মুক্তিযোদ্ধা ভেবে দরজা খুলেছিলেন শহীদুল্লা কায়সার
সাহিত্য তার আপোষের জায়গা ছিল না। বারবার দৃঢ় হয়ে সত্য প্রকাশ করেছেন নিঃসঙ্কোচে। কেবল সাহিত্যই নয়, রাজনীতি, সাংবাদিকতা বা জীবনের আদর্শ কোথাও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। তিনি হলেন শহীদুল্লা কায়সার।
১৯২৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি জন্মেছেন ফেনীর মজুপুর গ্রামে। ছাত্রজীবন থেকেই ছিলেন ভীষণ সংস্কৃতিমনা। বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে ছিল সক্রিয় অংশগ্রহণ। ১৯৪৬ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে অনার্সসহ বিএ পাস করার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ শ্রেণিতে অধ্যয়ন করেন। এরপর ৪৭'র দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক ধারার সব আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনে অত্যন্ত সাহসী ভূমিকা পালন করেন এবং তাতে গ্রেফতার হয়ে প্রায় সাড়ে তিন বছর কারাভোগ করেন।
পরবর্তী সময়টা ১৯৫৮এর, যোগ দিয়েছিলেন দৈনিক সংবাদ-এর সম্পাদকীয় বিভাগে সহকারী সম্পাদক হিসেবে। কিন্তু সে বছর সামরিক আইন জারি হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে ১৪ অক্টোবর তাকে, জননিরাপত্তা আইনে ফের গ্রেপ্তার করে আইয়ুব সরকার। কিন্তু তাতেও তিনি ক্ষান্ত হননি...রাত-দিন এক করে জেলে বসেই লিখার কাজ চালিয়ে গেছেন। রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে যেতো...লেখা তার থামতোই না!
জেল থেকে মুক্ত হওয়ার এক মাস পরে ১৯৬২ সালের নভেম্বর মাসে ছাপা হলো তার বিখ্যাত উপন্যাস 'সারেং বউ'। কেবল সারেং বউই নয় বিখ্যাত উপন্যাস 'সংশপ্তক', 'রাজবন্দীর রোজনামচা'ও তার কারাগারে বসে লেখা। জীবনের বড় একটি সময়ই শহীদুল্লা কায়সারকে কাটাতে হয়েছে কারাগারের নির্জন গহীন প্রকোষ্ঠে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাত্রির গণহত্যার পর যখন বহু শিল্পী, বুদ্ধিজীবী সাহিত্যিক দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন, নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরেছেন, তখনও তিনি কর্মরত ছিলেন ঢাকায় দৈনিক সংবাদ-এ।
দীর্ঘ ৯মাস পর ১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পুরাণ ঢাকার কায়েতটুলীর বাসায় মোমবাতি জ্বালিয়ে বিবিসি শোনার জন্য অপেক্ষা করছেন শহীদুল্লা কায়সার। সঙ্গে তার স্ত্রী- পান্না কায়সার শিশু কন্যা শমী কায়সারকে খাওয়াচ্ছিলেন। ঠিক এমন সময় দরজায় এলো কড়া নাড়ার শব্দ। শহীদুল্লা কায়সার ভেবেছিলেন হবে কোনো মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু না, কালো কাপড়ে মুখ জড়ানো চার পাঁচ জন তরুণ এসে জানালো, তারা শহীদুল্লা কায়সারকে খুঁজছেন। জবাবে তিনি বললেন, আমিই শহীদুল্লা কায়সার। খোঁজার কারণ জানতে চাইলে...একজন বললেন, তাকে তাদের সঙ্গে যেতে হবে...পরিস্থিতির কিছুটা আঁচ করতে পেরে, যাওয়ার বেলায় তিনি তার পরিবারকে শুধু একবার হালকা গলায় বলেছিলেন, 'ভালো থেকো'। তারপর যে গেলেন, আর এলেন না। রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে বুদ্ধিজীবীদের অনেকের লাশ চিহ্নিত করা গেলেও, পাওয়া যায়নি শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লা কায়সারের লাশ।
শহীদুল্লা কায়সার বেঁচেছিলেন মাত্র ৪৪ বছর। এ নাতিদীর্ঘ জীবনে তিনি সেই কাজটিই করে গেছেন, একজন প্রকৃত বুদ্ধিজীবীর যা করণীয়। সারা জীবনের কর্ম আর সৃজনশীলতায় আবদ্ধ নিজের কাজগুলো যে স্বজাতির ভবিষ্যৎ মানুষরা দেখবেন, তা তিনি জানতেন... তাই সেভাবেই কাজ করে গেছেন, নিদর্শন হিসেবে রেখে গেছেন অনেক কিছুই, যাতে জাতি তা অনুসরণ করতে পারে।
No comments