্যে। ইতিহাস বিখ্যাত এই প্যারিস এখনো আলোক ঝলমলে ভালোবাসার শহর।
নিচে প্যারিসের আরো দর্শনীয় স্থানসমূহের মধ্যে অন্যতম কিছু স্থান হচ্ছে.
আইফেল টাওয়ার।১৮ হাজার ৩৮টি লোহার টুকরার সমন্বয়ে তৈরি এই স্থাপত্যশৈলী বর্তমানে প্যারিস তথা ফ্রান্সের প্রতীক বলে বিশ্বব্যাপী মর্যাদা পেয়েছে। ফ্রান্সে ঘুরতে গিয়ে আইফেল টাওয়ার না দেখা ফ্রান্সে না যাওয়ারই সমতুল্য বলে মনে করেন অনেকেই।
মিউজিয়ামের শহর নামেও বিশেষ খ্যাতি আছে প্যারিসের।পুরো প্যারিস জুড়ে মোট ১৭৩টি মিউজিয়াম আছে।বিশ্বখ্যাত ল্যুভর মিউজিয়াম প্যারিসে অবস্থিত।লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি এর অমর কীর্তি “মোনালিসা” সংরক্ষিত আছে এই মিউজিয়ামেই। ৩,৮০,০০০ এর বেশী দর্শনীয় বস্তু আছে এই ল্যুভর মিউজিয়ামে।ইউনেস্কোর জরিপে ফ্রান্সের ল্যুভর মিউজিয়াম পৃথিবীর সবচাইতে জনপ্রিয় জাদুঘরগুলির একটি।
লাভ প্যাডলক। অনিন্দ্যসুন্দর শহর প্যারিসকে আষ্ঠেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে সিন নদী। আর সেই নদীর উপর বিভিন্ন স্থানে আছে শৈল্পিক ৩৭টি ব্রিজ। পায়ে হাঁটার জন্যে নির্ধারিত সুন্দর ছিমছাম এই ব্রিজের রেলিংয়ের বেশ কয়েকটিতে চোখে পড়বে “লাভ প্যাডলক” নামে এক বিশেষ ধরনের তালার। এই তালাগুলো প্রেমিক অথবা প্রেমিকা যেকোনো কেউ আরেকজনের নাম বা নামের প্রথম অক্ষর খচিত করে এই ব্রিজগুলোর রেলিঙয়ে বেঁধে রাখেন এবং এর চাবিটি ফেলে দেন সিন নদীতে।
প্যারিস হলো শান্তির শহর। ঐতিহাসিকভাবে এই শহরেই রচিত হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তিসূচক শান্তিচুক্তি, যেটি “প্যারিস পিস কনফারেন্স” নামে পরিচিত। এই কনফারেন্সেই স্বাক্ষরিত হয়েছিলো “ভার্সাই চুক্তি”। আর “লিগ অফ নেশনস” এর ধারণা বেরিয়ে আসে এই পিস কনফারেন্স থেকেই।
ফরাসি স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন মন্টমার্ত্রে, লিয়ন, নেপোলিয়নের বিজয়োল্লাস তোরণ আর্ক ডে ট্র্যেম্ফে, প্লেস দে লা কনকর্ড, ডিজনিল্যান্ড ফরাসি নিদর্শন পর্যটকদের এতটাই আকৃষ্ট করে যে ফ্রান্স পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পর্যটক পরিদর্শনকারী দেশ এবং শহর হিসেবে প্যারিসকে পরিগণিত করা হয়। সৌন্দর্য পিপাসুদের জন্য ফ্রান্সের প্যারিস এক স্বপ্নের রাজ্য।
No comments